প্রতিবাদের মুখে শিবিরের টানানো যুদ্ধাপরাধীদের ছবি সরিয়ে নিলো ঢাবি কর্তৃপক্ষ
শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ইসলামী ছাত্রশিবিরের টানানো একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের ছবি গুটিয়ে নিয়েছে প্রশাসন।
আজ সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিমকে সেসব ছবি সরিয়ে নিতে দেখা যায়। সেসময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা 'যুদ্ধাপরাধীদের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না'-সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
জুলাই অভ্যুত্থান, ফ্যাসিবাদের পতন ও 'ফতেহ গণভবনের' একবছর পূর্তি উদযাপনে টিএসসিতে তিন দিনের এই আয়োজন করেছে ঢাবি শাখা ছাত্রশিবির।
এই আয়োজনে আজ মঙ্গলবার টিএসসি প্রাঙ্গণে টানানো হয় ফ্যাসিবাদবিরোাধী বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার ও ব্যঙ্গচিত্র। সেখানে আলাদাভাবে তৈরি করা হয় একটি কর্নার, যেখানে সাঁটানো হয় একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের ছবি।
এ বিষয়ে ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মহিউদ্দীন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে শাহবাগের হাত ধরে ফ্যাসিবাদের উত্থান, তা পরাজিত হয়েছে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ঠিক সেই শাহবাগই প্রশ্নবিদ্ধ মব জাস্টিস শুরু করেছিল, যা যেকোনো মান বিবেচনায় প্রশ্নবিদ্ধ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।'
'আমরা মনে করি- এমন প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের ভিক্টিম যারা, তারা ফ্যাসিবাদেরও ভিক্টিম। ১৬ বছরের দুঃশাসনের অন্য ভিক্টিমদের মতো তাদের বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে', যোগ করেন তিনি।
তবে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রতিবাদে সরব হন ঢাবি শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
টিএসসি প্রাঙ্গণে স্বীকৃত রাজাকারদের ছবি প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছবি প্রদর্শন করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাবি শাখা ছাত্রদল।
এ ছাড়াও, তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-(বিসিএল), গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।
এক যৌথ বিবৃতিতে এই ছয়টি সংগঠন বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছাত্রশিবিরের তিন দিনব্যাপী একটি আয়োজনে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বাধীন বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এসেও স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন জঘন্য ঘৃণিত কাজ।
এমতাবস্থায় তারা চারটি দাবি জানিয়েছে। সেগুলো হলো- তাৎক্ষণিক যুদ্ধাপরাধীদের ছবি সরিয়ে নিয়ে আয়োজনটি বন্ধ করতে হবে, এমন কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্রশিবিরকে জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে হবে, পরবর্তীতে এমন কর্মকাণ্ড যেন না ঘটে তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা কীভাবে ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা এবং ক্ষমা চাইতে হবে।

এ ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আজকের দিনে শিবির একাত্তর আর চব্বিশকে যেভাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একটা ন্যারেটিভ সাজানোর চেষ্টা করেছে, এটা জুলাই অভ্যুত্থানকে এক ধরনের অপমানের শামিল।'
তিনি বলেন, 'শিবির আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যে এসে তাদের দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধের পর চব্বিশে এসে অভ্যুত্থান হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সেই জায়গায় এসে ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে শিবির যদি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে, তা তো আসলে হয় না।'
এই ছাত্রনেতা বলেন, 'শিবির এখানে মূলত এক ধরনের ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করছে যে, টিএসসিতে তারা চাইলে যা খুশি করতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের এইসব কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তারা ভিক্টিম রোল প্লে করবে, তাদের একটা মাইন্ডসেট হচ্ছে যে, তারা এই ধরনের একটি ন্যারেটিভ এখানে দিতে চায়।'
তিনি আরও বলেন, 'স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনোভাবে অপমানিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ যদি নেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা যে সেটা গ্রহণ করবে না, তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত।'
ঢাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুজিববাদকে ট্যাকল করব বলার সময় আমরা এই বিষয়ে কেয়ারফুল হই না যে, কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধকে খারিজ করে দেওয়ার একটা রাজনীতি হচ্ছে কিনা। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিভিন্ন তত্ত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যেসব কথাবার্তা জামায়াত গত ৫০ বছর ধরে বলেও হালে পানি পায়নি, সে কথাগুলো নরমালাইজ হচ্ছে, জনপরিসরে আসছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সেগুলাকে জাস্টিফাই করা হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ কমিটি প্রথম যেদিন ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসেছিল, সেদিন তারা বলেছিল ছাত্র সমাজ এবং ছাত্রশিবিরের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে সেটা পরবর্তী মিটিংগুলার মধ্য দিয়ে নির্ধারণ করা হবে। পরবর্তীতে লিয়াজোঁ কমিটি বলেই আর কিছু থাকেনি।'
'প্রশাসন তো পরিবেশ পরিষদের আর কোনো মিটিং করেনি, তাহলে শিবিরকে নরমালাইজ কারা করল, তারা যেভাবে এই ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাচ্ছে, এই পারমিশন কোত্থেকে পেল', প্রশ্ন রাখেন এই ছাত্রনেতা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫ আগস্ট আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। আমরা রক্ত দিয়ে এক গণহত্যাকারীকে বিদায় করেছি, আরেক গণহত্যাকারীকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না।'
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটু আগে বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। আমি শিবিরকে সেসব ছবি নামিয়ে ফেলতে বলেছি। কারণ এটা নিয়ে আপত্তি ছিল।'
এতে ঢাবির কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা ভিন্ন আলোচনা। এ বিষয়ে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা রয়েছে। আপাতত ছবিগুলো সরিয়ে রাখতে বলা হয়েছে।'
Comments