ভাষা আন্দোলনে নোয়াখালী
(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে একুশ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১ জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের পর্বে থাকছে নোয়াখালীর ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)
ভাষা আন্দোলনে নোয়াখালী অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিল। নোয়াখালী সদরের মূল কার্যক্রম সংগঠিত হতো মূলত মাইজদী শহরে। এ ছাড়াও, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকল্প কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল চৌমুহনী।
নোয়াখালী সদর বা মহকুমা কেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলন ছিল অনেকটাই একুশের আন্দোলন। এই পর্বেই মূলত আন্দোলন সংগঠিতরূপে প্রকাশ পেয়েছিল নোয়াখালী শহরে।
তৎকালীন নোয়াখালীর গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা শহর ছিল ফেনী। এটি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অগ্রসর জনপদ হিসেবে বিবেচিত ছিল। ফেনী কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের মাধ্যমে 'তমদ্দুন মজলিস' শিক্ষিত সমাজে আলোচিত ছিল।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন নোয়াখালী শহর ও এর অন্যান্য মহকুমায় তেমন প্রভাব ফেলেনি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল ফেনী। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে ফেনীর বিশেষ ভূমিকা ছিল মূলত কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে। তাদের সঙ্গী ছিলেন স্কুল শিক্ষার্থীরা।
এ উপলক্ষে কলেজ সংসদের সাধারণ সম্পাদক কোব্বাদ আহমদকে আহ্বায়ক করে ভাষা উদযাপন কমিটিও গঠিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে ফেনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সামসুল হক চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এবিএম মুসা প্রমুখ।
ফেনীর ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত 'সাপ্তাহিক সংগ্রাম' পত্রিকার সম্পাদক খাজা আহমেদ ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ফেনীতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। আয়োজন করা হয় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের।
ফেনী কলেজের ছাত্ররা সামনের সারি থেকে আন্দোলনকে ফেনীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও তৎকালীন সরকারবিরোধী ভূমিকার কারণে 'সংগ্রাম' ও খাজা আহমেদকে অসংখ্যবার প্রশাসনিক হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছিল।
ফেনী মহকুমা শহরের মাস্টারপাড়ায় সুজাত প্রেস থেকে প্রকাশিত 'সংগ্রাম' নিষিদ্ধের খড়গ জারি হয় ১৯৫০ সালে। একই বছরের অক্টোবরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন খাজা আহমেদ।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন নোয়াখালী শহর ও এর আশপাশের এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি না করলেও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তুমুলভাবে আন্দোলিত করেছিল নোয়াখালীর ছাত্রসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষকে। আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল জেলা ও মহকুমা শহরগুলোয়।
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চৌমুহনী বিদ্যামন্দিরসহ কয়েকটি স্কুলের ছাত্ররা সংগঠিত হয়ে ধর্মঘট পালন করে। একই সঙ্গে বিদ্যামন্দির ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রসভা। এটি একপর্যায়ে জনসভায় পরিণত হয়েছিল।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদী শহরে হরতাল পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ৫ শতাধিক ছাত্র শোভাযাত্রা নিয়ে শহরের রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে মাস্টার আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে কেরানী ব্যারাকের সামনে জনসভায় সমাবেত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন সালাম কিবরিয়া, কে এম শামসুদ্দিন প্রমুখ।
২১ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে মিছিল ও একই সঙ্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেন। সেদিন বিকেলে সোনাইমুড়ি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনসভা আয়োজিত হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি মাইজদী হাইস্কুলে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে হরতাল হয়।
২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ-এ উঠে এসেছিল নোয়াখালীর মাইজদীর আন্দোলনের সংবাদ। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মাইজদী কাছারি ময়দানে ফজলুল্লাহ ওরফে চর মিয়া সাহেবের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় স্কুল মাদ্রাসার ছাত্রগণ দলে দলে যোগদান করেন। নুরুল আমীন সরকারের পদত্যাগ, গুলিবর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর বিচার দাবী করিয়া কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।'
নোয়াখালী সদরে সংগঠিত আন্দোলনের প্রভাবে নোয়াখালীর আইন সমিতির সভায় ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলির তীব্র নিন্দা জানানো হয়। ২ মার্চ আইন সমিতির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল আজাদ পত্রিকায়। পরদিন এর প্রভাবে স্থানীয় মিউনিসিপালিটি মাঠে মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা এক পা পিছু হটে গুলিবর্ষণে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দাবি করেন।
১৯৪৮ সালের মতো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও নোয়াখালীতে অগ্রসর ছিল ফেনী।
ঢাকার আন্দোলনের ঘটনাগুলো নিয়মিত প্রত্যক্ষ করেছিল ফেনীর ছাত্রসমাজ। ঐতিহ্যমাফিক ফেনীর বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা স্থানীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয় ফেনী কলেজ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন আহমদকে। এই কমিটির উদ্যোগে ও নেতৃত্বে ফেনীতে গড়ে উঠেছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার সংবাদে ক্ষুব্ধ ফেনীর ছাত্রসমাজ সেদিন মিছিল নিয়ে ফেনী শহর প্রদক্ষিণ করে। সেসময় ছাত্রদের কণ্ঠে স্লোগান ছিল, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'খুনি নুরুল আমিনের বিচার চাই'।
২১ ফেব্রুয়ারি ফেনী শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় এসে মিছিলে যোগ দেয়। মিছিলে শামিল ছিল ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররাও।
সেদিন ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্র ও যুব নেতাদের। তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা জিয়াউদ্দিন আহমদ, জুলফিকার হায়দার চৌধুরী, লুৎফুর রহমান, ফরমান উল্লাহ ও শামসুল হুদা।
১ মার্চ দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল ফেনীর পরশুরামে ২১ ফেব্রুয়ারির বিশাল ছাত্র সমাবেশের ঘটনা। এতে বলা হয় 'পরশুরাম, ২১শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বর্তমান মন্ত্রীসভার পদত্যাগ এবং এইপ্রকার জুলুমের স্থায়ী প্রতিকারের দাবীতে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের ছাত্রগণ ও জনসাধারণ পূর্ণ হরতাল পালন করে। তাহারা বিরাট শোভাযাত্রা বাহির করিয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।'
নোয়াখালী ও ফেনীর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল জনসাধারণের সমর্থন এবং শহরের শিক্ষিত সমাজের সংশ্লিষ্টতা ও সহযোগিতা। এর ফলে আন্দোলন দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল ফেনীর প্রত্যন্ত এলাকাতেও।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক
দৈনিক আজাদ, ২৬ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২; ১ ও ২ মার্চ ১৯৫২
Comments