ঢাবিতে ১৭ দিন

জুলাই আন্দোলনের অগ্রভাবে নারী শিক্ষার্থীরা

নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের হামলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, ১৫ জুলাই ২০২৪ প্রথম আলো

'স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো?' না, স্বাধীনতা আমাদের হয়নি, আমরা একটি স্বাধীনতাকে স্বাধীন করেছি। যে স্বাধীনতা শুধু পুস্তক আর সাহিত্যে বাক্সবন্দী ছিল সেই স্বাধীনতাকে রক্তের বিনিময়ে উন্মুক্ত করেছে এদেশের ছাত্র-জনতা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটি চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলন; কিন্তু না মূলত এটি বিগত ১৫ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ, শোষণ-শাসনের ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর।

'আই হেইট পলিটিক্স' বলা জেনারেশন যেভাবে দেশের ইতিহাস পাল্টে দিল তা অবিশ্বাস্য। মেধাভিত্তিক চাকরির দাবী গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটালো তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে পারাও অনেক বড় সার্থকতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনের উত্থান-পতনের অনেক গল্প রূপকথাকেও হার মানাবে।

১ জুলাই। তখনও আন্দোলন সেভাবে দানা বাঁধেনি। ঈদের ছুটি শেষ হলেও শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে হলগুলোতে তখনো জনশূন্য। গুটিকয়েক অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রূপ নিল রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে। শুরু হয় কোটা সংস্কারের জন্য ২০১৮ এর পরিপত্র পুনর্বহালের সূত্রে। ক্লাস হচ্ছে না জেনেও সবাই হলে ফিরছে। এবারের ফেরাটা ক্লাস-পরীক্ষার জন্য না, এটা অধিকার আদায়ের জন্য। 

জনসমাগম বাড়লে ধাপে ধাপে পাল্টায় আন্দোলনের গতি। পরিপত্র থেকে সকল গ্রেডে কোটা সংস্কার এবং সর্বশেষে সরকার পতনের দিকে চলে যায়। সরকারি মহলের উস্কানিমূলক মন্তব্য উস্কে দেয় মূল আন্দোলনকে। প্রতিদিন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে মিছিল শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পথ ধরে করে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে। প্রথম দিকে স্বাভাবিক থাকলেও পরে প্রতিদিন আন্দোলনকারীরা হলে হলে ছাত্রলীগের বাঁধার সম্মুখীন হয়। কখনো গেইটে আটকে দেয়, কখনো গেস্টরুমে ডাক। এইভাবে হুমকিধামকি চলতে থাকে।

৪ জুলাই সূর্যসেন হলের গেইট তালা দেয় ছাত্রলীগ। তখন আমাদের মিছিল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে বের হয়েছে। খবর পাওয়ামাত্র মত পরিবর্তন করে সূর্যসেন হলের সামনে থামে মিছিল। সবসময় মিছিলের অগ্রভাগে থাকতো নারী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা ভুয়া ভুয়া ভুয়া এবং কোটা না মেধা শ্লোগানে মুখরিত করে সূর্যসেন হলগেট। এক পর্যায়ে গেটের তালা ভেঙে ভেতরে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে মিছিলটি এগিয়ে যায়। এভাবে অসংখ্য বাঁধা পেরিয়ে একটি ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে। এই আন্দোলনে সম্মুখভাগে নেতৃত্ব দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। পরে দেশের যে কোন জায়গায় এই আন্দোলন চলছে নারীরা ছিল ছায়ার মতো।

তারপর শুরু হয় ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন। প্রত্যেকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয় তাতে। শিক্ষকদের পেনশন স্কিম এবং শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির। এটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই একই সময়ে আন্দোলনরত। পরবর্তীতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও ক্লাস বর্জন করে। ততদিনে আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগুন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।  

৭ জুলাই সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরানের একটি প্রতিবেদনকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। বলা হয় ৪৬ এর প্রিলিসহ ৩০টি ক্যাডার-নন ক্যাডার জবের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। খবরটি বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিধাগ্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত একটি রাত পার করে। অনেকে ছিটকে যাচ্ছিল। ভাবছে আন্দোলন করে কোটা বৈষম্য দূর করে কী হবে যদি প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়ে যায়। আন্দোলনের মাঝখানে এমন একটি ইস্যু নিয়ে শিক্ষার্থী ষড়যন্ত্রমূলক বলেও আখ্যা দেয়। আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সরাতে ফাঁদ কি না তা খতিয়ে দেখার কথা বলেন কেউ কেউ। এই সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। কারণ এই স্বৈরাচার শাসনামলে একটি ইস্যুকে আড়াল করতে অসংখ্য ইস্যু সামনে এনেছে।

রংপুরসহ সারাদেশে পুলিশি তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ছাত্র-জনতা। ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের প্রথম শহিদ আবু সাইদের বুক পেতে গুলি খাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনরত প্রতিটি শিক্ষার্থীদের বুকে আঘাত হানে আবু সাইদের হত্যা। এ খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ওপর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ চরমে পৌঁছে। হলগুলোতে শুরু হয়ে যায় ছাত্রলীগ বিতাড়িত করার প্রস্তুতি।

অতঃপর শাহবাগ থেকে ঘোষণা আসে 'বাংলা ব্লকেড'। ১০ জুলাই পুরো ঢাকা স্থবির। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিভিন্ন হলের নেতৃত্বে চলে ব্লকেড কার্যক্রম। বাংলা ব্লকেডের কারণে মানুষের ভোগান্তি হলেও তাদের চোখে-মুখে ছিল ভরসার ছাপ। ব্লকেডে থেকে জনমানুষের সাথে না মিশলে বোধ করি তাদের অনুভূতিটা বোঝা যেত না। মানুষ গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছে, কেউবা অপেক্ষা করছে ব্লক ছাড়লে যাবে, কেউ ব্লকেডে অংশ নিচ্ছে, কেউ পানি এগিয়ে দিচ্ছে; এই সবগুলো মানুষ কি কোটা সংস্কারের জন্য কাজ করেছে? না তারা কোটা সংস্কারের জন্য না, তারা এসেছেন রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য। কাকরাইল মোড়ে ব্লকেড চলাকালে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, "লুটেদের জন্য যুদ্ধ করিনি আমরা। তোমরা সফল হবেই।"

এরইমধ্যে ঘটে যায় আরেক নাটকীয় ঘটনা। আন্দোলনকারীদের সম্মতি ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন শিক্ষার্থী হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। খালি চোখে ভালো উদ্যোগ মনে হলেও আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ ইতিমধ্যে আন্দোলনটি আর হাইকোর্টের রায়ের দিকে চেয়ে নেই। আমাদের দাবী নির্বাহী বিভাগের কাছে। এমতাবস্থায় হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদনটি ভালোভাবে নেয়নি কেউ। যদিও তারা দুঃখ প্রকাশ করে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি "ছাত্ররা ভুল করছে" এই মর্মে একটি মন্তব্য সাড়া ফেলে দেয়। ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। আন্দোলন তীব্র হয়।

মঙ্গলবার (৯জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

১১ জুলাই। কোটা আন্দোলনের আরেকটি স্মরণীয় ও অনুপ্রেরণামূলক ঘটনা। সকালে শোনা যাচ্ছিল পুলিশ শক্ত অবস্থানে থাকবে। সেদিন প্রথমবার পুলিশ সরাসরি বাধা দেয়। একদিকে গ্রেফতার আতংক, অন্যদিকে আপোষহীনতা। সকাল থেকে বৃষ্টি। সবাই জড়ো হতে থাকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে। মিছিলে যোগ দিতে হলে হলে মাইকিং। তবুও অজানা আতংক যদি ভয় পেয়ে সবাই না আসে আন্দোলন হয়তো এখানেই শেষ। সময় যত গড়াতে থাকে প্রতিটি হল থেকে ঢল নামে। যোগ দেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজসহ আশেপাশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জনতার স্রোত শাহবাগে পুলিশের সামনে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে পুলিশ সাজানো ট্যাংক নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং শাহবাগ পুরোপুরি ছাত্রদের দখলে। এটিই ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের প্রথম পাল্টা প্রতিরোধ।

পরেরদিন ১২ ও ১৩ জুলাই শুক্র-শনিবার হওয়ায় মাঠে কোনো আন্দোলন হয়নি। দু'দিন রাখা হয় অনলাইন-অফলাইন জনসংযোগের জন্য। ১৪ জুলাই। সিদ্ধান্ত হয় রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয় বঙ্গভবন অভিমুখে পদযাত্রা। পদে পদে পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় মিছিল। কয়েকজন অনুমতি পান বঙ্গভবনে প্রবেশের। অতঃপর স্মারকলিপি দিয়ে ফিরে। আলোচনা চলে পরবর্তী কর্মসূচি ও আন্দোলনের গতিপথ কী হবে তা নিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেখানে ছাত্রলীগের অভয়ারণ্য সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে স্বৈরাচার বলার এটিই প্রথম ঘটনা। ১৪ জুলাই রাত মূলত স্বৈরাচারের শেষ ঠিকানার বার্তা দিয়েছিল। সেই রাতে ছাত্রলীগ ধাপে ধাপে হামলা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। অবস্থান কর্মসূচির অগ্রভাগে মেয়েরা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো ভাই বন্ধুদের রক্ষা করে

বিকেলে শেখ হাসিনার গতানুগতিক সংবাদ সম্মেলন। ফারজানা রুপার নামের এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের 'রাজাকারের নাতিপুতি' বলে আখ্যায়িত করেন শেখ হাসিনা। আমরা তখনও হলে ফিরিনি। এই মন্তব্যে এতটাই অবাক এবং হতাশ হই যে এর কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ভেবে পাই না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। সূর্যসেন হল থেকে প্রথম আওয়াজ ভেসে এলো "তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার।" যোগ দেয় প্রতিটি হল। সেটি ছড়িয়ে পড়ে মেয়েদের হলসহ সবগুলো হলে। আমরা শামসুন নাহার হলেও ঘোষণা দেই তালা ভেঙে বেরিয়ে আসবো। ছেলেরা রাত ১০টার পর রাজুতে এসে জড়ো থাকে। মেয়েদের হলগেট ১০টায় বন্ধ হয়ে যায়। সে কী দৃশ্য! বিক্ষোভের একপর্যায়ে হলগেটের তালা ভেঙে বেরিয়ে আসে মেয়েরা। হাঁড়ি, পাতিল, চামচসহ যে যা পেয়েছে তা নিয়ে যোগ দেয় মিছিলে। প্রথমে রাজুতে অবস্থান করলেও পরবর্তীতে ভিসির বাসভবনের সামনে এবং রাজুতে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। স্লোগান ছিল "তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার", "চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার"।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্লকেড দিয়ে মৎস ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেখানে ছাত্রলীগের অভয়ারণ্য সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে স্বৈরাচার বলার এটিই প্রথম ঘটনা। ১৪ জুলাই রাত মূলত স্বৈরাচারের শেষ ঠিকানার বার্তা দিয়েছিল। সেই রাতে ছাত্রলীগ ধাপে ধাপে হামলা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। অবস্থান কর্মসূচির অগ্রভাগে মেয়েরা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো ভাই বন্ধুদের রক্ষা করে। এভাবে রাত কাটে। রাত ২টার দিকে সবাই হলে ফিরে। কিন্তু কারো চোখে ঘুম নেই। সাথে অজানা আতংক, উদ্বেগ। রাতজাগার গল্প এখান থেকে শুরু। 

১৫ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের রচিত হলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর, বর্বর এবং লজ্জাজনক অধ্যায়। রাজুতে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা যোগ দেয় দলে দলে। হঠাৎ খবর আসে বিজয় একাত্তর হলে আন্দোলনে আসতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের আটক রেখেছে হল ছাত্রলীগ। এ খবর শুনে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে দিতে বিজয় একাত্তর হলের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলটি কাছাকাছে যেতেই ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা করে এবং বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের উপর থেকে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। পরিকল্পিতভাবে হামলা করা। জন্য ভাড়া করে ক্যাম্পাসে টোকাই ঢুকিয়ে দেয় ছাত্রলীগ। বহিরাগতদের হাতে লাঞ্ছিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরাও। এরা মেয়েদের ওপর হামলা করে রক্ত ঝরাতেও দ্বিধাবোধ করেনি। হল পাড়া থেকে রাজু  পর্যন্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের পাশাপাশি পুলিশবাহিনীও চড়াও হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। চারদিকে চিৎকার, কান্না আর রক্ত। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসারত আহত শিক্ষার্থীদের ওপর পুনরায় হামলা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বিকার।বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে রচিত হলো সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায়।

বেলা বাড়তে থাকে আর আতংক ছড়িয়ে পড়ে। হলে হলে আক্রমণের খবর। শহীদুল্লাহ্ হল, ফজলুল হক হল এবং একুশে হল দিনভর লড়ে যায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি হলের মধ্যে এই তিনটি হলেই ছাত্রলীগ বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে উঠে সবার আগে। এমতাবস্থায় মেয়েদের হলগুলো সবচেয়ে অনিরাপদ ছিল। নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য প্রত্যেকেই লাঠি, দিয়াশলাই, মরিচগুঁড়াসহ অন্যান্য জিনিসপত্র হাতের কাছে রাখে। দিনে হামলার ঘটনা এতই নৃশংস ও নির্মম ছিল যে রাতে হলগুলোতে গণহত্যারও আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এরইমধ্যে রাতে হামলার শিকার হয় ছেলেদের বেশ কয়েকটি হল।

সবাই জেগে থেকে। ফেসবুক তখন বিভিন্ন গুজবে সয়লাব। এসব দেখে আরও আতঙ্কিত সবাই। এভাবে রাত গিয়ে ভোরের আলো ফোটে। আতঙ্কগ্রস্ত রাতের অবসান ঘটে। ভোর হতে অনেক ছেলেমেয়ে হল ছাড়তে শুরু করে। কেউ ভয়ে হল ছাড়ছে, কেউবা পরিবার প্রিয়জনদের চাপে। এভাবে হলে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যায়।

১৬ জুলাই বিকালে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় শহিদ মিনারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগ দেয় আশেপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সাধারণ জনতা। টিএসসিতে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা। টিএসসির দিকে যারা আসছিল হামলার শিকার হচ্ছে। তাই শহিদ মিনারের বিক্ষোভ সমাবেশটি ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ না করে ওখানেই সমাপ্ত হয়। যদিও এ নিয়ে সমন্বয়ক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। একাংশ চাচ্ছিল মিছিলটি নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। অন্য আরেক অংশ চায়নি আর রক্ত ঝরুক। তাই এখানেই মিছিলটি সমাপ্ত হয়। তবে সেদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এমনকি মেয়েরাও পাল্টা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর মনোবলের ফলই আজকের মুক্তি। 

এদিকে রংপুরসহ সারাদেশে পুলিশি তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ছাত্র-জনতা। ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের প্রথম শহিদ আবু সাইদের বুক পেতে গুলি খাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনরত প্রতিটি শিক্ষার্থীদের বুকে আঘাত হানে আবু সাইদের হত্যা। এ খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ওপর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ চরমে পৌঁছে। হলগুলোতে শুরু হয়ে যায় ছাত্রলীগ বিতাড়িত করার প্রস্তুতি। সারারাত ধরে প্রত্যেকটি হলে তুমুল আন্দোলন চলতে থাকে। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে টিকতে না পেরে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ। রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হল সহ মেয়েদের অন্যান্য হল থেকেও ছাত্রলীগের নেত্রীদের হল ছাড়া করে শিক্ষার্থীরা। একই সাথে প্রত্যেকটি হলে শিক্ষার্থীরা 'ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ' মর্মে হল প্রভোস্টের বিবৃতি আদায় করে। ১৭ জুলাই এই রাতে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।

শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে লেখক।

সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিকাল ৫টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে হলে অবস্থানের ঘোষণা দেয়। চারদিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাস ক্রমে অনিরাপদ হয়ে উঠলে সন্ধ্যার দিকে নিরাপত্তার স্বার্থে সকলে হল ছাড়তে বাধ্য হয়। এভাবেই উত্তাল ১৭ দিনে নতুন ইতিহাসের সূচনা হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রলীগ থেকে কলঙ্কযুক্ত করা হয় এবং দেশের নতুন স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়।

শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments

The Daily Star  | English

How frequent policy shifts deter firms from going public

If a company gets listed, it will enjoy tax benefits, and this is one of the major incentives for them to go public..However, the government’s frequent policy changes have disheartened listed firms many times, as they faced higher tax rates once they got listed..It gave a clear, nega

1h ago