একুশের একাত্তর

ভাষা আন্দোলনে কুষ্টিয়া

২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মূল দিনে সমগ্র কুষ্টিয়া জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়।
একুশের একাত্তর/ ভাষা আন্দোলনে কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়ার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে  একুশ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১টি জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আমাদের আজকের নবম পর্বে থাকছে কুষ্টিয়ার ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)

ভাষা আন্দোলনের তীব্র ঢেউ লেগেছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ কুষ্টিয়াতেও। কুষ্টিয়া ছিল বরাবরই দেশের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। কুষ্টিয়া ছিল বরাবরই দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান হিসেবে খ্যাত। বাংলা ভাষার ওপর আকস্মিক আঘাত মেনে নিতে পারেননি কুষ্টিয়ার জনসাধারণ। যদিও ১৯৪৮ সালের প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলনের তেমন হাওয়া লাগেনি কুষ্টিয়াতে। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে কুষ্টিয়াতে কিছুটা তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তবে তা কুষ্টিয়া জুড়ে তেমন একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেনি।

১৯৫১ সালের শেষ দিকে ভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে পরিপূর্ণ আলোচনার সৃষ্টি হতে শুরু করে কুষ্টিয়াতে। এসময় কুষ্টিয়ার স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবী মহল এবং ছাত্র নেতাদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আলোচিত হতে থাকে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও আন্দোলন গড়ে তোলার সচেতনতা। এসময় রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তমদ্দুন মজলিসের সুদৃঢ় যোগাযোগ হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল হক, সৈয়দ আলতাফ আলী, ডা. আবুল কাশেম এবং স্থানীয় স্কুল শিক্ষার্থী শাহিদা খাতুন।

কুষ্টিয়ায় ভাষা আন্দোলন পূর্ণাঙ্গভাবে দানা বাঁধতে থাকে ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ। বিক্ষোভে শামিল হয় কুষ্টিয়ার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।

১৭ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় তমদ্দুন মজলিসসহ কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতাকর্মী ও ছাত্র নেতাদের নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। উক্ত সভা থেকে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি।

ঢাকায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন জারি রাখে কুষ্টিয়ার সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এসময় ২১ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে কুষ্টিয়ার ভাষা আন্দোলনকারীরা কর্মসূচী সফল করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালায়।

২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মূল দিনে সমগ্র কুষ্টিয়া জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। এদিন কুষ্টিয়ার সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। একই সঙ্গে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দখলে। দুপুর ১২টায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিলে কুষ্টিয়া শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে তারা আরবি হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনা প্রত্যাহারেরও দাবী জানায়। এদিন দুপুর ২টায় মাওলানা আবদুল হকের সভাপতিত্বে মিউনিসিপ্যাল স্কুল হলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ যোগদান করেছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে কুষ্টিয়ার সমস্ত রাস্তা ঘাট, অলি-গলির দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। এসময় শহরে অলিগলির দেয়ালে লাল রক্ত বর্ণে লেখা ছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'।

২২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া শহরে ছিল হরতাল। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী হত্যার খবর কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছামাত্র সমগ্র শহর চরম উত্তাল হয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীদের মাঝে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, অফিস আদালত সব স্থবির হয়ে পড়ে। রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সমগ্র শহরে তখন বারুদের মতো ফুটছে। এদিন কুষ্টিয়া কলেজ, কুষ্টিয়া ইংরেজি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদী মিছিল নেয় বের হয়। কেবল শিক্ষার্থীই নয়, তাদের সঙ্গে মিশে যায় সাধারণ জনতাও। সবার কণ্ঠে তখন একটাই স্লোগান। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'খুনি নুরুল আমীনের কল্লা চাই'।  বিক্ষোভ মিছিল শেষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের সামনে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। কুষ্টিয়া ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় ও একটি ভিন্ন প্রতিবাদসভার আয়োজন করে। সেই সভায় ঢাকায় শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশি গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দায়ীদের শাস্তি দাবী করে। একই সঙ্গে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি সমগ্র কুষ্টিয়া শহরে সর্বাত্মক ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। শহরের পথে পথে বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। মিছিল থেকে ছাত্রনেতা শাহিদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় শোকসভা। এসময় শিক্ষার্থীরা সরকারি দমনপীড়নের তীব্র সমালোচনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

এদিন বিকেলে ডা. মোহাম্মদ আবুল কাশেম আলীর সভাপতিত্বে কুষ্টিয়ার হাইস্কুল মাঠে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ২৫ হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা। 

১ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এই সমাবেশের সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত  প্রতিবেদনে বলা হয়, 'মোমিনপুর, ২৩শে ফেব্রুয়ারি,অদ্য স্থানীয় মোহাজেরিন এবং হিন্দু-মুসলমান প্রায়  ২৫ হাজার লোকের সমবায়ে এক বিরাট সভা হয়। সভায় ডাক্তার মোহাম্মদ কাছেম আলী সভাপতিত্ব করেন। সভায় মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের ফলে যাঁহারা শহীদ হইয়াছেন তাহাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁহাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। সভায় এইরূপ জুলুমের তীব্র প্রতিবাদ এবং এই জুলুম সম্পর্কে অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ী কর্মচারীদের আদালতে প্রকাশ্য বিচার দাবী করা হয়। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাবান এবং শহীদানের আত্মীয় স্বজনকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়। একটি প্রস্তাবে বর্তমান মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করা হয়।'

অন্যদিকে এদিন অ্যাডভোকেট আবদুল হকের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে একটি শোকসভার আয়োজন করা হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় 'এই সভা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ফ্যাসিস্টসুলভ দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে, এই শোচনীয় দুর্ঘটনার যথাযথ বেসরকারি তদন্তের ব্যবস্থা করা হউক। এই সভা আটক ছাত্রদের আশু মুক্তি দাবী করিতেছে।'    

২৪ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট আবদুল হকের সভাপতিত্বে কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল বাজারে  বিকেল ৪টায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শুরুর আগে ছাত্র জনতার এক বিশাল মিছিল শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সভায় যোগদান করে। এদিন কুষ্টিয়ার ছাত্র জনতা একযোগে এক মাইল দীর্ঘ এক শোভাযাত্রা বের করে। পরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের উদ্যোগে পৌরসভা মার্কেটের সামনে এক প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঢাকায় শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষণের নিন্দা এবং দোষীদের শাস্তি দাবী করে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দাবী করা হয়।  ২৪ ফেব্রুয়ারিতে কুষ্টিয়ার ভাষা আন্দোলনে কি কি কর্মসূচী পালন করা হয়েছিলো তা প্রকাশিত হয়েছিলো সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায়। 

২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কুষ্টিয়া শহরের মতো উত্তাল হয়েছিলো কুমারখালি, খোকসা, পোড়াদহ সহ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এসময় এসব অঞ্চলে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। বন্ধ ছিল সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

৮ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় খোকসায় সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে আন্দোলনের খবরও। প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'খোকসা ২৮ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুরুষের জুলুমের প্রতিবাদে এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে স্থানীয় উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ বিরাট মিছিল বাহির করিয়া স্থানীয় রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে। ওইদিন স্থানীয় বাজারদ্বয়ে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। অপরাহ্ণ স্কুল প্রাঙ্গণে বিরাট সভা হয়। মৌলভী সৈয়দ আলতাফ আলী সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, এবং গুলিবর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।'

৫ মার্চ কুষ্টিয়ার পোড়াদহ রেলওয়ে স্টেশনে স্কুলের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করে। একই সঙ্গে তারা ট্রেন চলাচলেও বাঁধা দেয়। সকাল ৬টা থেকে শিক্ষার্থীরা পিকেটিং করে। এদিন সকাল আটটায় হরতালের সমর্থনে শিক্ষার্থীরা মিছিল শোভাযাত্রা সহযোগে বের হয়। বিকেল ৪টায় মৌলভী খন্দকার মহিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। ৫ হাজারের বেশি জনতা সভায় যোগদান করেন।

কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৫৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে কুষ্টিয়ায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবায়ক আবদুল হকের সভাপতিত্বে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছিলেন সা'দ আহমেদ, সামছুল হুদা, শওকত আলী, আবদুল মতিন প্রমুখ।

আলোচনা সভার বৈঠকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু পড়ানোর অপতৎপরতার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। একই সঙ্গে ভাষা শহীদদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বাধ্যতামূলক উর্দু চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে প্রদেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলে প্রতিটি জেলায় উর্দুকে বয়কট করার আহ্বান জানানো হয়েছিলো।

সূত্র:

১. ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক

২. ভাষা আন্দোলন কোষ প্রথম খণ্ড/ এম আবদুল আলীম

৩. দৈনিক আজাদ ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

৪. দৈনিক আজাদ ১ ও ৮ মার্চ ১৯৫২

Comments

The Daily Star  | English

The psychological costs of an uprising

The systemic issues make even the admission of one’s struggles a minefield

8h ago