পর্যালোচনা

দস্তইয়েফ্স্কি মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার বিশেষ স্মারক

আমাদের বিশ্বাসকে অমূলক ও অসার প্রমাণ করে অসাধ্য এক কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন মশিউল আলম। প্রকাশ করেছেন পত্রিকাটির দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা। 

'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট', 'ইডিয়ট', 'দ্য পজেসড বা ডেমনস', 'ব্রাদার্স কারামাজভ', 'নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড'র মতো উপন্যাসের রচয়িতা দস্তইয়েফ্স্কি রুশ সাহিত্যের অন্যান্য লেখকের তুলনায় প্রভাবশালী ও মানবদরদী হওয়ার পরও কেন একটু দূরের-কিছুটা আড়ালের থেকে গেলেন আমাদের কাছে? কেন অন্যদের মতো বহুল পঠিত-চর্চিত হলেন না? মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা এসব প্রশ্নকে যেমন হাজির করেছে-তেমনি বাতলে দিয়েছে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের পথ। 

কথাসাহিত্যিক,সাংবাদিক, অনুবাদক মশিউল আলম সম্পাদিত এই সাময়িকী খুলে দিয়েছে দস্তইয়েফ্স্কিকে চেনা-জানা ও বোঝার জানালা। উন্মোচন করেছে উনার বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা, পাঠ ও প্রভাবের সমূহ দিক। দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার বিশেষ স্মারক। যা আমাদের সাহিত্য ভুবনে এবং বুদ্ধিজীবীতায় সংযোজন করেছে নতুন ভাবনার খোরাক, বিশেষ এক বারতা।

দস্তইয়েফ্স্কির প্রতিটি লেখা সাহিত্যগুণে যেমন স্বাদু, চিন্তাশীলতায় তেমনি নতুন দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। মানুষের পক্ষে উনার অবস্থান-প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ছিল বিস্ময় জাগানিয়া। সৃজনে-মননে অপ্রতিদ্বন্ধি  এই প্রতিভার ব্যক্তি জীবনও ছিল অবিশ্বাস্য রকমের বন্ধুর ও সমস্যা-সংকুল। ঘটনাচক্রে মৃত্যু হয়ে উঠে অলঙ্ঘনীয় এক নিয়তি। আবার সেই নিয়তিই উনাকে মৃত্যু থেকে কয়েক সেকেন্ড দূরে থাকা অবস্থায় বাঁচিয়ে দেয়। চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এই রাতে বড়ভাই মিখাইলকে একটা চিঠি লেখেন। যার অংশবিশেষ এরকম, 'ভাইয়া, আমি কষ্ট পাইনি, হতাশ হইনি; জীবন তো সবখানেই জীবন; জীবন আমাদের মধ্যেই, বাইরে নয়। 

আমার সঙ্গে তো আরও মানুষে থাকবে; মানুষের মধ্যে তাদের একজন হয়ে থাকা, সব সময় মানুষের সঙ্গে থাকা, দুঃখকষ্টে ভেঙে না পড়া, হতাশ না হওয়া-এটাইতো জীবন, জীবনের কর্তব্য তো এটাই।' এই বোধ দস্তইয়েফ্স্কির লেখালেখির ভুবনে কীভাবে প্রভাবক হয়ে উঠল এবং উনাকে বিশ্বসাহিত্যের বিরলতম প্রতিভাধর লেখকদের একজনে পরিগণিত করল, তাও বোধ করি বিলোড়িত হওয়ার মতই ঘটনা বিশেষ। যা সবিস্তারে ও বিবিধমাত্রায় অবহিত হওয়ার অভূতপূর্ব ও অভাবিত এক সুযোগ হাজির করেছে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা দস্তইয়েফ্স্কি বিশেষ সংখ্যা।

প্রসঙ্গত, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা আমাদের সাময়িক পত্রের কিংবা ছোট কাগজের (লিটিল ম্যাগাজিন) আন্দোলনের ইতিহাসে যুগান্তকারী এক ঘটনা, নবতরঙ্গ বিশেষ। ঠিক ছোটকাগজ বলতে আমরা যা ‍বুঝি। ছোট কাগজের ধারণা বা অবয়ব আমাদের ভেতরে দীর্ঘ সময় ধরে যেভাবে ও যে অর্থে গ্রথিত, তার সঙ্গে এই সাময়িকী ঠিক যায় না। মীজানুর রহমান ছোট কাগজের ধারণায় সঞ্চারিত করেন নতুন এক চিন্তা, চারিয়ে দেন প্রাতিস্বিক এক আন্দোলন।

আমরা ধরেই নিয়েছিলাম উনার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ছোট কাগজটিরও সমাপ্তিরেখা টানা হবে। কেননা, এখানে এমনটাই হয়। ব্যতিক্রম কোন উদাহরণও এক্ষেত্রে স্মরণে আনা দুরূহ। এ কারণে আমরা উদ্বেগ বা শঙ্কা নয়, সরাসরি এই বিশ্বাসই জারি রেখেছিলাম যে, মীজানুর রহমান নেই তো, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকাও নেই। আমাদের বিশ্বাসকে অমূলক ও অসার প্রমাণ করে অসাধ্য এক কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন মশিউল আলম। প্রকাশ করেছেন পত্রিকাটির দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা। 

মীজানুর  রহমান জীবদ্দশায় একাধিক বিষয় ও ব্যক্তিকে নিয়ে সংখ্যা করে কেবল চমৎকৃত করেননি, আমাদের চেনা-জানার পরিধিকে বিস্তৃত করেছেন, অভাবিত আলোয় রাঙিয়েছেন ভাবনা ও চিন্তার জগতকে। এখনও  পুরাতন বইয়ের দোকানে বিষয়ভিত্তিক ও ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে সংখ্যার খোঁজে আগ্রহী পাঠক-গবেষক ঢুঁ মারেন মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাগুলোর খোঁজে। কারণ, সে সব সংখ্যার লেখার বিষয় ও লেখক তালিকা এতটাই ঋদ্ধ ও ঈর্ষণীয় যে তার পাঠ উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা জারি রেখেছে সময় নিরপেক্ষ এক আবেদন। 'মীজানুর রহমান কে?' শিরোনামের স্মরণ-শ্রদ্ধার্ঘের এ লেখায় মশিউল আলম জানান, '১৯৮৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন) মীজানুর রহমান তার ত্রৈমাসিক পত্রিকার যে ৮০টি খণ্ড সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, শুধু সে-জন্যেই তাকে ভালবাসা যায়। 

সৃজনশীলতা, মননশীলতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা, জ্ঞানের ও সুরুচির যে-চর্চা যে তিনি করে গেছেন, সে জন্য তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত, মনে রাখা উচিত। তিন মাস পর পর ছ-সাত ফর্মার নিয়মিত সংখ্যাগুলো ছাড়া তিনি ঢাউস আকারের যে বিশেষ সংখ্যাগুলো সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর জন্য তাকে আমাদের সালাম জানানো উচিত। শুধু পাখি নিয়ে ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা, পক্ষী সংখ্যা। এরকম আরও অনেক : বৃক্ষ সংখ্যা, নদী সংখ্যা, আবার বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যা, এবং বিস্ময় মানবেন প্রিয় পাঠক, দুই খণ্ড মিলিয়ে প্রায় ১৪০০ পৃষ্ঠার গণিত সংখ্যা তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। শিল্পী রশীদ চৌধুরী, পটুয়া কামরুল হাসান, কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যাগুলোর কথাই বা কেন বলব না।''

মীজানুর  রহমান জীবদ্দশায় একাধিক বিষয় ও ব্যক্তিকে নিয়ে সংখ্যা করে কেবল চমৎকৃত করেননি, আমাদের চেনা-জানার পরিধিকে বিস্তৃত করেছেন, অভাবিত আলোয় রাঙিয়েছেন ভাবনা ও চিন্তার জগতকে।

এসব বিবেচনায় এবং যথাযথ মূল্যায়ন ও বিচারের নিরিখে মীজানুর রহমানের অবর্তমানে নতুন সংখ্যা প্রকাশ বাস্তবিকই মস্তোবড় চ্যালেঞ্জের। চ্যালেঞ্জ এই কারণে যে, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা বলতে পাঠকচিত্তে যে সমৃদ্ধ এক সাময়িকী জারি রয়েছে, তা পূরণ করা কেবল কষ্টসাধ্য নয়-দুরূহও বটে। মীজানুর রহমান ছিলেন ধ্যানযোগী মানুষ। শামসুর রাহমান উনাকে বলেছিলেন সম্পাদকদের সম্পাদক।

'আলোকের অভিযাত্রী' শিরোনামের লেখায় আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ''শুধু ভাবা নয়, সেই ভাবনাকে বাস্তবে রূপদানের ক্ষেত্রেও মীজানুর রহমান একক, প্রায় নিঃসঙ্গই বলা চলে। নিজেই লেখা সংগ্রহ করেছেন, বিজ্ঞাপন জোগাড় করেছেন, কাগজ কিনতে গেছেন, প্রেসে ছুটেছেন, প্রুফ দেখেছেন। চোখের দুর্বলতা অনেকদিনের, চশমায় কুলোয় নি, ম্যাগনিফাইয় গ্লাস দিয়ে প্রুফ দেখতে হতো। মীজানুর রহমান তাতেও পিছপা নন; একবার, দুবার, তিনবার প্রুফ দেখেছেন, যতক্ষণ না মনে হয়েছে নির্ভুল হয়েছে, ততক্ষণ থামেন নি। তারপরও, ছাপার পরে, যদি দু-একটা ভুল চোখে পড়ত, তাঁর আফসোসের সীমা থাকত না।''

মীজানর রহমানের কর্মযোগ বিশেষমাত্রা পেয়েছিল সাধনার পরশে, যা সকলের থাকে না। এই সাধনা গুণেই তিনি বাধাকে ডিঙ্গোতে পেরেছিলেন, দুর্মুখদের ঈর্ষাকে পরাভূত করেছিলেন। পত্রিকার নাম নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। যদিও এরকম নামকরণ পাশ্চাত্যে এবং বাংলাভাষায় নতুন নয়। রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকার কথা কারোরই অজানা নয়। তবুও বিদ্রুপবানে বিদ্ধ হয়েছেন। আত্ম অহঙ্কারীর তকমা পেয়েছেন। সেসবের জবাব না দিয়ে, একের পর এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের যে নজির রেখেছেন তা বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে অভাবনীয় এক ঘটনা।

আমাদের জন্য শ্লাঘার বিষয় হল, উনার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে 'মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা'র যবনিকাপাত ঘটেনি। হাল ধরেছেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম। মীজানুর রহমান মারা যাওয়ার পর তিনি অবশ্য উনাকে নিয়ে একটা স্মরণসংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। মীজানুর রহমানের অবর্তমানে মশিউল যে একাজের যোগ্য ও যথার্থ উত্তরসূরি তার সাক্ষ্য মেলে সহধর্মিণী নূরজাহান বকশি'র এক লেখায়।

তিনি বলেন, ''তাঁর অবর্তমানে এই পত্রিকা তার স্মৃতি বহন করে চলবে, সময় সুযোগ পেলে তিনি হয়তো এমন কথা আমাকে জানিয়ে রাখতেন। অবশ্য একটা সুবিধা তিনি করে দিয়ে গেছেন। একবার যখন তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন তিনি অতিথি সম্পাদক হিসেবে ডাকলেন তাঁর স্নেহভাজন গল্পকার ও সাংবাদিক মশিউল আলমকে। অবশ্য সে-বার মশিউলের সহযোগিতা তেমন নিতে হয়নি, কারণ অচিরেই তিনি ফের সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু মডিউলকে একবার ডেকেই তিনি এই ইশারা দিয়ে রাখলেন যে, তাঁর এই কাজ এই যুবক চালিয়ে নিতে পারবে। সুশীল পাঠক, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার নতুন সম্পাদক হিসেবে মশিউল আলমকে দায়িত্ব দেওয়ার ভরসা পাচ্ছি সেই কারণেই।''

মীজানুর রহমান সংখ্যার পর দীর্ঘবিরতি পড়লেও দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা প্রকাশ করে মশিউল সেই ভরসাকে যথাযথ সম্মান ও মান্যতা দিয়েছেন বলেই প্রতীয়মান হয়।

দস্তইয়েফ্স্কি রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন। অনুবাদের কল্যাণে তিনি বিশ্বসাহিত্যেও নন্দিত ও বন্দিত। কিন্তু ঠিক জনপ্রিয় লেখক বলতে যা বোঝায় তিনি তেমনটা নন। বাংলা ভাষায় তিনি অপরিচিত নন। উনার তুলনায় রুশ সাহিত্যের আরও কয়েকজন লেখক এখানে বেশি পরিচিত-পঠিত-আদৃত। এর কারণ কী হতে পারে-
এক. দস্তইয়েফস্কির মতো লেখককে গ্রহণ করতে যে ধরণের পাঠ প্রস্তুতির প্রয়োজন লাগে, আমাদের তার ঘাটতি রয়েছে?
দুই. দস্তইয়েফস্কি বিশেষ কোন মতবাদ বা আদর্শিক চিন্তার ঘেরাটোপে বন্দি নয় বলে উনাকে ইচ্ছাকৃতভাবেই উপেক্ষা করা হয়েছে?

এই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করা প্রয়োজন। তাতে আমাদের পাঠ প্রবণতা ও বিশ্বসাহিত্য চর্চার একটা চিত্র উন্মোচন করা সম্ভব হবে। অবশ্য আশাবাদের জায়গা হল, দস্তইয়েফ্স্কির সঙ্গে দূরত্ব মোচনের একটা সুযোগে সৃষ্টি হয়-উনার জন্মের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে। উল্লেখ্য, ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তইয়েফস্কি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১১ নভেম্বর) মস্কোর মারিনস্কায়া হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। ইহাজগাতিক সময় মাত্র ৬০ বছরের, ১৮৮১ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি মারা যান। 

২০২১-এ মশিউল আলম সিদ্ধান্ত নেন দস্তিইয়েফস্কির জন্মশতবর্ষ স্মরণে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার একটা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবেন। সময় লাগলেও অবশেষে পত্রিকাটা প্রকাশিত হয়েছে ২০২৪ এর এপ্রিলে। ঢাউস সাইজের এই বিশেষ সংখ্যা গুনে-মানেও অনন্য । কিন্তু তিন বছর কেন সময় লাগল এমন প্রশ্নে মশিউলের জবাব, লেখা সংগ্রহ এবং আরও কিছু কাজ-এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু প্রসঙ্গ যুক্ত হওয়ায় সংখ্যাটা প্রকাশে বিলম্ব হয়েছে। দস্তইয়েফস্কিকে নিয়ে এরকম একটা সংখ্যা প্রকাশ হয়েছে এতে আমরা শ্লাঘা ও পুলক বোধ করছি। এর আগে কলকাতা থেকে এই লেখককে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হলেও (এবং মুসায়েরা'র দস্তয়েভস্কি সংখ্যাটার কথা স্মরণ করা যেতে পারে) ঢাকা থেকে এই প্রয়াস প্রথমবারের মতো।

মশিউলের দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যার লেখক তালিকা বেশ দীর্ঘ। এতে স্পষ্ট যে পূর্বসূরি মীজানুর রহমানের কর্মযোগ ও ধ্যানযোগের দুটোই উত্তরসূরি হিসেবে আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং কাজে তার প্রমাণ রেখেছেন। উল্লেখ্য, দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা এমন একটা সময়ে বাজারে এসেছে, যখন বাজারে ঈদসংখ্যার ছড়াছড়ি। এর ভিড়েও এই সাময়িকপত্রটি বিশেষ মনোযোগ কেড়েছে এবং পাঠক-লেখক-গবেষক মহলে বাড়তি আকর্ষণের জন্ম দিয়েছে। এ ব্যাপারে মশিউলের মত হল, এমন সাহিত্যঘটনা দেশে আর হয়নি।

দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যার সূচিপত্র কয়েকটি বিষয়ে বিন্যাস্ত করা হয়েছে। এগুলো হল- এক. সামগ্রিক মূল্যায়ন; দুই. জীবন ও নিয়তি; তিন. বাংলার চোখে; চার. বিচার ও বিশ্লেষণ; পাঁচ. আপন ভুবন। এখানে বাংলার চোখে ১৯ জন লেখকের ১৯টা লেখা রয়েছে। সংখ্যাটার এই লেখাকটিই এক অর্থে মৌলিক লেখা। বাকী লেখাগুলোর সবগুলোই অনূদিত। তবে মূল লেখকেরা যেমন কীর্তিমান, বিষয়বস্তুও তেমনই লেখক-দার্শনিক-সাংবাদিক দস্তইয়েফ্স্কিকে বোঝার জন্য সবিশেষ গুরুত্ববহ।

লিখেছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডসহ তিনজন নোবেলজয়ীও। নির্বাচিত লেখকেরা প্রত্যেকেই দস্তইয়েফ্স্কিকে উন্মোচন করেছেন নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, যা অর্থবহ ও ভীষণভাবে চিন্তাজাগানিয়া। এসব লেখা দেখে বোঝা যায়, সম্পাদক হিসেবে মশিউল কেন তিন বছর সময় নিয়েছেন। ওঁর ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি প্রতিটি লেখা তিনি রুশ ও ইংরেজি থেকে সরাসরি সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলো অনুবাদ করানোর কাজটিও করেছেন। আমরা সম্পাদকের এই গুণের তারিফ করি।  

দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা পাঠান্তে মনে হয়, মৌলিক লেখাগুলোর প্রতি সম্পাদকের দৃষ্টি কি অপ্রতুল ছিল? অন্য সব লেখার ঔজস্বিতাকে আমলে নিয়ে এখানে কি আরও বেশি চিন্তাশীল ও চিত্তাকর্ষক লেখা সংগ্রহ করায় যুক্তিযুক্ত ছিল।

প্রায় একহাজার পৃষ্ঠার একটা সাময়িকীতে কিছু ত্রুটি অস্বাভাবিক নয়। জীবনপঞ্জির বিন্যাসে সন তারিখের ভূলটা পীড়াদায়ক। আবার সূচীতে লাদিস্লাভ কোভাচের লেখার শিরোনাম, 'দুই যমজ : ডারউইন ও দস্তইয়েফ্স্কি'তে যমজ হয়ে আছে 'যজম'। সংখ্যাটার বাঁধাই, কাটিংয়েও তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্টত, যা ভীষণরকমের অস্বস্তির। এগুলো বড় কোন বিষয় নয়, কিন্তু বড় বিষয়কে বিরক্তি করার জন্য যথেষ্ট।

উইকিপিডিয়ায় লেখা আছে দস্তইয়েভ্স্কি । বাংলা ভাষায় দীর্ঘদিন ধরে তিনি দস্তয়েভস্কি বলে পরিচিত। ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'এবং মুসায়েরা'র বিশেষ সংখ্যায়ও 'দস্তয়েভস্কি' লেখা হয়েছে। মশিউল কেন দস্তইয়েফ্স্কি লিখলেন সম্পাদকীয়তে সেটা পরিষ্কার করা দরকার ছিল কি? এবং মুসায়েরা'র সংখ্যায় অনেকগুলো মৌলিক লেখার উপস্থিতি রয়েছে। বিষয়ও সুনির্দিষ্ট ও সুনির্বাচিত। দস্তইয়েফ্স্কির লেখালেখির শক্তি ও উজানে চিন্তা বুঝতে যা ভীষণভাবে সহায়ক। সেখান থেকে 'বাংলার চোখে' অধ্যায়ে শুধু বুদ্ধদেব বসুর লেখাটা নেয়া হয়েছে। অন্যগুলোর কথা না হয় বাদ দিলাম, মোবাশ্বের আলীরটা কেন নেয়া হল না, যুক্তিটাইবা কি, ঠিক বোঝা গেল না।

বাংলাপিডিয়ায় মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পর্কে মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম লিখেছেন, 'তার (মীজানুর রহমান) মৃত্যুর কিছুকাল পর তাঁর স্বপ্নের পত্রিকাটিরও মৃত্যু ঘটে।' সাইফুল হয়তো মীজানুর রহমান সংখ্যাটাকে ধর্তব্য জ্ঞান করেন নি। যেটা মশিউল আলমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় উনার মৃত্যুর পরের বছর ২০০৭-এ। দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা প্রকাশের পর বাংলাপিডিয়া কর্তৃপক্ষ এবার নিশ্চয় সংশোধনী দেবেন। উল্লেখ্য, বাংলাপিডিয়ায় অবশ্য মীজানুর রহমানের মৃত্যুর সন ভুল দেয়া রয়েছে। এত বছরেও এসব সংশোধন না হওয়া কেবল পীড়াদায়ক নয়, লজ্জারও বটে। সেখানে উল্লেখিত হয়েছে, মৃত্যু : ১৯৯৬। প্রকৃতপক্ষে যা হবে ২০০৬।

'মীজানুর রহমান বন্ধুবরেষু' কবিতায় শামসুর রাহমান লিখেছেন, 'মীজান, নিশ্চিত জেনো সময়ের প্রান্তরে তোমার/কীর্তি অত্যুজ্জ্বল নিশানের মতো উড়বে নিয়ত। আমাদের/সবার অভিবাদন অকুণ্ঠ গ্রহণ করো আজ যে-সুন্দর/শত বাধা উজিয়ে করেছে সৃষ্টি কাল-পটে ঋদ্ধ সমবায়ে।' কবিতায় উচ্চারিত এই অমেয় বচন যে সদর্থক অর্থেই সত্য ও ঋজু এক বাস্তবতা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মীজানুর রহমানের ব্যতিক্রমীতা এখানে যে তিনি কেবল কর্মযোগী-ধ্যানযোগী নন, জহুরী চেনার ক্ষেত্রেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক মনীষা। মশিউল আলমকে উত্তরসূরি বেছে নেয়ার মধ্যে দিয়ে যে সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে।

মশিউল, মীজানুর রহমান সংখ্যার ''সম্পাদকের 'কড়চা' নয়'' শিরোনামে লিখেছিলেন, 'বনানীতে শুয়ে শুয়ে মীজানুর রহমান এতদিন ধরে আমার আকর্মণ্যতা দেখে কী ভাবছেন জানি না। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে গভীর রাতে। পত্রিকা হাতে নিয়ে আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াব, দু'হাত বাড়িয়ে বলব, কাকা, এই যে! আমি জানি, পত্রিকাসমেত তিনি আমাকেও বুকে জড়িয়ে ধরবেন।'

দস্তইয়েফ্স্কি সংখ্যা প্রকাশের পর নিশ্চয় গুরু-শিষ্যের মোলাকাত হয়েছে। মীজানুর রহমান নিশ্চয় খুশি হয়েছেন তার স্বপ্নের মৃত্যু হয়নি বলে। মশিউল আমাদের জানাচ্ছেন আগামীতে তিনি চেখভ সংখ্যা, কাফকা সংখ্যা, তলস্তয় সংখ্যা, মার্কেজ সংখ্যা করতে চান। এই ইচ্ছের কথা নিশ্চয় মীজানুর রহমানকেও জানিয়েছেন তিনি, গভীর রাতে-কাকা সান্নিধ্যের অবকাশে। ঊষর এই সময়ে এসব স্বপ্ন, বুদ্ধিবৃত্তিক আশাবাদ আমাদেরকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়, আমরা নতুন প্রত্যাশার জানালা খুঁজে পাই, দিগন্তকে দেখি। যেমন করে এখন দেখছি মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার দস্তইয়েফ্স্কি বিশেষ সংখ্যার কালো হরফে।

'দস্তইয়েফ্স্কি' বানান মশিউল আলম সম্পাদিত সাময়িকীকে অনুসরণ করা হয়েছে।

Comments