শ্রদ্ধা

তুলনাহীন এক উদাহরণ শামীম সিকদার 

মানুষ মাত্রই মেরুদণ্ড নিয়েই পৃথিবীতে আসে। এই মেরুদণ্ড পাওয়ার জন্য কোনো কোশেশ করতে হয় না। শ্রম, নিষ্ঠা, প্রতিভা কিংবা ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা কোনটাই লাগে না। কেননা, রাজা-প্রজা-ভৃত্য, ধনী-গরীব, এমনকি বদ্ধ উন্মাদ যে তিনিও জন্মসূত্রে একটা মেরুদণ্ড নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। এর জন্য গর্ব ও গৌরবের কিছু নেই, নেই কোনপ্রকার বাহাদুরি। কিন্তু প্রদর্শনযোগ্য মেরুদণ্ডের জন্য লাগে সাধনা ও সাহস। শামীম সিকদারের ছিল সেই প্রদর্শনযোগ্য মেরুদণ্ড। যা দেখা যেত, দেখেছেনও সবাই।

সমকালে শামীম সিকদার কেবল বিরল ব্যতিক্রম নন, ছিলেন তুলনাহীন এক উদাহরণ। শিল্প ও শিল্পীর যাপিত জীবনকে তিনি দিয়ে গেছেন নিজস্বতা।  অনুসন্ধান করেছেন নতুন এক ভাষা, যা একান্তই উনার। সেই ভাষায় কথা বলেছেন, সৃজন করেছেন, যাপনে মেতেছেন উজানে হাঁটা এক জীবন। এ কারণে উনার সৃজন ও উদযাপিত জীবন ছিল সকলের থেকে আলাদা। নিঃসঙ্গ, কিন্তু নন্দিত। শিল্পীর সাধনা যে কেবলই নিঃসঙ্গতা ও নৈঃশব্দের গভীরে প্রবেশের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। শামীম সিকদার সেটা প্রমাণ করে গেছেন জীবনের ঝাণ্ডায়, শিল্পের বহুধা বিস্তৃত সৃজন তরঙ্গে।

নাম দিয়েই শুরু করা যাক। শামীম নামটা কিছুদিন আগে পর্যন্ত তো বটেই এখনও যে কারও কাছে শুনলেই পুরুষবাচক বলে মনে হয়। এবং সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত বলে বিবেচিত ছিল বাংলা ভাষার ব্যাকরণে। শিক্ষার্থীদের লিঙ্গান্তর শেখানোও হয় যেমন মহাশয়-মহাশয়া, তেমনই শামীম-শামীমা। শামীম সিকদার প্রচলিত ও বহুল চর্চিত সেই স্ত্রীবাচকতায় নিজের নাম হাজির করে দিয়েছেন জোর একটা চপেটাঘাত। ভাষা যে নানাভাবে খোলতাই হতে পারে। ব্যাকরণকেও যে প্রচলিত সংজ্ঞা ও আঙ্গিকের বাইরে দৃষ্টি জারি রাখতে হয়ে তার রসদ যুগিয়েছেন তিনি।

শামীমের চলাফেরা চেনা কোন রীতি বা রেওয়াজে সীমাবদ্ধ ছিল না। পুতপুতে, চিরকেলে কোন ধারণায় কোনদিনই রাখেননি কোনপ্রকার আস্থা। নিজেই ধারণা বা স্টাইলের জন্ম দিয়েছেন। এবং আপাদমস্তকে মগ্ন থেকেছেন সেসবেই। তার পোশাক ছিল একান্তই তার মতো। গড়পড়তা কোন নারীর সঙ্গে ছিল না কোনপ্রকার সাদৃশ্য। কেবলই কি নারী, নারী-পুরুষ কারও সঙ্গেই মেলানো যেত না উনাকে। অবশ্য শামীম তো গড়পড়তা মানুষও ছিলেন না। কিন্তু এদেশে যারা ঝাঁকের কৈ নন, তাদেরকেও যে খুব বেশি আলাদা করে চেনা যায়, তা কিন্তু নয়। স্ফুলিঙ্গের মতো আবির্ভূত হয়ে আবার হাওয়ায় মিশে যান। ঝাঁকের কৈ-য়ে না থাকলেও ঝাঁকের কৈ-য়ের পড়শি ব'নে যান। তখন তিনি সাধারণ, নাকি অসাধারণ; শিল্পী নাকি সুবিধাবাদী-সুযোগসন্ধানী; কবি লেখক সাহিত্য সম্পাদক নাকি পদ পদবী উপঢৌকন আর বিদেশভ্রমণ প্রত্যাশী বিটকেলে এক ধান্দাবাজ তা ঠাহর করা মুস্কিল হয়ে যায়। সমকালের এই চেনা বাস্তবতার মধ্যেও শামীমকে চেনা গেছে, শামীমের মতো করে।

এই রাজধানী ঢাকায় টিপ পরাকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড হয়। এ দেশে জিনসের প্যান্ট পরার জন্য নারীকে অপমানিত নয় কেবল হতে হয় লাঞ্ছিত। এবং যারা এসব দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে তাদের ভূমিকা নিয়ে দ্বিধান্বিত হতে হয় তখন শামীম সবকিছুকে থোড়াই কেয়ার করে যাপন করে গেছেন অনুকরণীয় এক শিল্পীর জীবন। ওড়না ধরে যুবকে টান দেয়ায় ছেড়েছেন ওড়না পরা। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে উনার শাড়ি পরা একটা ছবি দেখে আমাদের বেগ পেতে হয় এই ভেবে যে, সত্যিই উনি শামীম সিকদার তো! কারণ শামীম সিকদার মানেই তো জিনসের শার্টে প্যান্টে, টি শার্টে আর ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটে বেশ মানিয়ে যাওয়া যুতসই এক ভাস্কর্য।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে শামীম সিকদার। ছবি: সংগৃহীত

এখানে নভেরা ছাড়া আর কে আছেন যিনি ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে কিংবদন্তী হয়ে উঠতে পেরেছেন। দুজনেই ভাস্কর। কিন্তু শিল্পের পথ ছিল আলাদা। খ্যাতির শীর্ষ ছুঁয়েছিলেন উনারা। নভেরার আরও অনেক কিছুর দেয়ার ছিল, দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে না পেয়েই হয়তো দেশ ছেড়েছেন অভিমানে। যে দেশ শিল্পীর অভিমান বুঝতে পারে না, অভিমানের মর্যাদা দিতে জানে না, সেই দেশে উন্নততর শিল্পের বিকাশ কীভাবে সম্ভব? নভেরার কাজগুলোর সামনে দাঁড়ালে এখনও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। গর্বে বুক ভরে যায়। আহা! এদেশেও এরকম প্রতিভাবান একজন শিল্পী জন্মেছিলেন।

শামীম সিকদার, নভেরা দুজনেই আলোচিত ছিলেন। দুজনকে নিয়েই উপন্যাস লেখা হয়েছে। দুজনেই মিথ বা কিংবদন্তীর চরিত্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। শামীম সিকদার বোধ করি বেশি আলোচিত ছিলেন। কেবল চলাফেরা আর পোশাক-আশাকের কারণে নয়। পকেটে পিস্তল ঝুলিয়ে রাখতেন বলে নয়। সবকিছুকে থোড়াই কেয়ার করে চলতেন বলে নয়। উনার সৃষ্টিমুখরতার কারণেও। শামীমের কাজগুলো ছিল বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। প্রতিকৃতির প্রতি ছিল দুর্বার আগ্রহ, পক্ষপাত ও দুর্বলতা। ইতিহাসকে ধরার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা ও ঝোঁক ছিল উনার । ইতিহাসকে কীভাবে ব্যক্তি, সমষ্টি, সমাজ, রাষ্ট্রের সঙ্গে গ্রন্থিত করতে হয় তার অনুপম উদাহরণ শামীমের অমর সৃষ্টি 'স্বোপার্জিত স্বাধীনতা' ভাস্কর্য।

নভেরা ভাস্কর্য শিল্পে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বা অ্যাবসার্ডিটির চর্চা করেছেন। কিন্তু উনার এই বিমূর্ত চেতনা বাস্তবতাবর্জিত ছিল না। মূর্ত ও বিমূর্তকে উনি সংহত রূপে উন্মীলন করেছেন। শিল্পের যে আলো আঁধারির দ্বৈরথ, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যের সহাবস্থান, তার দুঁদে প্রকাশ ঘটেছে নভেরার শিল্পকর্মে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের যে বহুমাত্রিক প্রকাশ ও জ্যামিতিক যোগসূত্রতার গল্প সেসব অন্বেষণ করা ছিল নভেরার বৈশিষ্ট্য ও বিশিষ্টতা। কিন্তু এই গল্পকেই তিনি যখন ভাস্কর্যে হাজির করতেন তখন তার প্রকাশ ঘটাতেন বিমূর্তরূপে। বিমূর্ততার ভাষায় মূর্তকে ধরার এই যে কোশেশ তাকে অন্যমাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন নভেরা।

শামীমের দৃষ্টি ছিল একেবারে অন্যরকম ও আলাদা ধরণের। শামীম ইতিহাস অন্বেষী ছিলেন। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময় চরিত্রসমূহকে তিনি হাজির করেছেন নানাভাবে। শামীম জানতেন নিজের জাতিকে-দেশকে যদি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হয়, তাহলে পরিভ্রমণ জারি রাখতে হবে ইতিহাস ও ঐতিহাসিকতায়। একটা দেশ ও জাতি তখনই জেগে উঠে যখন সে তার গর্ব ও অহংকারের জায়গা সমূহ চিহ্নিত করতে পারে। নিজেদের ভূগোল ও ভগবান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায়। এ কারণে শামীমের কাজে আমরা ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণগুলোকে যেমন খুঁজে পাই, তেমনি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ও দেশ-জাতির সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্বও হাজির হতে দেখি। বহুকৌণিক ও সর্বরৈখিকভাবে  সবকিছুকে দেখার প্রতি শামীমের এই দায়বোধ যে দেশপ্রেম থেকে জাগরিত তার সাক্ষ্য রয়েছে প্রতিটি ভাস্কর্য। শামীমের এই দেশেপ্রেম কি পরিবার থেকে উৎসারিত? ওর ভাই সিরাজ সিকদার ছিলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা ।

শামীম অবশ্য শিল্পকে ব্যক্তি বা পরিবারের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেননি। এক্ষেত্রে ব্রেখটের যে এলিয়েনেশন থিয়োরি বা বিচ্ছিন্নকরণ তত্ত্ব তার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন শিল্প সৃজনে। মহৎ শিল্পের জন্য যার প্রয়োজন সর্বাগ্রে এবং সর্বৈবভাবে।

মহৎ শিল্পের স্রষ্টা শামীমকে আমরা কতটা মূল্যায়িত করেছি সেই প্রশ্ন উঠেনি ওর মৃত্যুতেও। ১৯৫২ সালের ২২ অক্টোবর জন্ম নেয়া শামীম ইহজাগতিকতাকে বিদায় জানিয়েছেন গত মঙ্গলবার ২১ মার্চে। শামীম যদি ওর শিল্পের চেয়ে  পোশাক-আশাক আর যাপিত জীবনের জন্য আমাদের আগ্রহ আর মনোযোগের কেন্দ্রে কড়া নাড়ে কেবলই তাহলে ধরে নিতে হবে জাতি হিসেবে আমরা শিল্পবিমুখ।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আমরা শিল্পমনস্ক একটা প্রজন্ম তৈরি করতে পারিনি। এ যে, আমাদের জন্য কতো বড়ো লজ্জা ও বেদনার, তা বোধ করি বুঝতেও আমরা পারছি না। এই অবস্থায় শামীমের শিল্পকে রক্ষায় ও জনসাধারণের মাঝে তুলে ধরার দায় ও দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। রাষ্ট্রের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নানান প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম জারি রাখলেও তা আশাব্যঞ্জক যেমন নয়, তেমনি নতুন কোন কিছু করার উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি। শামীমের ভাস্কর্য সংখ্যা মোটেই অপ্রতুল নয়। জগন্নাথ হলের সামনে এবং নয়া ইস্কাটনে উনার দুটো ভাস্কর্যশিল্পের বাগান রয়েছে। এ দুটোকে জাতীয় জাদুঘরের আওতায় নিয়ে এসে প্রদর্শন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া অন্যত্র যেসব ভাস্কর্য রয়েছে সেগুলো যাতে নষ্ট না হয়, এবং জনসাধারণ ঠিকঠাকমতো দেখতে পারে তার পদক্ষেপ নিতে হবে। শামীমের সৃজিত শিল্প এখন আমাদের জাতীয় সম্পদ, যা রক্ষায় দায় ও দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।

শামীম শিল্পের চর্চা ও সৃজনের মধ্যে দিয়েই নিজের মেরুদণ্ড যে আছে তার আওয়াজ দিয়ে গেছেন। এখন সেই মেরুদণ্ডের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাতে হবে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গকে। এর যদি কোন প্রকার ব্যত্যয় হয় তাহলে বুঝতে হবে আমরা মেরুদণ্ডকে সম্মান জানাতে শিখিনি, অথচ কী অদ্ভুত জন্মসূত্রে আমরা নাকি মেরুদণ্ডী প্রাণী!
 

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt backing the wrongdoers?

BNP acting Chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of a scrap trader in front of Mitford hospital due to what he said its silent support for such incidents of mob violence.

4h ago