গ্রন্থাগারবিষয়ক মন্ত্রণালয় সময়ের দাবি 

অনেকেই বলছেন, গ্রন্থাগারের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় দরকার হয়ে পড়েছে। কারণ এককভাবে তত্ত্বাবধান করার দরকার আছে। মন্ত্রণালয় হলে লোকবলের ঘাটতিও কিছুটা পূরণ হতে পারে
ছবি: সংগৃহীত

নিজেকে গ্রন্থাগার আন্দোলনের একজন কর্মী ভাবতে গর্ব ও আনন্দ অনুভব করি। একই সঙ্গে দুঃখবোধ হয়, কারণ যতটা এই আন্দোলনের প্রয়োজনে ব্যয় করা দরকার, তা করতে পারি না। গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, বই পড়া এবং গ্রন্থাগারকে সক্রিয় রাখা নিয়ে কথা বলার লোক সমাজে খুবই কম। এর মাঝে আমাদের বেশিরভাগ কথা, আলোচনা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছু হয় না। কারণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অন্য কারো হাতে।

আমাদের দেশে জনসংখ্যা ১৮ কোটি। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য কতটি পাঠাগার থাকা উচিত, সে বিষয়ে আমাদের ভাবনা নেই বললেই চলে। সরকারি গণগ্রন্থাগার সারা দেশে ৭১টি, সারা দেশে অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি গণগ্রন্থাগারের সংখ্যা কমবেশি ১২০০, আর অনুদানের বাইরে থাকা গ্রন্থাগার, যদি একটা গড় ধারণা করা হয়, তবু সব মিলে এ দেশে পাঠাগারের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি হবে না বলে বোধ করি। যা এই বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে নিতান্তই কম। এ থেকে, পাঠাগার, বই পড়ার চর্চা থেকে আমরা কতটা বিচ্যুত, তার সহজ ধারণা পাওয়া যায়। 

আমাদের পাঠকদের ভালো বই পড়ার সুযোগ দিতে হবে, সেই বইটি ঢাকা থেকে বেরোলো, নাকি কলকাতা থেকে বেরোলো, সেটি প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়।

আমাদের দেশে যদি ২ হাজার লাইব্রেরি আছে ধরে নিই, এর মধ্যে সক্রিয় ও সচল লাইব্রেরি আছে কতটি? একজন গ্রন্থাগার কর্মী হিসেবে আমার ধারণা, এ সংখ্যা ৫০০ বেশি নয়। হয়তো আরও কম। লাইব্রেরি সক্রিয় করার জন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি মিলিত প্রচেষ্টা। আমাদের দেশে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর রয়েছে, যারা সরকারি ৭১টি গ্রন্থাগারের দেখভাল করে থাকে। আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। দুটো প্রতিষ্ঠানই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন।

অনেকেই বলছেন, গ্রন্থাগারের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় দরকার হয়ে পড়েছে। কারণ এককভাবে তত্ত্বাবধান করার দরকার আছে। মন্ত্রণালয় হলে লোকবলের ঘাটতিও কিছুটা পূরণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ একটা রাজ্য হয়েও সেখানে গ্রন্থাগারবিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে।

আমাদের পাঠাগারের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। আমাদের দেশে গ্রন্থাগারের দেখভাল করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু গ্রন্থাগার তো সম্পূর্ণ শিক্ষার অংশ। সেক্ষেত্রে গ্রন্থাগার থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিযুক্ত থাকবে কেন? আর তৃণমূল পর্যায়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গণগ্রন্থাগারের সংযোগ ঘটাতে হবে। তা না হলে গণগ্রন্থাগারে পাঠক আসবে কোথা থেকে? এ জন্য গ্রন্থাগারের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুক্ত হওয়া জরুরি।

আমলা নয়, গ্রন্থাগার কর্মীদের যুক্ত করা হোক

মানুষকে বই পড়ায় আগ্রহী করতে রেলস্টেশন, বাসস্টেশন ও বিনোদন পার্কে মিনি লাইব্রেরি বা ছোট গ্রন্থাগার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা, বৃদ্ধাশ্রম ও বহুতল আবাসিক ভবনে গ্রন্থাগার স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বইপ্রেমী মানুষ তৈরি করতে ছোট গ্রন্থাগার করার উদ্যোগটি ভালো। তবে গ্রন্থাগারে কী ধরনের বই থাকবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আকর্ষণীয় বই না দিয়ে যদি পছন্দের কারও বই গ্রন্থাগারে দেওয়া হয়, তাহলে পাঠক সেখানে যেতে আগ্রহ দেখাবে না, এটা পরিষ্কার।

আবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলছে, তারা কেবল বই দেবে। জায়গা এবং অবকাঠামো তারা করে দেবে না। এটা করতে হবে রেলস্টেশন, বাসস্টেশন ও বিনোদন পার্ক যেসব মন্ত্রণালয়ের অধীনে, তাদের। তাই এ উদ্যোগ কবে বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তবে জরুরি বিষয় হলো, স্থান নির্বাচন, বই ক্রয়সহ ছোট লাইব্রেরি স্থাপনের এই পুরো কাজে গ্রন্থাগার আন্দোলনের কর্মীদের যুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। শুধু আমলাদের দিয়ে এ কাজ একেবারেই ভালো হবে না। গ্রন্থাগার আন্দোলনের কর্মীদের যুক্ত করলেই কেবল প্রকল্পটি বাস্তবভিত্তিক হবে।

গ্রন্থাগারে উভয় বইটি চাই

আমাদের গ্রন্থাগারগুলোর বই আকর্ষণীয় হওয়া দরকার। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অন্তত ৫০টি গ্রন্থাগার সরজমিনে পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বেশিরভাগ লাইব্রেরিতে আকর্ষণীয়, বৈচিত্রময় বইয়ের অভাব রয়েছে। ঘুরেফিরে কিছু গুটিকয়েক লেখকের বই আর কিছু বিষয়ভিত্তিক বই দেখে থাকি। কিন্তু বাংলা সাহিত্য তো কম সমৃদ্ধ নয়। নন ফিকশন, ফিকশন মিলিয়ে ভালো বই আমাদের অনেক। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমাদের পাঠকদের ভালো বই পড়ার সুযোগ দিতে হবে, সেই বইটি ঢাকা থেকে বেরোলো, নাকি কলকাতা থেকে বেরোলো, সেটি প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্পগ্রন্থ, যে বইটি গবেষণামূলক, যে বইটি লেখকের শ্রমসাধ্য কাজ, সেটি আমাদের পাঠাগারে রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। কোনো প্রকাশককে একতরফা সুযোগ না দিয়ে ভালোর জন্য প্রতিযোগিতার সুযোগ দেওয়া দোষের নয়।

অনুদান চাই ১ লাখ টাকা 

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে বছরে অনুদান দিয়ে থাকে। অনুদানের অর্ধেক নগদ ও অর্ধেক বই দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, এই অনুদান বাড়াতে হবে। ২৫ হাজার নয়, ৩০ হাজার নয়, ৪০ হাজার নয়, প্রতিটি সচল, সক্ষম গ্রন্থাগারকে অনুদান দিতে হবে ১ লাখ টাকা করে। কারণ অনুদানের অভাবে বেসরকারি লাইব্রেরিগুলো দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। এ যেন আলো নিভে যাওয়া। দিনের পর দিন আমরা এটা মেনে নিচিছ, অথচ কত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা যেন টেরই পাচ্ছি না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পুরনো গ্রন্থাগারগুলোর। সেগুলো পুরনো, নোনা ধরা দেওয়ালের মধ্যে ভাঙাচোরা তাকে বহু মূল্যবান বই নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কিন্তু যতদূর খবর পেলাম, অনুদান বাড়ানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারপরও আমরা আমাদের কথা বলে যাব।

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago