প্যানিক ডিজঅর্ডারের লক্ষণ কী, কারণ ও চিকিৎসা
প্যানিক ডিজঅর্ডার একটি উদ্বেগজনিত সমস্যা। প্যানিক অ্যাটাক থেকে এটি ঘটে থাকে।
এর লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
প্যানিক ডিজঅর্ডার কী
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্যানিক ডিজঅর্ডার মূলত এক ধরনের উদ্বেগজনিত রোগের একটি অংশ। এ সমস্যায় নিয়মিতভাবে একজন ব্যক্তির মধ্যে প্যানিক অ্যাটাক হয়। প্যানিক অ্যাটাক যে কারো যেকোনো সময় হতে পারে। সেটি হলেই এটা ডিজঅর্ডার না। তবে ঘনঘন যখন প্যানিক অ্যাটাক হতে থাকে তখন সেটাকে প্যানিক ডিজঅর্ডার বলা হয়।
প্যানিক ডিজঅর্ডারের লক্ষণ
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্যানিক ডিজঅর্ডার হচ্ছে তীব্র মানসিক ও শারীরিক কিছু লক্ষণ। যেমন-
১. ব্যক্তির মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ভর করে। সেটা মূলত মৃত্যুভীতি।
২. ভেতরে এক ধরনের মানসিক চাপ অনুভূত হয়।
৩. বুক ধড়ফড় করতে থাকে।
৪. মনে হবে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন।
৫. ঘাম হতে থাকে, মাথা ঘুরতে পারে।
৬. বমি ভাব ও পেটের ভেতরে অস্বস্তি হতে পারে।
৭. বুকে ব্যথা হয়।
৮. নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না এরকম অনুভূতি হয়।
৯. হাত-পা কাঁপতে পারে।
১০. হটফ্লাশ হতে পারে।
১১. হঠাৎ করে ঠান্ডা লাগতে পারে।
১২. হাত-পায়ের আঙুলের ডগা ঝিমঝিম করতে পারে।
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, এই বিষয়গুলো প্যানিক অ্যাটাকে হতে পারে। এটি ৫ থেকে ১৫ বা ২০ মিনিটের মতো স্থায়ী হয়। এই সময়টিতে মানুষ মনে করে সে মারা যাচ্ছে। এই প্যানিক অ্যাটাক যখন ঘন ঘন হতে থাকে তখন তাকে প্যানিক ডিজঅর্ডার বলা হয়।
প্যানিক ডিজঅর্ডার কেন হয়
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, 'একক কোনো কারণে প্যানিক ডিজঅর্ডার হয় না, আমরা বলি এটা বায়োসাইকোসোশ্যাল। মস্তিষ্কে কিছু নিউরোট্রান্সমিটার আছে, সেই নিউরোট্রান্সমিটার বা মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতি ও ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে উদ্বিগ্নতা তৈরি হতে পারে। এটা হচ্ছে বায়োলজিক্যাল কারণ।
আর সাইকোলজিক্যাল কারণ হচ্ছে একজন ব্যক্তির বেড়ে উঠা, তার শৈশবের স্মৃতি, তার প্যারেন্টিং, ভীতি, সমাজকে সে কীভাবে দেখে, সমাজ তাকে কীভাবে দেখে এই সকল বিষয়গুলো ওই ব্যক্তির ভেতরে কখনো কখনো উদ্বিগ্নতা তৈরি করতে পারে, যেটি তাকে প্যানিক অ্যাটাক বা প্যানিক ডিজঅর্ডারে নিয়ে যায়। সবার প্যানিক অ্যাটাক বা ডিজঅর্ডার একই কারণ ঘটে না।
এখানে কিছু বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্যানিক অ্যাটাকের সময় মনে হবে যেন মারা যাব, মারা যাচ্ছি। অনেক সময় দেখা যায় এ ধরনের রোগীরা কার্ডিয়াক হাসপাতাল বা জরুরি বিভাগে হাজির হন।
বংশে বা পরিবারে কারো প্যানিক অ্যাটাক, প্যানিক ডিজঅর্ডার থাকলে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যেও আসতে পারে। তীব্র মানসিক চাপ, জীবনে ট্রমাটিক কোনো কিছু যদি থাকে যেমন বড় দুর্ঘটনা ঘটা, মৃত্যু থেকে বেঁচে ফেরা, নিপীড়ন যা কাউকে বলতে পারছেন বা সুবিচার পাচ্ছেন না ইত্যাদির মতো কারণ থেকে প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। এ ছাড়া কখনো কখনো মাদক, বিশেষ করে ক্যাফেইন, স্টিমুলেটিং মাদক যদি কেউ গ্রহণ করেন, শৈশবে কারো শারীরিক বা যৌন নিপীড়নের ঘটনা থাকলে তার প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।'
প্যানিক ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা
এটা প্রকৃত প্যানিক অ্যাটাক নাকি শারীরিক বা হৃদপিণ্ডের কোনো সমস্যার কারণে হচ্ছে সেটি নির্ণয় করা চিকিৎসকের মূল দায়িত্ব। প্রকৃত প্যানিক অ্যাটাক নিশ্চিত হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা হচ্ছে তাকে আশ্বস্ত করা, কিছু ওষুধ দিয়ে উদ্বিগ্নতার শারীরিক লক্ষণগুলো কমানো।
দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা হচ্ছে ভবিষ্যতে প্যানিক অ্যাটাক যেন প্যানিক ডিজঅর্ডার না হয় তার ব্যবস্থা করা। রোগীকে কাউন্সিলিং করা, বিহেভিয়ার থেরাপি, কগনিটিভ থেরাপি দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে প্যানিক অ্যাটাক কেন হচ্ছে, হলে কী করণীয়, ওষুধের প্রয়োজন হলে কতদিন খাবে, কীভাবে সে মানিয়ে চলবে এর সঙ্গে, এটিতে যে মৃত্যুভয়ের কিছু নেই এই বিষয়গুলো আত্মস্থ করানো। প্যানিক ডিজঅর্ডারের জন্য অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের চিকিৎসা সেবা নিতে হবে।
প্যানিক অ্যাটাক শুরু হলে ওই মুহূর্তে করণীয় কী?
প্যানিক অ্যাটাক হলে ওই ব্যক্তিকে প্রথমত অস্থির হতে দেওয়া যাবে না, অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করতে হবে, পরিবারের সদস্যদের স্থির থাকতে হবে, তারাও যাতে অস্থিরতা না বাড়ায় সেটি খেয়াল রাখতে হবে। না জেনে চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া মুখে কোনো ওষুধ দেওয়া যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে নিশ্চিত হতে হবে এটি প্রকৃত প্যানিক অ্যাটাক কি না।
মনে রাখতে হবে. রোগীর যদি ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ থেকে থাকে তাহলে প্যানিক অ্যাটাক হলেও প্রথমে তাকে অবশ্যই সেই রোগের জন্য চিকিৎসকরা যে ওষুধ বা তাৎক্ষণিকভাবে যা করতে হবে বলেছেন সেটির প্রয়োগ করতে হবে।
প্যানিক অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয়
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্যানিক ডিজঅর্ডার সম্পর্কে জানতে হবে। তখন রোগী লক্ষণ দেখে বুঝতে পারবেন যে এই সমস্যা শুধু হার্টের কারণে নাও হতে পারে। এর ফলে ভয় বা আতঙ্কের জায়গা কমে আসবে।
একবার প্যানিক অ্যাটাকের পর কোনো ব্যক্তি যদি কাউন্সিলিং সেশনে যান, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি নেন তখন প্যানিক অ্যাটাক তাকে সহজে আক্রান্ত করবে না। তিনি নিজেই তার সমস্যা বুঝতে পারবেন।
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্যানিক ডিজঅর্ডার ছদ্মবেশী রোগ, প্যানিক ডিজঅর্ডারে কোনো ঝুঁকি নেই। তবে এর যে লক্ষণ সেই একই লক্ষণ নিয়ে কার্ডিয়াক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। দুটো ক্ষেত্রেই লক্ষণ একই রকম। ঝুঁকি তখনই, যখন সত্যিকারের হার্টের সমস্যাকে প্যানিক ডিজঅর্ডার মনে করা হবে।
তাই যে কোনো লক্ষণকেই শুরুতেই প্যানিক ডিজঅর্ডার বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কার্ডিয়াক সমস্যা আছে কি না প্রথমে সেটি দেখতে হবে। সেটি না থাকলে পরে প্যানিক ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা নিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় সত্যিকারের হৃদপিণ্ডের সমস্যাকে প্যানিক ডিজঅর্ডার বলে ভুল করেন অনেকে। তখন রোগীর ক্ষতির আশঙ্কা রয়ে যায়।
Comments