একুশের একাত্তর

ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ঢাকাতে ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও। এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান প্রমুখ।
একুশের একাত্তর/ ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি: গাজী সালাউদ্দিন

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে একুশ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১টি জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আমাদের আজকের অষ্টম পর্বে থাকছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা আন্দোলনের চিত্র।) 

 ভাষা আন্দোলনের দাপট স্পর্শ করেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াকেও। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবী জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে  গণপরিষদের মুসলিম লীগের সদস্যরা প্রস্তাবের বিরোধিতা  এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে ফুঁসে উঠেছিলো স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্র সমাজ।  গণপরিষদের ঘটনার প্রেক্ষিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন শুরু করেন। যা ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও। বলে রাখা ভালো ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরা ও বর্তমানের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামের সন্তান।

প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ব্যাপক তৎপরতা চালায়। ঢাকাতে ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও। এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান প্রমুখ। যদিও ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। 

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ। বিক্ষোভে শামিল হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাও। ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দোলন পরিচালনার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ছাত্রনেতা মতিউর রহমানকে আহ্বায়ক করে  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ, সামিউল আহমদ, খান ফটিক, লুৎফর রহমান, শফিউদ্দিন আহমদ, আবদুস সামাদ প্রমুখ। 

২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মূল দিনে পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছিল। এদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বত্র দোকানপাট বন্ধ ছিল। এদিন সকাল ১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিরাট শোভাযাত্রা বের করে। প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই শোভাযাত্রা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর প্রদক্ষিণ করে শহরের লোকনাথ ময়দানে সমবেত হয়।

২১ ফেব্রুয়ারিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কার্যক্রম প্রকাশিত হয়েছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সর্বত্র ধর্মঘট ও জনসভা' শীর্ষক শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২২শে ফেব্রুয়ারি। গতকল্য এখানে এবং মহকুমার সর্বত্র পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। বেলা ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত সমস্ত দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। বেলা ১০টা হইতে স্থানীয় সমস্ত শিক্ষালয়গুলির ছাত্র-ছাত্রীগণ এক বিরাট শোভাযাত্রা বাহির করে। শোভাযাত্রায় বহু লোক  এবং মফস্বল স্কুল সমূহের বহু ছাত্র যোগদান করে। প্রায় ৪ হাজার বিদ্যার্থীর এক বিরাট  শোভাযাত্রা সারা শহর প্রদক্ষিণ করিয়া লোকনাথ ময়দানে সমবেত হয়। সভায় বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার এবং আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার প্রচেষ্টার প্রতিবাদ দাবী জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।'

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় চালানো নিরীহ ছাত্রদের ওপর পুলিশি গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সমস্ত দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।

সকাল ১০টায় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা একটি শোক মিছিল নিয়ে পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর প্রদক্ষিণ করে। বিকেল সাড়ে ৪টায় নগরীর সেন্ট্রাল ব্যাংকের সামনে অনুষ্ঠিত হয় বিরাট জনসভা। এই জনসভায়  ঢাকায় নিরীহ শিক্ষার্থীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবী জানানো হয়। একই সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের দাবী জানানো হয়।

২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় 'পুলিশি জুলুমের সূক্ষ্ম তদন্ত ও বিচার দাবী'  শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ঘটনাবলী। প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২৪শে ফেব্রুয়ারি। গতকল্য এখানে ঢাকায় নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রী এবং জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলী চালনার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। এইদিন সমস্ত ব্যবসায়ী ও দোকানদার স্বেচ্ছায় তাহাদের দোকানপাট ও কাজকর্ম বন্ধ রাখে। রিক্সা, ঘোড়ার গাড়ী, গরুর গাড়ী, বাস প্রভৃতি এবং স্থানীয় সিনেমা হলগুলি বন্ধ থাকে। বেলা ১০টায় ছাত্র-ছাত্রী এবং জনসাধারণের সম্মিলিত এক বিরাট শোক শোভাযাত্রা শোক চিহ্ন ধারণ করিয়া সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। অপরাহ্ণ সাড়ে ৪ ঘটিকায় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় নৃশংস পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদ ও নুরুল আমীন মন্ত্রীসভার উপর অনাস্থা জ্ঞাপন, ঢাকায় নিহত ছাত্রদের জন্য ক্ষতিপূরণ, একটি সর্বোচ্চ শক্তি সম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দানের দাবী জানাইয়া কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরিশেষে শহীদ ছাত্রদের রুহ মোবারকের মাগফেরাতের জন্য মোনাজাত করা হয়।'

২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়াতে পালিত হয়েছিলো পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী হরতাল। যে হরতালের কার্যক্রম প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়।  'আখাউড়ায় পূর্ণ হরতাল শীর্ষক শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'আখাউড়া, ২৫শে ফেব্রুয়ারি।  ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে এখানে ৫ ঘণ্টাব্যাপী পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। স্থানীয় সমস্ত স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রহিয়াছে। পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করার জন্য বিভিন্ন জনসভায় এম.এল.এ'দের নিকট দাবী জানানো হয়।'

২৪ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের দাউদপুর হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করে। সভা শেষে শিক্ষার্থীরা স্লোগান সহযোগে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে।

১ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি দাউদপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্রদের এক বিরাট সভা হয়। প্রথমতঃ ঢাকায় যে সমস্ত ছাত্র গুলিবর্ষণের ফলে শহীদ হইয়াছে, তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। এবং তাহাদের রুহ মুবারকের মাগফেরাতের জন্য মোনাজাত করা হয়। সভাভঙ্গের পর ছাত্ররা এক শোভাযাত্রা বাহির করিয়া বিক্ষোভাত্মক ধ্বনিসহ বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে।'

৬ মার্চ প্রকাশিত আজাদ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২৯শে ফেব্রুয়ারি —-গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক পরিষদের এক জরুরি সভা হয়। সভায় ঢাকার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করিয়ে গিয়া যে সকল তরুণ মোজাহেদ অমূল্য জীবন হারাইলেন তাঁহাদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ এবং তাঁহাদের শোক-সন্তপ্ত মাতা পিতা ও আত্মীয়-স্বজনকে এই অপূরণীয় ক্ষতিতে আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। এক প্রস্তাবে অবিলম্বে এই গুলি বর্ষণের বিচারকল্পে ঢাকা হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভাইস -চ্যান্সেলর এবং জনগণের আস্থাভাজন কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি লইয়া এক জরুরী তদন্ত কমিশন গঠন এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিগণের যথোপযুক্ত শাস্তি দাবী করা হয়। অনতিবিলম্বে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান দাবী করিয়া অপর এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় আরও কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।'

 ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাষা আন্দোলন স্কুল কলেজের ছাত্র এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দ্বারা গড়ে উঠলেও শহরের আইনজীবী এবং সর্বস্তরের শহরবাসীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের কর্মসূচিই ছিল তার প্রমাণ।

১৩ মার্চ প্রকাশিত আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যগণ ২৬ ফেব্রুয়ারি এক সভায় ঢাকায় নিরস্ত্র ছাত্র ও জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা করা হয় এবং নিহত ব্যক্তিদের জন্য শোক ও তাহাদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতিদের দ্বারা ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্ত এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের দাবী জানাইয়াও সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়।'

সূত্র:

১. ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, আহমদ রফিক

২. ২৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২; দৈনিক আজাদ

৩. ১,৩,৬,১৩ মার্চ ১৯৫২;  দৈনিক আজাদ

Comments