ফিচার

ই-বুক জনপ্রিয় হচ্ছে না কেন?

বিভিন্নভাবে চর্চা হয় সাহিত্য সংস্কৃতি। সময়ের পালাবদলে এর সঙ্গে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় স্মার্টফোনে বই পড়ার মাধ্যম ‘ই-বুক’ সেভাবে জয় করতে পারেনি পাঠকদের মন। গত কয়েক বছর ধরে ছাপা বইয়ের পাশাপাশি বই পড়ার অনেকগুলো মাধ্যম বাণিজ্যিকভাবে শুরু হলেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে এর কারণই বা কী থাকতে পারে? 

বিভিন্নভাবে চর্চা হয় সাহিত্য সংস্কৃতি। সময়ের পালাবদলে এর সঙ্গে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় স্মার্টফোনে বই পড়ার মাধ্যম হিসেবে আসে 'ই-বুক'। যুগ পেরিয়েও সেভাবে জয় করতে পারেনি পাঠকদের মন। গত কয়েক বছর ধরে ছাপা বইয়ের পাশাপাশি বই পড়ার অনেকগুলো মাধ্যম বাণিজ্যিকভাবে শুরু হলেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে এর কারণই বা কী থাকতে পারে? 

প্রযুক্তির দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা প্রযুক্তির উন্নয়ন- সবকিছুতেই প্রথম আলোচনায় আসে বইয়ের ভবিষ্যতের কথা। নতুন কোন প্রযুক্তি সামনে এলেই শোনা যায়, ছাপা বই আর টিকবে না। যেমন কিছুদিন আগে 'চ্যাট জিপিটি' নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসার পরপরই শোনা যাচ্ছিল, পৃথিবীতে লেখকদের কাজ ফুরিয়ে যাচ্ছে। কারণ এখন প্রযুক্তি নিজেই লিখে দেবে আস্ত এক বই। তাও মাত্র কয়েক মিনিটে! প্রযুক্তির এতো আগ্রাসনের পরেও বাংলাদেশে 'ই-বুক' জনপ্রিয় হচ্ছে না।

অমর একুশে বইমেলায় একাধিক ই-বুক প্ল্যাটফর্মের স্টল বরাদ্দ দেয়া হলেও, সেখানে দেখা যায়নি পাঠকের আনাগোনা। ই বুকের জন্য মেলায় আনাগোনা খুব সঙ্গতও না। তবু দেশে ই-বুক জনপ্রিয় না হবার কারণ খুঁজলে বাণিজ্যিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে। ই-বুক যেহেতু সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত, তাই পাঠকদের সঙ্গে সাহিত্যের যোগাযোগের অনুঘটকগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশে ই-বুকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের দিকে। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা ডয়েচে ভেলের একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, ২০১১ সালের দিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সহজ করতে পাঠ্যবইগুলোকে ইলেক্ট্রনিক রূপান্তর অর্থাৎ ই-বুক তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। www.ebook.gov.bd এই ওয়েবসাইটসহ সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল, সরকার ভবিষ্যতে সকল পাঠ্য-পুস্তক আর্কাইভ আকারে একই ওয়েবসাইটে নিয়ে আসবে। অথচ এই খবর প্রকাশের ১২ বছর পর লেখাটি প্রকাশের সময় ওয়েবসাইটটি কাজই করছে না। বেশ কয়েকবার বিভিন্ন ডিভাইস দিয়ে চেষ্টা করেও ওয়েবসাইটে প্রবেশ সম্ভব হয়নি।

সরকারি ই-বুক প্রকল্পে বেশ কয়েকবার আলাদা বরাদ্দ দেয়া এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রেণীগুলোর অনেক বই ই-বুকে রূপান্তরিত করা হলেও সঠিক স্থান থেকে সেগুলোকে ডাউনলোড করা বরং কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র ই-বুকের জন্য আলাদা একটি ওয়েবসাইট করা হলেও সেটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এছাড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইটে যেসব বইগুলো ই-বুক আকারে ছিল, সেগুলো বেশিরভাগই পাইরেসি হয়ে অন্যান্য ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে গেছে। এতে করে ই-বুকের দ্বারা ঠিক কত সংখ্যক শিক্ষার্থী লাভবান হচ্ছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সরকার চাইলেই সুরক্ষা বলয় শক্তিশালী করে অবৈধ পাইরেসি রুখে দিতে পারতো। 

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও পাঠ্যবইয়ের ই-বুক নিয়ে তেমন কোন প্রচারণা করা হয়নি। রাজধানীর বাইরে বেশিরভাগ স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা জানেই না, অনলাইনে তাদের বইগুলো ই-বুক আকারে পড়া যায়। যে কারণে সরকারের পাঠ্যবইয়ের ই-বুক প্রকল্প অনেকাংশে বাস্তবায়ন করার পরও তেমন কাজে আসছে না।

ই-বুক জনপ্রিয় না হবার একটি বড় কারণ পাইরেসি সংস্কৃতি। কত কয়েক বছরে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো অবৈধভাবে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে রূপান্তর করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিকে দায়িত্বশীলরা ভ্রুক্ষেপ করেনি। এমনকি সরকারি বইয়ের পাইরেসিও ঠেকাতে পারেনি। 

খ্যাতিমান কবি-লেখক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব বই অবৈধভাবে পিডিএফ কিংবা ই-বুক আকারে প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা দুই শতাধিক বইয়ের অবৈধ ইলেকট্রিক রূপান্তর অনলাইনে ছড়িয়ে আছে। যে কেউ চাইলেই সেখান থেকে ডাউনলোড করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের কপিরাইট আইন অনুযায়ী লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর আগে কোনভাবেই তার বই অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু সেই আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউ।

অনলাইনে পাইরেসি ছড়িয়ে পরার কারণে ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলো বাধাগ্রস্থ হচ্ছে । এর মধ্যে অনলাইনে পাইরেসির 'ফ্রি পিডিএফ' ডাউনলোড করে পড়ার কারণে পাঠকদের মধ্যে পাইরেসি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তাই ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রথম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, মানুষকে এটা বোঝানো যে, অনলাইনে ফ্রি তে পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়া অবৈধ। এবং এতে করে লেখক-প্রকাশকসহ পুরো বই শিল্প বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে।

অন্যদিকে বই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিতে নিজেরাই অবৈধ পথে পা বাড়াচ্ছেন। জনপ্রিয় বইগুলো পাইরেসি করে অনলাইনে ছড়িয়ে প্রকাশনীকে বাণিজ্যিকভাবে পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে অনেকেই। অথচ এই ব্যাপারে কখনই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, পাঠকেরা এই অবৈধ বইগুলোও সাদরে গ্রহণ করছেন।

কিন্তু বাংলাদেশে যেসব প্ল্যাটফর্ম ই-বুক নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের ওয়েবসাইট ও কাজ বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসবে অন্য কারণ। বেশিরভাগ ই-বুক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জড়িত মানুষেরাই বই সম্পর্কে ধারণা রাখেন কিনা তা নিয়েও দ্বিধা তৈরি হয়। কারণ ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোর ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপ ঘুরলে দেখা যায়, পাঠকের চাহিদা কিংবা সাহিত্যের মানের হিসেবে- কোনভাবেই পর্যাপ্ত রুচিশীল বইয়ের দেখা পাওয়া যায় না। 

পাঠকের রুচি, পাঠাভ্যাস বিষয়ে কোন ধরণের বাণিজ্যিক গবেষণাও নেই তাদের। সদ্য শেষ হওয়া অমর একুশে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পেয়েছিল বেশ কিছু ই-বুক প্ল্যাটফর্ম। তাদের কাউকেই বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে পাঠকের চাহিদা কোনগুলোতে বেশি- সে সম্পর্কে কোন কাজই করতে দেখা যায়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বেশিরভাগ প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কর্ণধাররা জানেনই না ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোতে সহজেই বই দেয়া যায়। অথচ হবার কথা ছিল উল্টো। 

তবে ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোর দাবি এক্ষেত্রে ভিন্ন। তাদের দাবি লেখকরা নতুন বইগুলো ই-বুক করতে দিতে চান না। নতুন বই ই-বুকে গেলে মুদ্রিত বই পাঠকরা কিনবে না বলে লেখকদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। যদিও ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোর দাবি, লেখকদের এই ধারণা অমূলক। ই-বুক আকারে বই বের হলে মুদ্রিত বইয়ের উপর নেতিবাচক কোন প্রভাব পরে না- এরকম বার্তা তারা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বহুদিন ধরে। তাদের আরও দাবি, প্রকাশকদের এক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।

ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোর এই দাবিগুলোরও সত্যতা পাওয়া যায় তাদের কাছে থাকা বইগুলোর তালিকা দেখে। বেশিরভাগই কয়েক বছর আগে প্রকাশিত বইগুলো ই-বুক হিসেবে রাখছে। খুব কম লেখকই নতুন বই কিংবা শুধুমাত্র ই-বুকে প্রকাশ করার জন্য বই দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান। এতে করে বছরের পর বছর থেকেও ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভালো বইয়ের অভাব থেকেই যাচ্ছে। 

এই প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ পাওয়া বইগুলোর দামের ব্যাপারে কোন নীতিমালা অনুসরণ করা হয় কিনা সে ব্যাপারেও কোন তথ্য জানা যায় না। কারণ মুদ্রিত বইয়ের ক্ষেত্রে কাগজ, বাধাই ইত্যাদির সঙ্গে বইয়ের দাম নির্ধারিত হলেও, ই-বুকের ক্ষেত্রে কীভাবে দাম নির্ধারণ হচ্ছে তার কোন স্বচ্ছ নীতিমালা নেই। যেটি ভবিষ্যতের ই-বুক শিল্প তৈরিতে কাঠামোগত একটি খুঁত হিসেবে থেকে যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে প্রকাশিত ই-বুকগুলোর মূল্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, দামের তারতম্য খুব একটা হয়নি। স্বাভাবিক গতিতে ই-বুকের দাম কিছুটা বেড়েছেও। মুদ্রিত বইয়ের তুলনায় দাম অনেকটা কম ধরা হয় বলে ই-বুকের দাম বাড়ছে কিনা তা বোঝা যায় না। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ই-বুক প্রকাশ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ই-বুক থেকে আয়কে করমুক্ত ঘোষণা করেছিল অর্থমন্ত্রী।

সেসময় প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর একটি খবরে বলা হয়, 'কাগুজে বই পড়ার আগ্রহ মানুষের মধ্যে দিন দিন কমছে। তার বিপরীতে এখন সবাই মোবাইল ফোনে বা অন্য কোনো ডিভাইসে ইলেকট্রনিক ফরমেটে বই পড়তে চান। তাই ই-বুক পাবলিকেশন সেবা থেকে আয়কে করমুক্ত ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মানে, কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রকাশনা সংস্থা ই-বুক পাবলিকেশন সেবা চালু করলে যে আয় করবে, তা করমুক্ত থাকবে। অবশ্য ই-বুক সেবা নিলে গ্রাহককে টাকা দিতে হয়। করমুক্ত করার ফলে এই সেবার দামও কমতে পারে'।

ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলোতে বই প্রকাশের পুরো পদ্ধতির মধ্যে প্রচ্ছদ, বানান শুদ্ধিকরণ ও কারিগরি বিষয় থাকলেও ঠিক কোন মানগুলো উতরে গেলে বই প্রকাশ হবে, এরকম কোন অভ্যন্তরীণ নীতিমালাও পাওয়া যায় না। যে কারণে প্রকাশিত ই-বুকগুলোর ব্যাপারে পাঠকদের আগ্রহ কম।

স্বাভাবিকভাবেই পাঠকদের কাছে ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলো শুধুই চাকচিক্য ও রঙিন বইয়ের শোকেজ বলে গণ্য হচ্ছে। পাঠকদের রুচি অনুযায়ী সেখানে পর্যাপ্ত বই তো নেই; বরং সম্পাদনাহীন বইগুলো পাঠকদের অবচেতন মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। এছাড়া কিছু ই-বুক প্ল্যাটফর্ম শুধু একটি বিশেষ ঘরনার বই যেমন থ্রিলার জনরা কিংবা শুধু ভৌতিক উপন্যাস ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। সবমিলিয়ে সাহিত্য চর্চায় ই-বুক কোনো ধরণের পরিকল্পনা ছাড়া অবকাঠামাগতভাবে শুধু বাড়ছে। 

Comments