বইমেলায় হতে পারে শিক্ষাসফর

শিক্ষাসফরে নতুন স্থান, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, উদ্ভাবন বিষয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। এর মাধ্যমে পরিচিত হওয়া যায় দেশ, জাতি, গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সাথে। বাস্তব ঘটনা দেখা ও বোঝার জন্য শিক্ষা সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাস্তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিকনিকের মতো খাওয়া দাওয়া ও বাসভ্রমণের মাধ্যমেই শিক্ষা সফর শেষ করা হয়। মনে রাখতে হবে, বনভোজন, ভ্রমণ ও শিক্ষা সফরের মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। শিক্ষাসফর নামে স্কুলের তহবিল খরচ কিংবা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বাজেটের খরচ যেন যথাবিহিত হয়েছে- এমনটা ভেবে সন্তুষ্টি লাভই যেন উদ্দেশ্য। অন্যথায় শিক্ষা সফরে গিয়ে ঐতিহাসিক বা শৈল্পিক বা নতুন কোনো উদ্ভাবনী ঘটনা, স্থান ও বিষয়ের সাথে পরিচিত হওয়াই আবশ্যিক ছিল। তা অনেক সময় হয়ে উঠে না।
আচ্ছা, শিক্ষাসফর কোনো বইমেলাতে করা হয়, তখন কেমন হবে? বিশেষ করে তা যদি অমর একুশে বইমেলাতে? এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন স্থান, নতুন পরিবেশের সাথে নতুন নতুন বইয়ের দেখা পাবে। দেখতে পারবে লাখ লাখ বইয়ের গোছানো পরিবেশনা। বিদ্যমান ক্লাসিক যেমন দেখতে পারবে, একেবারে হালের নতুন বইও। তাছাড়া শিল্প সাহিত্যের সকল জনরার বইয়ের সন্ধান পাবে। একসাথে অনেক বেশি জ্ঞানের সোর্স পাবে। তা ছাড়া প্রখ্যাত ও জাতীয় পর্যায়ের প্রিয়সব লেখকদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাবে।
দেখবে সকল প্রকাশদের স্টল, পরিচিত হবে প্রকাশকদের সাথে। অনুরূপভাবে কবি, লেখক, গবেষক, সমালোচক, প্রবন্ধকার, গদ্যকার, কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিকদের সাথে পরিচিত হওয়া, অটোগ্রাফ নেওয়া ও কথা বলার আনন্দ ও দুর্লভ অভিজ্ঞতা হবে। বইমেলায় শিশুদের বই আছে, আবার কিশোর, যুবক ও প্রবীণদের জন্যও বই আছে। রূপকথার গল্প যেমন আছে, তেমনি ভূতের গল্পও আছে, কার্টুনের বই আছে, আবার সিরিয়াস বইও আছে। ফিকশন ননফিকশন কী নেই বইমেলায়।
বইমেলায় সময় কাটিয়ে ফিরে। তবে তার মধ্যে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবেই। যদি বাচ্চারা বই কিনে তবে উত্তম, যদি নাও কিনে তবু হাজারও বইয়ের সাথে পরিচিত হতে পারার অবারিত সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে বই পড়ার প্রতি প্রীতি জন্মাবে।
স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বইমেলায় শিক্ষা সফরের আয়োজন করতে পারে। প্রতিষ্ঠানের ছাত্রপ্রতিনিধি বইমেলাতে শিক্ষা সফরের আয়োজন করতে পারে। বিশেষ করে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বই পড়া ক্লাব, সাহিত্য ক্লাব, ডিবেটক্লাব এ শিক্ষা সফরের উদ্যোগ নিতে পারে। আবার দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বইমেলায় শিক্ষা সফরে যেতে পারে যেখানে পাড়া মহল্লার বিভিন্ন বয়সী বই প্রেমিকরা অংশ নিতে পারে। যেসব গ্রামে গ্রন্থাগার রয়েছে সেসব গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকেও শিক্ষা সফর হতে পারে যেখানে অমর একুশে বইমেলা হতে পারে যথার্থ ভেনু।
বইমেলায় শিক্ষা সফরে যেতে পারেন পরিবারের সবাই মিলে। যেভাবে সবাই মিলে যায় রেস্তোরাঁয়। অনেকে বন্ধুবান্ধব মিলে দূরে ঘুরতে যায় ও হৈহুল্লোড় করে খাওয়া-দাওয়া করে। তারাও যেতে পারে বইমেলায়। গানের আড্ডা, ভ্রমণ আড্ডা ও খাওয়ার আড্ডা হতে পারলে বইয়ের আড্ডা কেন নয়? ব্যক্তিপর্যায়ে, পরিবার পর্যায়ে, বন্ধুমহল মিলে, কিংবা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্লাবগুলোও তাদের সদস্যদের নিয়ে শিক্ষা সফরে যেতে পারে বইমেলায়।
শিক্ষা সফরে বইমেলায় যাওয়ার উদাহরণ নতুন কিছু নয়। দেশে বিদেশে আগেও হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সমাদৃত একটি কাজ। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার, লন্ডন বুক ফেয়ার, যুক্তরাষ্ট্রের বুক এক্সপো আমেরিকা, ফ্রান্সের প্যারিস বুক ফেয়ার, আরব আমিরাতের শারজাহ ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার, ভারতের নিউ দিল্লী ওয়ার্ল্ড বুক ফেয়ার, চায়নার বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার, ইত্যাদির প্রতিটিতে দেশের ও বিদেশের অনেক দল শিক্ষা সফরে ভিজিট করে। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আর ক্লাব ও সংগঠনগুলো বইমেলাতে শিক্ষা সফরের আয়োজন করতে পারে। বিশ্বজুড়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক বইমেলায় না হোক, অন্তত দেশের অমর একুশে বইমেলায় শিক্ষা সফর করতে পারে।
শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থী ও অংশগ্রহণকারীরা নানা রকম সুফল পেতে পারে।
ক. শিক্ষামূলক সুবিধা পেতে পারে। যেমন বিভিন্ন প্রকাশকের প্রকাশিত ও বিভিন্ন লেখকের লেখা নানা জনরার বইয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে তাদের জ্ঞান লাভ হবে। সাহিত্য ও অ্যাকাডেমি জগতের বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে। নতুন নতুন সৃষ্টি ও ধারণার সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। ভবিষ্যতে গবেষণা ও লেখালেখির প্রতি অনুরাগ তৈরি হবে।
খ. অংশগ্রহণকারীদের দক্ষতার উন্নয়ন হবে। কীভাবে ভালো বই বাছাই করতে হয়, কোন কোন বই তার পছন্দ, পছন্দের বই পাওয়ার পদ্ধতি, ভিন্ন রুচির বইয়ের দিকে আগ্রহী হওয়ার পদ্ধতি জানবে। লেখক, প্রকাশ ও অন্যান্য ভিজিটরদের সাথে পরিচিত হয়ে, কথা বলে নিজের কমিউনিকেশন দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণ-ক্ষমতা প্রোথিত হবে আর সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনা করতে পারবে। পাঠ হজম করে, জাবর কেটে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বাড়বে।
গ. ক্যারিয়ার সচেতনতাও বৃদ্ধি পেতে পারে। বই ব্যবসা, বই ক্রয় বিক্রয়, সাংবাদিকতা প্রকাশনা জগতের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতে পারে। এ সেক্টরে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী হতে পারে। শিক্ষার্থীদের কেউ যদি ইচ্ছা করে সে এ সেক্টরে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে।
ঘ. লেখালেখির জগতের প্রতি অনুরাগ তৈরি হতে পারে। অন্যান্য লেখক, গল্পকার, কবি ও সাহিত্যিক ও সমালোচকদের দেখে লেখক হওয়ার স্বপ্ন তৈরি হতে পারে। তরুণ প্রজন্ম লেখালেখিতে আগ্রহী হলে দেশ ও সমাজে বুদ্ধিজীবী, চিন্তক, লেখক ও সচেতন নাগরিকদের সংখ্যা বাড়বে। যা আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখবে।
ঙ. আনন্দ ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পথে হাঁটা হয়। শিক্ষার্থীরা আনন্দ, উল্লাস, ও আগ্রহ নিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতা লাভ করে যা শ্রেণীকক্ষে পায় না। উপভোগ্য পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। এরিস্টটল বলেছিলেন ''আমি কখনও মানুষকে পড়াই না, আমি কেবল আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করি, যেখান থেকে শিক্ষায় আগ্রহীরা সহজেই শিখে নেয়''। তাই শিক্ষাসফরে বইমেলায় গেলে সে রকম একটি আরামদায়ক ও আনন্দঘন পরিবেশে যাওয়া হয়। আর শিক্ষা ও জ্ঞান সহজেই লাভ করবে শিক্ষার্থীরা।
চ. বহির্বিশ্বের সাথে পরিচিত হতে পারে। অনুবাদের মাধ্যমে প্রচুর বিদেশি বই বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়। বইমেলায় গেলে বিদেশি ভাষা, কৃষ্টি, কালচার, সাহিত্য, ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের অনেক বই সংগ্রহ করতে পারবে। এসব বই দেখলে ও পড়লে বৈশ্বিক সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে পারবে ও নিজেদের চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
বইমেলায় শিক্ষাসফর একটি উত্তম বিকল্প। এটা কেবল শিক্ষামূলকই না, এটা উৎসাহব্যঞ্জক, আনন্দদায়ক ও সমৃদ্ধ একটি সফর হতে পারে। সৃষ্টিশীল ও জীবনমুখী শিক্ষা দিতে বইমেলায় শিক্ষাসফর হতে পারে একটি কার্যকর পন্থা। যারা বইবিমূখ ও পড়তে অনাগ্রহী তাদের মধ্যেও বই পড়ার আগ্রহী চিত্ত তৈরি করবে।
Comments