পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবহেলা নয়, জেনে নিন করণীয়

পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য
ছবি: সংগৃহীত

শারীরিক সুস্থতা নিয়ে আমরা যতটুকু সচেতন, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক ততটাই আমাদের কাছে অবহেলিত। পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আমাদের সমাজে আরও বেশি অবহেলিত। সামাজিক চাপ, সমাজব্যবস্থা এবং তথাকথিত পুরুষতন্ত্র ছেলেদের মানসিক সমস্যা প্রকাশ করতে দেয় না। সমাজ তাকে শেখায় 'তুমি পুরুষ, তুমি হবে ইস্পাত কঠিন। মানসিক সমস্যা আবার কী? থাকলেও চেপে যাও।'

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ পরামর্শ দিয়েছেন পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে।

পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা 

হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সমাজ যেমন পুরুষদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে তেমনি দিয়েছে অগাধ দায়িত্ব। সমাজ নির্ধারণ করে দিয়েছে একজন পুরুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত। সামাজিক চাপে একজন পুরুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। `পুরুষদের কাঁদতে নেই' বা `Be a man!' এসব বাক্য মূলত বলা হয় ছেলেদের আবেগ, চাল-চলন, কথা-বার্তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। পুরুষরাও কষ্ট পান, কষ্টের ব্যথায় নিজের ভেতর ভেঙে পরেন। সামাজিক রীতিনীতি চাপে ভর করতে পারে ক্লান্তি। একজন নারী যেমন খুব সহজে আবেগের প্রকাশ ঘটাতে পারেন একজন পুরুষ সেটি পারেন না পারিবারিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক কারণে। নিজেকে সামাজিক কাঠামোর সংজ্ঞা অনুযায়ী পুরুষ প্রমাণ করতে গিয়ে নিজের অনুভূতিকে নিজের মধ্যে চেপে রাখেন এবং একটা সময় গিয়ে দেখা দেয় বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, যখন কোনো ব্যক্তির আচরণ, ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়, বিশেষ করে তার আবেগীয় প্রকাশের পরিবর্তন আসে এবং সেটা তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ও সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে শুরু করে, তখন বুঝতে হবে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন। তখন তার প্রতি বাড়তি নজর দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পুরুষদের ওপর সমাজের চাহিদা ব্যাপক। তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে, এক সময় ঢাল হয়ে দাঁড়াবে এমনটাই প্রত্যাশা থাকে। এই বাড়তি প্রত্যাশা যখন পূরণ করতে পারেন না তখন পুরুষদের মধ্যে তৈরি হয় হতাশা।

পুরুষদের মধ্যে ডিপ্রেশন নারীদের তুলনায় বেশি দেখা যায়। অতিরিক্ত বিরক্ত প্রকাশ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো, অতিরিক্ত ঝুঁকিগ্রহণ মেল ডিপ্রেশনের প্রাথমিক লক্ষণ। পুরুষদের ডিপ্রেশন বিষয়ে কথা বলার পরিবর্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

শুধু তাই নয়, নারীদের তুলনায় পুরুষদের সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগার হারও বেশি। অনেকেই মেল ইগোর কারণে বোঝেন না তিনি এই ধরনের মানসিক সমস্যায় আছেন। ইংল্যান্ডভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি। আমাদের দেশেও এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটে। মূল কারণ হলো পছন্দসই চাকরি না পাওয়া, পারিবারিক চাপ, প্রেমে ব্যর্থতাসহ সমাজের ছকে বাঁধা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়া। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে চাহিদাগুলো সমাজের সৃষ্টি।

নিজের-পরিবারের সচেতনতা এবং করণীয়

পুরুষদের মধ্যে মানসিক সুস্থতা নিয়ে সচেতনতা বেশ কম। তাদের কাছে আবেগ প্রকাশ মানেই সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে ছোট হয়ে যাওয়া। তবে এই ট্যাবু থেকে বের হতে হবে।

হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নিজেকে পুরুষ ভাবার আগে মানুষ ভাবতে হবে। নিজের মানসিক সুরক্ষার দায়িত্ব নিজেরই। আবেগকে নিজের মধ্যে চেপে না রেখে তা প্রকাশ করতে হবে, নিতে হবে মানসিক যত্ন। নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহণ, ইতিবাচক মনোভাব,পর্যাপ্ত ঘুম অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারে। যদি মনে হয় আপনার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তাহলে তা নিজের মধ্যে না চেপে রেখে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি আপনাকে কাউন্সিলিং বা প্রয়োজনে ওষুধ প্রদান করবেন।

পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবারের সদস্য ও আশেপাশের মানুষদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, আমাদের সমাজে পুরুষ মানেই পরিবারের চাহিদার যোগানদাতা। এজন্য পরিবারে সম্মান পুরুষ পায় কিন্তু পরিবারের পুরুষদের মনের খবর কান পেতে শোনার চেষ্টা করি কি? স্কুলে বা বাইরে ছেলেরা বুলিংয়ের শিকার হয় বেশি, যা ট্রমার কারণ হতে পারে।

বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে ছেলে স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে কি না। ছোটবেলা থেকেই পুরুষতান্ত্রিকতা বোধ না ঢুকিয়ে বরং মনুষ্যত্ববোধের চর্চা করাতে হবে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ শেখাতে হবে। সামাজিক কারণে ছেলেদের মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠে মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করেই। আমরা আশেপাশের লক্ষ করলে এই ধরনের ঘটনা অনেক দেখতে পাব। তাই কাছের পুরুষদের এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে তাদের আবেগকে গুরুত্ব দিতে হবে, প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

মনে রাখবেন, মানসিক স্বাস্থ্য কোনো হাসিঠাট্টার বিষয়বস্তু নয়। এই সমস্যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই হতে পারে। মানসিক রোগ যেন বাসা না বাঁধে, সময় থাকতে সেদিকে সচেতন হতে হবে, সঙ্গে যত্ন নিতে হবে মনের।

 

Comments

The Daily Star  | English
govt employees punishment rule

Govt employees can now be punished for infractions within 14 working days

Law ministry issues ordinance amending the Public Service Act, 2018

2h ago