এক বৃন্তে দু’টি কুসুমে আমাদের বন্ধন
'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়'- বাংলাদেশ এই পররাষ্ট্র নীতি বজায় রেখে চলেছে। অনেক আগ থেকে সবাই মিলেমিশে এই ভূখণ্ডে বাস করে আসছে। প্রতিবেশি কোনো দেশের সাথে বাংলাদেশ বৈসম্পর্ক গড়ে তুলছে বিশ্বাসী নয়। সকলের সহযোগিতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে চায় অনেক দূর। বর্তমানে এই বোধ আরও জাগ্রত হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি বহুধর্মীয় দেশ। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িত। এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শতাব্দীকাল একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এখানকার সংস্কৃতির অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ-যা নিয়ে সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- 'মোরা এক বৃন্তে দু'টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।'
তবে সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতার বিষয়টি হয়তো কখনো কখনো কিছুটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যা অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় খুবই সামান্য বলা চলে। যেখানে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়ানমার তার সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে গণহত্যা চালিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছে, অন্য বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ যেখানে ফ্রিজে গো মাংস পাওয়াকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে সে তুলনা বাংলাদেশে তেমন কিছুই হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন চলছে, তাদেরকে জোর করে চাকুরি থেকে, দেশ থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে এমন অসম্পূর্ণ তথ্য প্রচারিত হচ্ছে। এই ধরনের অপপ্রচার দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন আসলে কি? সংখ্যালঘু নিপীড়ন হলো এমন একটি পরিস্থিতি যা একটি সমাজে সংখ্যায় বেশী জনগোষ্ঠী সংখ্যায় কম এমন কোনো গোষ্ঠীর মানুষদের উপর অন্যায়, অত্যাচার এবং বৈষম্য করে কেবল মাত্র ঐ গোষ্ঠীগুলোর ধর্ম, দর্শন, চিন্তা, আচার-আচরণ, সংস্কৃতির জন্য বা অন্য কোনো কারণে। যা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোন ভাবেই গ্রহণ যোগ্য নয়। এখানে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রীস্টান সহ সকলেই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে পাশাপাশি বসবাস করে কেউ কারো শত্রু নয়। বরং কখনো প্রতিবেশী কখনো পরমাত্মীয়।
এখানে মসজিদে আজান চলে, মন্দিরে ঘন্টা ধ্বনি বাজে, চার্চে উপাসনা হয়, পেগোডায় চলে প্রার্থনা। কোথাও যদি নিপিড়ন বা সহিংসতার খবর প্রকাশ পায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় তার পেছনে একটা অপরাজনীতি ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তা যে সরকারের আমলেই হোক না কেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করবার নানা যড়যন্ত্র দেশী বিদেশী অনেক চক্র করে চলেছে বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক সহিংসতাকে তো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না।
আওয়ামী রেজিম পতনের পর ভারত সহ অন্যান্য দেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পতনের যে খবর প্রকাশ করে বড় ধরনের উষ্মা প্রকাশের চেষ্টা করা হচ্ছে তা আসলে কোন না কোনভাবে রাজনৈতিক সহিংসতাকে ধর্মীয় সহিংসতার রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যা নিরেট অপরাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিবিসি বাংলা সহ অন্যান্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং সংস্থাগুলো তাদের নিউজ পোর্টালে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে যখন ভুয়া খবর বেশি ছড়ানো হচ্ছে, তখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক এলাকায় মুসলমান শিক্ষার্থীরাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিচ্ছেন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নামে দুইটি সংগঠন দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের ৫২টি জেলায় সংখ্যালঘু মানুষের ওপর ২০৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এই সব কয়টি ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হামলা হয়েছে, নাকি সরকার ঘনিষ্টদের ওপর ক্ষোভের অংশ হিসেবে হামলা হয়েছে, তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই বাছাই না করেই অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছেন।
দুর্যোগ দুর্দিনেও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনেক উদাহরণ আছে সম্প্রতি জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়েও আমরা দেখলাম মাদ্রাসার ছাত্ররা দুবৃত্তদের হামলা আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে কিভাবে হিন্দুদের মন্দির, উপাসনালয়গুলো পাহাড়া বসিয়েছিল আবার একই ভাবে তারা মন্দিরের বাহিরে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছিল। দুর্গা পুজার সময় কিভাবে মাদ্রাসার ছাত্ররা মন্ডপে মন্ডপে পাহাড়া বসিয়ে ছিল বোধয় এ দৃশ্য অনেকের কাছেই ভালো লাগেনি। কারণ এখানে ধর্মীয় দাঙ্গা বাধিয়ে রাজনীতির বিষের বাশি বাজানো অনেক সহজ এবং ফল দায়ক। চিরায়ত বাঙলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্যানভাস সুদূর অতীত কাল থেকেই একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার বা আনন্দ উৎসবকে ভাগা ভাগির বার্তা দেয়ার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দাঙ্গা বা উস্কানির পেছনে থাকে দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র আর অপরাজনীতির দুষ্টু খেলা।
ছয় ঋতুর এ দেশে শরৎ কাল আসলেই সকলের হৃদয়ে ভেসে উঠে কাশবন আর সাদা মেঘের ভেলা। স্বচ্ছ নীল আকাশ আর রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মনকে আন্দোলিত করে। আর এ শরৎ কালেই জমে উঠে শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপুজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হলেও আবহমান কাল থেকে এপার বাংলা ওপাার বাংলার সকলের মাঝে একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। সত্যিকার অর্থেই ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান একে অন্যের পরিপূরক কেউ কারো থেকে আলাদা নয় তবে কেউ কেউ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় গুজব বা উস্কানি ছড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে ব্রিটিশ আমল থেকেই যা এখনো বহাল আছে।
এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। এই ধর্মীয় বৈচিত্র্য সত্ত্বেও বাংলাদেশে সাধারণত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে। বাংলাদেশ সবসময়ই সংস্কৃতি সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপিত শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান বহু প্রাচীন কাল থেকে। বাংলাদেশের সকল ধর্মের মানুষের একটি সাধারণ ইতিহাস রয়েছে। তারা একসাথে সংগ্রাম করেছে এবং একসাথে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাঙালি সঙ্কর জাতি বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় দেশ তা নতুন করে বলবার কিছু নেই।
ড. ইউনূস দেশে ফিরে বলেছিলেন, 'সবাই আমাদের ভাই-বোন। আমাদের কাজ সবাইকে রক্ষা করা এবং একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। হিন্দু মুসলমান নয় আমাদের পরিচয় আমরা বাংলাদেশী। আমরা সবাই মিলে একটা পরিবার। বিশৃঙ্খলা হলো অগ্রগতির শত্রু।' দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু নয়, এই জাতি রাষ্ট্রে আমাদের একটাই গর্বিত পরিচয়—আমরা সবাই বাংলাদেশি।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আপনার যতটুকু অধিকার, আমারও ঠিক ততটুকুই অধিকার। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, 'আমার বাড়িতে যদি পাহারা না লাগে, আমার মসজিদে যদি পাহারা না লাগে, তাহলে হিন্দু বন্ধুদের মন্দিরে কেন পাহারার প্রয়োজন হবে। আমরা এ ধরনের কোনো বৈষম্য চাই না। আমরা চাই, আমাদের সন্তানরা যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে গিয়েছে, এর মাধ্যমে সব ধরনের বৈষম্যের কবর রচনা হোক। বাংলাদেশ একটা বৈষম্যহীন দেশে পরিণত হোক।'
সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করতে সকলকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে হিন্দু নিপিড়নের অপপ্রচার একটি গুরুতর বিষয়। এই ধরনের অপপ্রচার দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুতরাং, এই বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং সত্য খবর প্রচার করা অত্যন্ত জরুরি। না জেনে বা যাচাই বাছাই না করে কোন ঘটনাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রকাশ করা থেকে সতর্ক থাকার কোন বিকল্প নাই।
Comments