আবর্জনাধিক্যে অনেক ভালো বিষয়ের বইও আড়ালে থাকে : ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রতিদিনই নতুন নতুন বই আসছে অমর একুশে বইমেলায়। মেলার এই সময়ে প্রথমা থেকে প্রকাশ হয়েছে অনুবাদক ও ব্যাংকার ফারুক মঈনউদ্দীনের 'গোয়েন্দা হেমিংওয়ে ও তাঁর প্রেমিকাদের খোঁজে' ও 'জাভাদ্বীপে র্যাঁবো: একটি হারানো সমুদ্রাভিযান' প্রকাশক করেছে জার্নিম্যান। নতুন বই, অনুবাদ ও বইমেলা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন।
অনুবাদ করেন অনেক দিন। অনেকে অনুবাদকে মৌলিক কাজ মনে করে না। কীভাবে দেখেন?
ফারুক মঈনউদ্দীন : অনুবাদ মৌলিক কাজ কি না, সে বিতর্ক হয়তো কখনোই ঘুচবে না। যারা মনে করেন এটা কোনো সৃষ্টিশীল কাজ নয়, তাদের মতে এটা শিল্প নয়, একটা শিল্প-কৌশলমাত্র। কিন্তু তারপরও শাখাটির অবদান কখনোই বাতিল করা যাবে না, কারণ জ্ঞান বিতরণ ও আহরণে অনুবাদের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই বিষয়টি নিয়ে সংশয় কিংবা বিতর্ক অনাকাঙ্ক্ষিত।
মূলত ভাষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনুবাদ একটি শাস্ত্র হিসেবে উঠে এসেছে। তারপর থেকে অনুবাদ সাহিত্য মূল সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে একটা বিশেষ আসন লাভ করে। অনুবাদকর্মের বিষয়ে এই সব বিতর্ক এবং ভাবনা একসময় যেরকম সক্রিয়ভাবে সচল ছিল, আজকালের বিশ্ববীক্ষায় সে সব বহুলাংশে দূরীভুত। আজকাল অনুবাদকর্মকে বিশেষভাবে স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে।
"গোয়েন্দা হেমিংওয়ে ও তাঁর প্রেমিকাদের খোঁজে" বইটি পাঠক কেমন করে নিয়েছে মেলায়?
ফারুক মঈনউদ্দীন : যে প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার বই প্রকাশিত হয়, বইমেলায় আমি সাধারণত তাদের স্টলের কাছে যাই না। সুতরাং পাঠকেরা নতুন এই বইটিকে কীভাবে নিয়েছে সে খোঁজ পাইনি। তবে ধারণা করি, আমি খুব পপুলার লেখক নই বলে আমার পাঠকসংখ্যা সীমিত এবং কাটতিও বেশি হয় না বলে মনে হয়।
দীর্ঘদিন জীবনানন্দ নিয়ে আছেন। জীবনানন্দের কোন প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় জীবনে?
ফারুক মঈনউদ্দীন :আসলে আমার ওপর জীবনানন্দের কোনো প্রভাব টের পাই না। ব্যক্তিগত জীবনে আমি কিছুটা নিভৃতচারী এবং প্রচার-লাজুক বটে, সেটাও জীবনানন্দের প্রভাবে হয়েছি, তা বলা যাবে না। তবে জীবনানন্দের মতো আমিও বিশ্বাস করি "যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা ... পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।"
আমাদের অধিকাংশ বই মেলা কেন্দ্রিক প্রকাশ হয়। এইভাবে ইভেন্ট ধরে শিল্প আগাতে পারে?
ফারুক মঈনউদ্দীন :বর্তমানের বাণিজ্যিকীকরণের দৌরাত্ম্যে সবারই একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে বইমেলা ছাড়া বই প্রকাশ করা যায় না। কারণ, তখন প্রচার ও বাণিজ্য দুটোই হয়। হাতেগোনা দুয়েকটা ভালো প্রকাশনা সংস্থা অবশ্য এই ইভেন্ট মাথায় রেখে বই প্রকাশ করে না, তারা সারাবছরই ভালো উন্নতমানের গ্রন্থপ্রকাশ অব্যাহত রাখে। একথা হয়তো ঠিক, বইমেলায় প্রচার ও বিক্রি বেশি হয়, কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে মেলায় আবর্জনাধিক্যে অনেক ভালো বিষয়ের বই আড়ালে পড়ে যায়। তারপরও কিছু মৌসুমী লেখক ও মৌসুমী ক্রেতা (পাঠক নয়) বইমেলা না এলে যেন জুৎ পান না। এরকম প্রবণতা আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে যেমন পিছিয়ে দিচ্ছে, তেমনই নষ্ট করছে সৃষ্টিশীলতার সম্ভাবনাকে।
দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতেও যুক্ত আপনি। অনেকে বলছে আমরা একটা ঝুঁকির মধ্যে আছি।
ফারুক মঈনউদ্দীন :পড়তে যাচ্ছি নয়, ঝুঁকির মধ্যেই আছি। শারীরিক বিশেষ কোনো দুর্বলতা কিংবা রোগ যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে যেমন নিরাময় হওয়া কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে, একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকেও তার সঙ্গে তুলনা করা যায়। একই কথা আরো বেশি প্রযোজ্য ব্যাংকিং খাতের ব্যাপারে। কোভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধ, পরপর এই দুটো দুর্বিপাকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরাও অর্থনৈতিক বিপদে পড়েছিলাম। প্রথমটি কাটিয়ে উঠলেও দ্বিতীয়টির অভিঘাত আরো গভীর ও সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে। এরকম সময়ে মূল্যস্ফীতি এবং অন্যান্য রোগগুলো বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই আক্রান্ত করেছিল, তারা সময়মতো চিকিৎসা করিয়ে সে সব রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে।
কেবল আমরা যথাসময়ে কাজটা করিনি বলে আমাদের ঝুঁকিগুলো রয়ে গেছে, এখন টোটকার মতো কিছু দাওয়াই দেওয়া হলেও সেসব বিশেষ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ব্যাংকিং খাতকেও আমরা এক বিশাল বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। যখন এই খাতটিকে বাঁচানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দরকার ছিল, তখন আমরা আরো উসকে দিয়েছি বিপর্যয়ের কারণ ও উপাদানগুলোকে । তাই বলেছি, আমরা ঝুঁকির মধ্যেই আছি। এখনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং সেই সদিচ্ছা যদি আমাদের থাকে, তাহলে হয়তো উদ্ধার সম্ভব।
Comments