ডিভিটি বা শিরায় রক্ত জমাট বাঁধে কেন, করণীয় কী

ডিভিটি বা শিরায় রক্ত জমাট বাঁধা
ছবি: সংগৃহীত

ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা ডিভিটি নামটা অনেকের কাছে পরিচিত নয় বলে অনেকে হয়তো জানেনই না তিনি ওই সমস্যায় আক্রান্ত।

ডিভিটি কী, কেন হয়, লক্ষণ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নিন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রক্তনালী বিশেষজ্ঞ ও সার্জন অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশারের কাছ থেকে।

ডিভিটি কী

অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান বলেন, শিরা হচ্ছে রক্ত চলাচলের পথ। মানুষের শরীরে দুই ধরনের রক্তনালী থাকে। একটা দিয়ে রক্ত আসে এবং আরেকটা দিয়ে রক্ত ফেরত যায় হৃদপিণ্ডে। ফেরত যাওয়ার পথটাকে শিরা বা ইংরেজিতে ভেইন বলা হয়। শিরাগুলো মানুষের শরীরে দুইটি স্তরে থাকে, যেমন- চামড়ার নিচে ও মাংসের গভীরে।

মূলত মাংসের গভীরে থাকা শিরাগুলোই রক্ত আমাদের শরীরের হাত, পা বা অন্য জায়গা থেকে ফেরত নিয়ে হৃদপিণ্ডে ফেরত নিয়ে যায়। এই গভীর শিরাগুলোর মধ্যে যখন কোনো কারণে রক্ত জমাট বেঁধে যায় তখন তাকে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা ডিভিটি বলা হয়।

ডিভিটি কেন হয়

ডা. বাশার বলেন, রক্ত তরল পদার্থ, সবসময় গতিশীল ও প্রবাহমান থাকে। কোনো কারণে শরীরে রক্ত চলাচল স্থবির হয়ে পড়লে বা বাধাগ্রস্ত হলে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।

রক্ত জমাট বাঁধার পেছনে বিভিন্ন কারণ আছে। তবে তিন ধরনের পরিস্থিতির কথা বলেন এই চিকিৎসক-

১. দীর্ঘসময় ধরে নড়াচড়া না করলে, অসুস্থতা বা যে কোনো কারণে দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে আছেন এমন ব্যক্তিদের রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে এটি খুব বেশি হয়। বিমান বা সড়কে দীর্ঘসময় ভ্রমণ করলেও এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

ডা. বাশার বলেন, বিমানে দীর্ঘসময় ভ্রমণে একভাবে বসে থাকা ও পায়ের নড়াচড়া বন্ধ থাকার কারণে রক্ত চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। বিমানের ইকোনমি ক্লাসে নড়াচড়ার সুযোগ তুলনামূলক কম হওয়াতে ইকোনমি যাত্রীরা অনেক সময় ডিভিটি রোগে আক্রান্ত হন। তাই এই ধরনের সমস্যাকে 'ইকোনমি ক্লাস সিনড্রোম' বলা হয়।

২. রক্তনালির ভেতরের দেয়ালে যদি কোনো ইনজুরি হয়, তাতেও রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে।

৩. শরীরে রক্ত তরল রাখার জন্য কিছু বিশেষ উপাদান আছে, যেগুলো রক্ত জমাট বাঁধতে বাঁধা দেয়। যেমন- প্রোটিন সি, প্রোটিন এস, অ্যান্টি থ্রম্বিন ৩, ফ্যাক্টর ৫। কারো শরীরে যদি জন্মগতভাবে এসব উপাদানের ঘাটতি থাকে, তাহলে তাদের রক্ত সহজে জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এসব রোগীদেরকে থ্রম্বোফিলিক বলা হয় অর্থাৎ তাদের থ্রম্বোফিলিয়া আছে বলে ধরে নেয়া হয়। অল্প বয়সীদের মধ্যে ডিভিটি দেখা গেলে থ্রম্বোফিলিয়ার কথা চিন্তা করা উচিত।

বিশেষ ঝুঁকিতে কারা

১. দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে আছেন এমন রোগীরা

২. যেকোনো ধরনের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা

৩. করোনা আক্রান্ত রোগীরা

৪.  ভ্রমণে দীর্ঘসময় নড়াচড়া করতে পারেন না যারা

৫. যাদের রক্তে ন্যাচারাল অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্টগুলোর ঘাটতি আছে

৬. অন্তঃসত্ত্বা নারী

লক্ষণ

ডা. বাশার বলেন, হঠাৎ করে যদি দেখা যায় কারো পা বা ক্ষেত্রবিশেষে হাত হঠাৎ করে অনেকখানি ফুলে গেছে, ব্যথা করছে এবং শক্ত হয়ে গেছে, তাহলে প্রাথমিকভাবে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস সন্দেহ করতে হবে। এটি হচ্ছে একিউট ডিভিটি অর্থাৎ হঠাৎ করে হওয়া ডিভিটি।

আরেক রকমের ডিভিটি হচ্ছে ক্রনিক ডিভিটি অর্থাৎ আগে ডিভিটি হয়েছিল, ধরা পড়তে দেরি হয়েছে। ক্রনিক ডিভিটির ক্ষেত্রে পা কিছুটা নরম হয়ে আসবে, ফোলা এবং ব্যথাও কিছুটা কমবে। তবে দীর্ঘদিন ক্রনিক ডিভিটি থাকলে অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন- পা কালো হয়ে যায়, নিচের দিকে ধীরে ধীরে ক্ষত তৈরি হয় যা সহজে শুকোতে চায় না। এ অবস্থাকে 'পোস্ট-থ্রম্বোটিক সিনড্রোম' বলা হয়।

ফুলে যাওয়া, ব্যথা ও শক্ত হয়ে যাওয়া- এই তিনটা জিনিস যদি এক পা অথবা এক হাতে হয় তাহলে সেটি ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিসের কারণে হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কিন্তু যদি দুই পা একসঙ্গে ফুলে যায় সেক্ষেত্রে ডিভিটির আগে অন্য সমস্যা যেমন- হার্ট, কিডনি, লিভার, থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতিজনিত সমস্যার কথা চিন্তা করতে হবে।

পরীক্ষা ও চিকিৎসা

রক্তনালীর আল্ট্রাসনোগ্রাম বা 'ভাস্কুলার ডুপ্লেক্স স্টাডি' পরীক্ষার মাধ্যমে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস আছে কি নেই সেটি সবচেয়ে ভালোভাবে শনাক্ত করা যায় বলে জানান ডা. বাশার।

এ ছাড়া 'ডি ডাইমার' নামে রক্তের একটা পরীক্ষা করেও অনেক সময় ডিভিটি সম্পর্কে জানা যায়। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ওষুধের মাধ্যমেই ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিসের চিকিৎসা দেওয়া হয়। শুরুতে এক ধরনের ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করা হয়। কয়েকদিন ইনজেকশন দেওয়ার পরে মুখে খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায়। দেশে ডিভিটি চিকিৎসার পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে।

এ ছাড়াও থ্রম্বোলাইসিস নামে সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে ডিভিটির। সেটি বাংলাদেশ সহজলভ্য নয় বলে জানান এই চিকিৎসক।

লক্ষণ দেখে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস সন্দেহ হলে ভাস্কুলার সার্জন, কার্ডিওলজিস্ট বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন ডা. বাশার।

স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিসের ক্ষতিকর দিক

ডা. বাশার বলেন, ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস মূলত পায়ের সমস্যা। তবে কখনো কখনো এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। পায়ের শিরা থেকে জমাট বাঁধা রক্তের বড় চাকা বা পিণ্ড যদি কোনোভাবে ছুটে যায় তাহলে রক্তের স্রোতে ভেসে তা হৃদপিণ্ড হয়ে সরাসরি চলে যাবে ফুসফুসে। আর এই জমাট বাঁধা রক্তের পিণ্ড দিয়ে ফুসফুসের বড় রক্তনালী হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে রোগী তৎক্ষণাৎ মারা যেতে পারে। এটিকে বলা হয় 'ম্যাসিভ পালমোনারি এম্বোলিজম'। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অনেক সময় রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পর্যন্ত পাওয়া যায় না। পায়ের শিরা থেকে ছুটে যাওয়া জমাট রক্তের চাকা ছোট হলেও সেটি দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এরা ধীরে ধীরে ফুসফুসের রক্তনালী বন্ধ করে দিতে পারে, যাতে দীর্ঘমেয়াদে পালমোনারি হাইপারটেনশন তৈরি হয়। এতে শ্বাসকষ্ট, অল্পতেই পরিশ্রান্ত হয়ে যাওয়া এসব সমস্যা দেখা দেয়।

অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার বলেন, পা ফোলা সমস্যা অনেকেরই থাকে, এটি অবহেলা করা উচিত নয়। সব পা ফোলাজনিত সমস্যা হয়তো ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস নয়, কিন্তু যদি ডিভিটি হয়ে থাকে এবং সেটা সঠিক সময়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা করা না যায়, তাহলে তা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে নানা সমস্যা তৈরি করবে। তাই পা ফুলে গেলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

Comments

The Daily Star  | English

Not satisfied at all, Fakhrul says after meeting Yunus

"The chief adviser said he wants to hold the election between December and June"

16m ago