মুক্তিযুদ্ধের ‘কাদেরিয়া বাহিনী’র অস্ত্র সমর্পণের সুবর্ণজয়ন্তী
একাত্তরের কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আজ ২৪ জানুয়ারি স্মরণীয় একটি দিন। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭২ সালের এই দিনে টাঙ্গাইলে শহরের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন এই বাহিনীর বীর সদস্যরা।
টাঙ্গাইলকে বলা হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের 'জন্মস্থান'। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে জেলায় প্রতিষ্ঠিত 'কাদেরিয়া বাহিনী'র অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও সাফল্য দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদেশেও।
'কাদেরিয়া বাহিনী' গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে।
দখলদার পাকিস্তানিদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে বাঁচাতে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল টাঙ্গাইল অঞ্চলে কাদেরিয়া বাহিনী গঠিত হয়। দলটির সাহসী গেরিলারা এই অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
'বাঘা সিদ্দিকী' (টাইগার সিদ্দিকী) নামটি দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার সাহসিকতা ও কৌশলের কাছে তারা বারবার পরাজিত হয়।
কাদেরিয়া বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি অসাধারণ গেরিলা লড়াইসহ বহু সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। তারা বেশিরভাগ যুদ্ধে সফল হন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অনেক পাকিস্তানি সেনা ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা নিহত ও আহত হন। কাদেরিয়া বাহিনীর অনেক মুক্তিযোদ্ধাও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
বেসামরিক গেরিলা যোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী ১৭ হাজার নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ও ৭০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে এই বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন।
কাদেরিয়া বাহিনীর ৯১ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের পাশাপাশি ঢাকা, ময়মনসিংহ জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনাসহ কয়েকটি জেলায় প্রচণ্ড আঘাত হানেন এবং দখলদার পাকিস্তানিদের পরাজিত করেন। টাঙ্গাইলের সখীপুরে দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় এ বাহিনীর সদরদপ্তর ছিল। আন্ধি গ্রামে ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
কাদেরের বড় ভাই তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ বাক্য পাঠ করান।
'কাদেরিয়া বাহিনী' পরিচালিত হতো সামরিক কায়দায়। বাহিনীর সদরদপ্তরের কাছে মুক্তাঞ্চলে হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল। সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। বাহিনীতে অর্থ বিভাগ, জনসংযোগ বিভাগ, রেডিও-টেলিফোন-যোগাযোগ বিভাগ, খাদ্য বিভাগ এবং বিচার ও কারা বিভাগও ছিল।
সামরিক শাখার পাশাপাশি কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক বিভাগও ছিল। এ বিভাগের প্রধান ছিলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ।
আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও খন্দকার নুরুল ইসলাম বেসামরিক বিভাগের পক্ষে কয়েকটি স্থানে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে জুনে ভূঞাপুর ও গোপালপুরসহ যমুনার চরাঞ্চলে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করার জন্য এনায়েত করিমকে উত্তরে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা দেশের ভেতরে প্রশিক্ষণ নেন। গেরিলা যুদ্ধ সাধারণত 'হিট অ্যান্ড রান' পদ্ধতিতে হয়। তবে কাদেরিয়া বাহিনী 'হঠাৎ আঘাত, অবস্থান এবং অগ্রসর' পদ্ধতি অনুসরণ করে।
কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে অন্তত ৭৩ ছোট-বড় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মাকড়াই, ধলাপাড়া, কামুটিয়া, বল্লা, ফুলতলা, বাথুলী, পাথরঘাটা ও ঘাটাইলের যুদ্ধ।
ইতিহাসে 'জাহাজমারা যুদ্ধ' হিসেবে পরিচিত ভূঞাপুরের মাটিকাটার লড়াই ১৯৭১ সালের আগস্টে হয়। এটি ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সফল যুদ্ধ। এটি পরবর্তীতে স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।
যুদ্ধটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক অবিস্মরণীয় সাফল্য। এটি ছিল মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান।
ডিসেম্বরে ঢাকার বিজয়েও কাদেরিয়া বাহিনীর বিশেষ ভূমিকা আছে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী।
কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হামিদুল হক, হাবিবুর রহমান খোকা, ফজলুল হক, ফজলুর রহমান, আবদুস সবুর খান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবুল কালাম আজাদ, হবিবর রহমান হবি, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, আবদুর রাজ্জাক ভোলা, নুরুন নবী, বুলবুল খান মাহবুব, আশরাফ গিরানী, আবদুল আজিজ, নুরুল ইসলাম এবং আরও অনেকে যুদ্ধে তাদের ভূমিকা ও সাহসিকতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর মহান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম খেতাব পান। কাদেরিয়া বাহিনীর ১৪ বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক ও ২ বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর বিক্রম খেতাব পান।
আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও তার কাদেরিয়া বাহিনী ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন।
সেখানে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্দেশে বলেছিলেন, 'আমি আপনাদের সালাম জানাই। অস্ত্র দিতে পারিনি। শুধু আদেশ দিয়ে গেছি। আপনারা দখলদার বাহিনীর হাত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। আপনারা অতুলনীয়। পৃথিবীর খুব কম জাতিরই এমন গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। সত্যিকারের দেশ গড়ার জন্য আপনারাই সঠিক সৈনিক।'
কাদেরিয়া বাহিনীর অন্যতম সদস্য স্বনামধন্য কবি, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বুলবুল খান মাহবুব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। পরে কাদেরিয়া বাহিনী গঠিত হয়।'
'টাঙ্গাইলসহ আশেপাশের কয়েকটি জেলায় কাদেরিয়া বাহিনী ৩ শতাধিক যুদ্ধে অংশ নিয়ে অধিকাংশ যুদ্ধেই জয়ী হয়। কাদেরিয়া বাহিনীর উপস্থিতির কারণেই তখন ভারতীয় মিত্র বাহিনী এ অঞ্চল দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল।'
তিনি জানান, ১১ ডিসেম্বর কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। সেদিন শহরের আশেপাশের কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে কয়েক হাজার গুলি ছুড়ে আনন্দ প্রকাশ করা হয়।
'এরপরও আমাদের কাদেরিয়া বাহিনীর কাছে এই বিজয় ছিল মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো। কারণ বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইল এলে সেদিন আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পেয়েছিলাম,' যোগ করেন তিনি।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'কাদেরিয়া বাহিনীর সুসজ্জিত সদস্যরা গাড়ি ও মোটরসাইকেল বহর দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে টাঙ্গাইল জেলার শেষ সীমানা গোড়াই থেকে গার্ড অব অনার দিয়ে নিয়ে আসেন।'
তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, 'দেখো দেশে ফিরে আমি আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা আমার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর দেখতে যাইনি। আমি আমার কাদের এবং কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের দেখতে এসেছি।'
'সেদিন কাদেরিয়া বাহিনীর সমর্পিত অস্ত্রগুলো ট্রাকে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ২৪ জানুয়ারি কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।'
ঐতিহাসিক দিনটি উপলক্ষে কাদেরিয়া বাহিনী আজ টাঙ্গাইল শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিকেল ৩টায় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও বর্তমানে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম।
Comments