মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা:  মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, বীর বিক্রম

মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্লাটুন কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য নেতৃত্ব ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল মান্নানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর বিক্রম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৩৩।
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, বীর বিক্রম।
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, বীর বিক্রম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা  আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা এবং অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করেছে ডেইলি স্টার। এখন বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বমোট খেতাবপ্রাপ্ত ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের ১০০ তম পর্বে রইলো মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বীর বিক্রম'র বীরত্বগাঁথা।)

মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্লাটুন কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য নেতৃত্ব ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল মান্নানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর বিক্রম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৩৩।

১৯৭১ সালে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। সেসময় তার পদবী ছিল নায়েব সুবেদার। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। 

২৫ মার্চ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ব্যাপক রদবদল হয়। এদিন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে যান বেশ কয়েকজন জেনারেল। সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদারকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়।

২৫ মার্চ রাতে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের হেডকোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে চার্লি কোম্পানি থেকে ব্রাভো কোম্পানিতে  বদলি হয়ে যান আবদুল মান্নান। এর কিছুক্ষণ পরেই চার্লি কোম্পানিকে চট্টগ্রাম পোর্টে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আগেই বদলি হওয়ার কারণে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন আবদুল মান্নান। কারণ চট্টগ্রাম পোর্টে চার্লি কোম্পানির সব বাঙালি সেনাকেই হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী। কেবল ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন চার্লি কোম্পানির অধিনায়ক বদিউল আলম। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার অজুহাতে তিনি শেষমুহুর্তে সরে গিয়েছিলেন।

এরপরই ডাক পড়েছিল ব্রাভো কোম্পানির। এমন সময়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বদিউল আলম ফিরে এসে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের উপ অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানকে সবকিছু খুলে বললে মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে সব পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেপ্তার করা হয়।

২৬ মার্চ ভোরের সঙ্গে সঙ্গে ব্যারাকের উপর পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে ইবিআরসির চারদিকে পাহাড়ের উপরে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা এসে পড়তে থাকে। ২৭ মার্চ নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এক প্লাটুন সেনা নিয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে হালিশহর পৌঁছালে সুবেদার জয়নালের নির্দেশে হালিশহর কাঁচা রাস্তার মোড়ে ২টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ডিফেন্স নেন। এদিকে পাহাড়তলী থেকে প্রতিরোধকারীদের পিছু হটতে হয়। ২৭ মার্চ নায়েক সুবেদার আবদুল মান্নান ও বাঙালি সেনাদের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী মূল শহরে ঢুকতে পারেনি।

চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার নির্দেশে কুমিল্লার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ইঞ্জিনিয়ার্স সিগন্যাল, মর্টার রেজিমেন্টসহ ১০০ গাড়ীর একটি বিশাল কনভয় নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এসময় ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নির্দেশে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া পাকিস্তানি হানাদারদের উপর অ্যামবুশের সিদ্ধান্ত নেন। এই দলে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল মান্নান।

পরিকল্পনা করা হয় স্থানীয় লোকজনের সাহায্য নিয়ে গাছের ডাল, ইট দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হবে। যখন নাদার সেনারা ব্যারিকেড অপসারণ করতে নামবে তখনই তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালানো হবে।

২৬ মার্চ সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে হানাদারদের সামরিক বহরটি কুমিরায় বাঙালি সেনাদের দেওয়া ব্যারিকেডের সামনে এসে থেমে যেতেই মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গর্জে উঠে। হানাদারদের সম্মুখসারীর সেনারা প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। একপর্যায়ে হানাদার সেনারা অবস্থান সামনে নিয়ে মেশিনগান, মর্টার ও আর্টিলারি ফায়ারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর উপর হামালা চালায়। এসময় ২ পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। বহু চেষ্টা করেও হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ ছেদ করতে পারেনি।  একপর্যায়ে আবদুল মান্নানের গুলিতে হানাদারদের ট্রাকে আগুন ধরে যায়। প্রায় ২ ঘণ্টা ভয়াবহ সংঘর্ষের পর একপর্যায়ে হানাদার সেনারা পিছু হটে।

২৭ মার্চ মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। কিন্তু এরপরও আবদুল মান্নানরা কুমিরার অবস্থান শক্তভাবে আঁকড়ে রেখেছিলেন। ২৮ মার্চ সড়ক ছেড়ে হানাদার সেনারা ডান ও বাম দিক থেকে আর্টিলারি ও মর্টার ফায়ারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর উপর হামলা চালায়। একই সঙ্গে সাগর থেকে গানবোট থেকেও মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করা হয়। একপর্যায়ে শত্রু কুমিরার অবস্থান দখল করে নিলে পিছু হটেন আবদুল মান্নান ও তার প্লাটুনসহ মুক্তিযোদ্ধারা।

এরপর ১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছোট হরিণায় চলে যান আবদুল মান্নান।

পরবর্তীতে নিজ গ্রামের বাড়ী কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার শিদলাই গ্রামে এসে একটি প্রশিক্ষণ শিবির খুলেন আবদুল মান্নান। কিছুদিন সেখানে ছাত্র-জনতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেই প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে ভারতের বক্সনগরে চলে যান আবদুল মান্নান। বক্সনগর থেকে তেলঢালায় চলে যান আবদুল মান্নান। মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের শেষ সপ্তাহে মেঘালয়ের তেলঢালার গভীর জঙ্গলে প্রথম, দ্বিতীয় এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয় জেড ফোর্স।

এরপর টানা দেড় মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া ৩টি ব্যাটেলিয়নকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩টি ঘাঁটি দখলের। এর মধ্যে অষ্টম বেঙ্গলকে নকশী বিওপি দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নকশী বিওপি যুদ্ধ শেষে হাজিরচরে চলে যান আবদুল মান্নান।

কিন্তু মাত্র একটি প্লাটুন নিয়ে আবদুল মান্নানের পক্ষে হাজিরচর সামাল দেওয়া ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। তখন আবদুল মান্নানকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ছালিয়ারচরে পাঠানো হয়। ছালিয়ারচরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ হয় আবদুল মান্নানের প্লাটুনের। একরাতের মধ্যেই ছালিয়ার চড় দখল করেন আবদুল মান্নান ও তার প্লাটুন। সেখান থেকে আবদুল মান্নান ও তার প্লাটুনকে রৌমারীর প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হয়।

চিলমারী ছিল ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী একটি থানা। চিলমারী রেলস্টেশন, হাইস্কুল ও ওয়াপদা অফিসে পাকিস্তানিদের অবস্থানে ৩২ বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি নিয়মিত সেনাসহ সর্বমোট ৫০০'র কাছাকাছি ইপিসিএএফ, রাজাকার ও পাকিস্তানি পুলিশ মোতায়েন ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী চিলমারীতে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর উপর রেইড চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নানা দল ও উপদলকে নানা জায়গায় দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার পর নায়েক সুবেদার আবদুল মান্নানকে দেওয়া হয় চিলমারী ওয়াপদা বাঙ্কারের পাশের পজিশন। কারণ ওয়াপদার পাকা ভবনটি কেন্দ্র করে চারদিকে কনক্রিটের বাঙ্কার নির্মাণ করে হানাদার বাহিনী মিডিয়াম রেঞ্জ গান ও এইচএমজি, এলএমজিসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে রূপান্তর করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর এই ঘাঁটিই ছিল এই ভবনে। 

১৭ অক্টোবর পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোর ৪টায় চিলমারীতে হানাদারদের অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে তার প্লাটুন।

এসময় ২ পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। গোলাগুলিতে রক্তিম হয়ে উঠে গোটা চিলমারীর আকাশ। চিলমারী ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত হানাদার সেনারা ছিল বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে। কারণ স্টেশনের উত্তর দিকে একটি বাঙ্কার থেকে ক্রমাগত মেশিনগানের মাধ্যমে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলো হানাদার বাহিনী। একপর্যায়ে আবদুল মান্নান দেখলেন এই মেশিনগান পোস্টটি ধ্বংস করতে না পারলে পাকিস্তানিদের নিঃশেষ করা যাবে না। তাই তিনি মেশিনগানটি ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছিল প্রচণ্ড বিপজ্জনক ও ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ও তার সহযোদ্ধা আবদুর রহিম মেশিনগানটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্রলিং করে এগিয়ে যান। একপর্যায়ে তারা বাঙ্কারের মেশিনগান পোস্ট লক্ষ্য করে কয়েকটি গ্রেনেড ছুঁড়তেই পার্শ্ববর্তী বাঙ্কার থেকে হানাদারদের ছোঁড়া গুলিতে শহীদ হন আবদুর রহিম। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন নায়েক সুবেদার আবদুল মান্নান। ততোক্ষণে একমাত্র ওয়াপদা ভবন ছাড়া চারপাশের সব জায়গাতেই পাকিস্তানিদের পতন ঘটেছে।  কিন্তু এতদা সত্ত্বেও নিজের অবস্থান থেকে পিছু না হটে যুদ্ধ চালিয়ে যান আবদুল মান্নান। একপর্যায়ে গুরুতর আহত মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সকে সিলেটে পাঠানো হলেও মোহাম্মদ আবদুল মান্নান সিলেটের যুদ্ধে অংশ নেন নভেম্বর মাসে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ যুদ্ধেও অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন আবদুল মান্নান। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একটি গুলি তার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

আবদুল মান্নানের জন্ম কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন আবদুল মান্নান। সুবেদার পদে থাকা অবস্থায় ১৯৮০ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০২১ সালের ১৬ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বীর বিক্রম।

সূত্র:

১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ১ ও ১১

২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস

৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র নবম এবং দশম খণ্ড

Comments