ভিন্নমতের হয়েও যাদের ভূমিকা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অসামান্য
১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে যে মুসলিম লীগ দাপটের সাথে বিজয় অর্জন করেছিলো সেই মুসলিম লীগই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে ধরাশায়ী সাইদ। কারণ হিসেবে বলা হয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের দলীয় অবস্থান। এটি ঐতিহাসিক সত্যও বটে। কিন্তু ইতিহাসের মোহনায় দেখা মিলে কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার। এমন কিছু ব্যক্তির দেখা মিলে যারা একইসাথে মুসলিম লীগের সাথে জড়িত ছিলেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছিলেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আজকের আলাপ।
মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮)
১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচন থেকে খাঁ সাহেব মুসলিম লীগের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির পক্ষে ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে স্মারকলিপি প্রদান করা হয় তাতে সর্বপ্রথম স্বাক্ষরটি ছিল মওলানা আকরম খাঁর। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তিনি একটি দীর্ঘ বিবৃতি দেন, সেখানে প্রথম দফাতেই তিনি লিখেছেন: "রাষ্ট্রের জনগণের মাতৃভাষাই সেখানকার জনগণের রাষ্ট্রভাষা হইবে, ইহাই সংগত ও স্বাভাবিক কথা। যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের গণভাষা অবিসংবাদিতরূপে বাঙলা, অতএব তাহার রাষ্ট্রভাষাও নিশ্চিতরূপে বাঙলাই হওয়া চাই।"
পরবর্তী আরও ছয়টি দফাতে বাংলার পক্ষে আরও বিস্তারিত দাবি তিনি জানিয়েছেন। বদরুদ্দীন 'উমরের পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' থেকে জানা যায়, বর্ধমান হাউস, বর্তমান বাংলা একাডেমিতে— তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম এবং আবু জাফর শামসুদ্দীনের সাথে রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে আকরম খাঁর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে চাপানোর চেষ্টা করলে পূর্ব পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং তিনি নিজে সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন"। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হয়েও রাষ্ট্রভাষা বাংলা'র প্রশ্নে তাঁর এমন রুদ্রমূর্তি সত্যিই আশ্চর্যকর ব্যাপার!
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর ঘটনায় তিনি তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। তিনি নিজে মুসলিম লীগ নেতা এবং তার পত্রিকা দৈনিক আজাদ আধা-সরকারি হওয়ার পরও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছিলো। আন্দোলন প্রতিরোধে সরকারী জুলুম এবং বিভিন্ন উচ্চপদস্থ নেতাদের স্বরূপ উন্মোচনে তার পত্রিকা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। এজন্যই কি-না জানি না, মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমির সভাপতি হয়েছিলেন মওলানা আকরম খাঁ, ১৯৬১ সালে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৫৭ সালে ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের সাথেই জড়িত ছিলেন; অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। মুসলিম লীগের রাজনীতি করেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে তার দাপুটে ভূমিকা রীতিমতো বিস্ময়কর।
আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮)
১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আবুল কালাম শামসুদ্দীন মুসলিম লীগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়েছিলেন। সেই সূত্রে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ছিলেন তিনি। ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারীদের উপর নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে পরদিনই তিনি পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য পদে ইস্তফা প্রদান করেন এবং গভর্নর ও স্পিকার বরাবর প্রেরিত চিঠিতে লিখেছেন: "বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা দাবী করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদে আমার সদস্য পদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি।"
কেবল পদত্যাগেই ক্ষান্ত হননি তিনি, পাশাপাশি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যৌক্তিক ও কড়া সম্পাদকীয় লিখেছেন একাধিক। আজাদ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি তখন ঐতিহাসিক এক ভূমিকা পালন করেছিলেন। আবার তিনিই ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে ময়মনসিংহের নিজ এলাকায় যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী আবুল মনসুর আহমদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ধারাবাহিকভাবে রাজনীতি করেছেন মুসলিম লীগের কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন।
আবদুস সবুর খান (১৯০৮-১৯৮২)
খুলনার খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ আবদুস সবুর খান (খান-এ-সবুর) ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং খুলনা জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর তিনি একটি বিবৃতি দেন, সে বিবৃতিতে তিনি ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে 'অমানুষিক জুলুম' হিসেবে আখ্যায়িত করেন, এজন্য প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং দ্যর্থহীনভাবে বাংলার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, এই সবুর খান-ই ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন।
আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (১৯০০-১৯৮৬)
আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি ২২ তারিখে সংঘটিত পরিষদের কার্যাবলী মুলতবি রাখার প্রস্তাব করেন। কিন্তু অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতায় প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ায় তিনি মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করে পরিষদে বিরোধী দল গঠন করেন এবং নূরুল আমীন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরদিনই তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি জেল থেকে বের হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
দেওয়ান লুৎফর রহমান (২০০৮ মৃত্যু)
১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাবনায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য আন্দোলনকারীদের যে বৈঠক হয়েছিল তা অনুষ্ঠিত হয় দেওয়ান লুৎফর রহমানের বাসভবনে। লুফর রহমান তখন পাবনা জেলা মুসলিম লীগের নেতা। তখন পাবনায় যে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়েছিল তার আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে মিছিল করতে গিয়ে দুই দুইবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। মুসলিম লীগের নেতা হয়েও তিনি যেমন রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে আপোষ করেননি, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসন তাদের দমননীতিতে আপোষ করেনি। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে একাধিকবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
উপরোক্ত পাঁচজন ছাড়াও আরও অনেকে মুসলিম লীগের রাজনীতিবিদ হয়েও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। যেমন: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করা অন্যতম পত্রিকা নও বেলাল'র সম্পাদক মাহমুদ আলী ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিল থেকে এবং লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। হজরত শাহজালালের মাজারের তৎকালীন মোতাওয়াল্লি সরেকওম আবু জাফর আবদুল্লাহ ছিলেন স্থানীয় মুসলিম লীগের সদস্য। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। উত্তর-সিলেট জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিমও পদত্যাগ করেছিলেন।
'৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগের অধিকাংশ সদস্যের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা প্রসঙ্গে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল খুলনায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে অনুষ্ঠিত সে সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন খুলনা জেলা মুসলিম লীগের নেতা আবদুল হামিদ। ২১ ফেব্রুয়ারির ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত যশোর জেলা মুসলিম লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জোর দাবি জানানো হয়। প্রতিবাদ হয়েছিল কিশোরগঞ্জেও। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে কিশোরগঞ্জ খেলার মাঠে এক ঐতিহাসিক গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলা মুসলিম লীগের নেতা আবদুল আজিজ খাঁ। ৭ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়: "২৮শে ফেব্রুয়ারি স্থানীয় খেলার মাঠে অন্যূন ৪০ সহস্র লোকের সমাবেশে এক বিরাট প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় শহর ও গ্রামের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। মুসলিম লীগ নেতা জনাব আবদুল আজিজ খাঁ সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ, ভাষা আন্দোলনের বন্দীকৃত সকল ছাত্রের মুক্তি এবং বর্তমান মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।"
ইতিহাসের থেকে স্পষ্ট হয়, মুসলিম লীগার মাত্রই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন এমন ধারণা ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। আরো স্পষ্ট বোঝা গেলো, যতই তারা মুসলিম লীগের রাজনীতি করুক, বিবেককে বিসর্জন দেননি, জুলুমকে জুলুম বলতে দ্বিধাবোধ করেননি, নিজের দলের লিডারকে পর্যন্ত পদত্যাগের দাবি জানাতে পিছপা হননি। এমন আদর্শবান রাজনীতিবিদই সবসময় কাম্য। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এবং আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ চিরকাল উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
ব্যবহৃত গ্রন্থ:
১. পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি : বদরুদ্দীন উমর
২. অগ্রপথিক সংকলন ভাষা আন্দোলন: মুকুল চৌধুরী সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৯৩
Comments