সোশ্যাল ফোবিয়া কেন হয়, কাটিয়ে উঠবেন কীভাবে

সোশ্যাল ফোবিয়া
ছবি: সংগৃহীত

কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হবে, অনেক মানুষের উপস্থিতি কথা বলতে হবে ভাবলেই অনেকের হাত-পা কাঁপতে থাকে, ঘাম হয় এমনকি অপরিচিত কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সময়ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। কেন এমন হয় এবং এর সমাধান সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

সোশ্যাল ফোবিয়া কী

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, সোশ্যাল ফোবিয়ার আরেক নাম হচ্ছে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। এটি এমন একটি মানসিক অবস্থা যার ফলে যেকোনো সামাজিক পরিবেশে, মানুষের সামনে অথবা জনসমাবেশে, মিটিংয়ে, কোনো প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় ব্যক্তির ভেতর বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগের লক্ষণ দেখা যায়। পেটের ভেতর খালি খালি লাগে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে, বুক ধড়ফড় করে, ঘাম হয়, মুখ শুকিয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, বার বার পানি খেতে হয়, বার বার টয়লেটে যাওয়ার তাড়না তৈরি হয়।

সামাজিক যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষের ভেতর যে উদ্বেগ তৈরি হয় অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে ভীতি তৈরি হয় তাকে সোশ্যাল ফোবিয়া বা সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বলে।

সোশ্যাল ফোবিয়ায় একইসঙ্গে ভীতি, উদ্বিগ্নতা থাকে এবং মানসিক চাপ তৈরি হয়। এতে পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। সোশ্যাল ফোবিয়া যেকোনো বয়সেই হতে পারে, সাধারণত সোশ্যাল ফোবিয়া হঠাৎ করে কারো মধ্যে বেশি বয়সে তৈরি হয় না। কিশোর বা বয়ঃসন্ধিকালে এটি বেশি দেখা যায়।

কেন হয়

সোশ্যাল ফোবিয়া একক কোনো কারণে হয় না। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন-

১. শৈশবে শিশুর বেড়ে ওঠার সময় যদি তাকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিয়ে বড় করা হয়, আবেগের নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক উপায়ে আবেগে প্রকাশ করতে না শেখে, যদি সামাজিক দক্ষতা না শেখানো হয় তাহলে সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে।

২. জেনেটিক বা জিনগত কারণে সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে। বংশে যদি কারো সোশ্যাল ফোবিয়া থাকে তাহলে এই রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

৩. অ্যামিগডালা মস্তিষ্কের একটি অংশ যা ভয়, উদ্বেগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যামিগডালায় যদি কোনো গুণগত মানের ত্রুটি থাকে তাহলে সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে। মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার কারণে হতে পারে।

৪. শৈশবের বিকাশ যদি কোনো কারণে ব্যাহত হয়, শিশুর বেড়ে ওঠার সময় যে পরিবেশ ছিলো সেটি যদি সঠিক ও সুষম না হয়, সামাজিক পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার মত দক্ষতা শৈশব থেকে না শিখে তাহলে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার হতে পারে।

৫.যদি কেউ নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, কারো দ্বারা সমালোচনা, নেতিবাচক মন্তব্য, মজা, খারাপ আচরণ কিংবা বুলিংয়ের শিকার হলে পরবর্তীতে সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে।

৬. সোশ্যাল ফোবিয়া আছে এমন ব্যক্তিকে নিয়ে সামাজিক কোনো পরিবেশে যদি হাসাহাসি, বুলিং করা হয় তাহলে পরবর্তীতে তার সোশ্যাল অ্যাংজাইটি আরো বেশি বেড়ে যায়।

লক্ষণ

সামাজিক পরিবেশে কোনো কিছু উপস্থাপন করতে গেলে, কারো সঙ্গে কথা বলার সময়, জনসম্মুখে কথা বলতে গেলে, কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে এমনকি কেনাকাটা করতে গিয়ে কোনো কিছুর দাম জিজ্ঞেস করতেও সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে।

১. যেখানে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং পারস্পরিক যোগাযোগ করতে হবে সেরকম পরিস্থিতি এড়িয়ে চলে।

২. আগে থেকেই চিন্তা করে সে ওই স্থানে যাবে না, সেখানে গেলে তার বিব্রতকর পরিস্থিতি হতে পারে এরকম চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়।

৩. অপরিচিত মানুষ ভয় পায়, অপরিচিত কাউকে দেখলেই এড়িয়ে চলে, কথা বলে না।

৪. সামাজিক পরিস্থিতি, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে আগে থেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

৫.  শারীরিক কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, বুক ধড়ফড় করা, পেটের ভেতরে খালি লাগা, মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া, ঘাম হয়, মাসল টেনশন বা পেশীতে টান হয়, আই কন্টাক্ট বা কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অসুবিধা হয়, কথা শুরু করতে অসুবিধা হয়।

চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, উদ্বেগের লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সোশ্যাল ফোবিয়ায় রোগীকে সাইকোথেরাপি, কাউন্সিলিং ও ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।

সাইকোথেরাপির অংশ হিসেবে কিছু বিহেভিয়ার থেরাপি দেওয়া হয়। সোশ্যাল এক্সপোজার দিতে হবে অর্থাৎ সামাজিক যে পরিস্থিতিগুলো রোগী এড়িয়ে চলতে চায় সেখানে বার বার নিয়ে যেতে হবে, সেগুলোর মুখোমুখি করতে হবে এবং ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করতে হবে।

কখনো কখনো উদ্বেগ দূর করার জন্য বিষণ্নতাবিরোধী ওষুধের প্রয়োজন হয়। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে রোগীর ভীতি এবং শারীরিক লক্ষণ অনেকাংশে কমে যায়।

সোশ্যাল ফোবিয়ার কারণে ভবিষ্যতে আক্রান্ত ব্যক্তির পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার হতে পারে। সামাজিক উদ্বেগের কারণে সে মুখ লুকিয়ে থাকবে, কারো সামনে যাবে না। ফলে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে উন্নতি হবে না এবং অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়বে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিমন্ডলে নিজেকে গুটিয়ে রাখার কারণে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। সোশ্যাল ফোবিয়া একজন মানুষকে সমাজ থেকে দূরে নিয়ে যায়। কারো ভেতর এই সমস্যা দেখা দিলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, বুলিং করা যাবে না। এই সমস্যাটিকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সোশ্যাল ফোবিয়া পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না, তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Workers, parties oppose handover of Ctg container terminal to foreign operator

Constructed at a cost of Tk 2,000 crore, the terminal was completed by the Chittagong Port Authority in 2007

41m ago