মওলানা ভাসানী কুড়িগ্রামে ভাষা আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছিলেন
(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে ২১ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১ জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের ত্রয়োদশতম পর্বে থাকছে কুড়িগ্রামের ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)
ভাষা আন্দোলনের ছোঁয়া পৌঁছে গিয়েছিল উত্তরের তিস্তা বিধৌত জনপদ কুড়িগ্রামেও। কুড়িগ্রামে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বেই।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন এর বিরুদ্ধে তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সদস্যদের বিরোধিতা ও খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার আন্দোলনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল কুড়িগ্রামেও।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পূর্ব বাংলার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। কুড়িগ্রামের ছাত্ররা আন্দোলনে শামিল হয়।
১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করতে কুড়িগ্রামের ভাষা আন্দোলনের কর্মীরা কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের অলি-গলি, থানা ও গ্রামগঞ্জে ব্যাপক প্রচারণা চালান। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী কুড়িগ্রামে মোটামুটি সফলভাবে ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা ছিল কুড়িগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কুড়িগ্রাম জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষার্থী।
সেদিন তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল নিয়ে মহকুমা শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। তাদের কণ্ঠে ছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী অন্য জেলা বা মহকুমা শহরগুলোর মতো কুড়িগ্রাম সমানতালে অংশ নিতে পারেনি। কারণ, কুড়িগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তিস্তা বিধৌত এই জনপদের সঙ্গে যোগাযোগ স্বল্পতা কুড়িগ্রামকে অনেকটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।
অন্যদিকে মহকুমা শহরগুলোয় মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলেও কুড়িগ্রামে গঠন হতে কিছুটা দেরি হয়। ফলে ১১ মার্চের আন্দোলন কুড়িগ্রামে পরিচালনা করেছিল স্কুলের ছাত্ররাই। কুড়িগ্রামে প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলন শুরুর দিকে এর বিস্তৃতি মূলত পেয়েছিল হাইস্কুলের ছাত্রদের মাধ্যমে। তাদের মধ্যে কুড়িগ্রাম হাইস্কুলের ছাত্র আমান উল্লাহ, আলী আফসার, আবুল ফজল, আফজাল হোসেন, মোস্তফা বিন খন্দকার ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কুড়িগ্রামের স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে কাজী এমদাদুল হককে আহ্বায়ক করে কুড়িগ্রামের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় মিয়া আবদুল হাফিজকে।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, রিয়াজ উদ্দিন ভোলা, মিয়া হাফিজ ভেংরা, মনির উদ্দিন আহমেদ, সোলেমান আলী, আবুল মনসুর সরকার, আবদূর রহমান মোক্তার, কাজেম মোক্তার প্রমুখ।
কুড়িগ্রামে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পরে কুড়িগ্রামে ভাষা আন্দোলন সাংগঠনিকভাবে পরিচালিত হতে শুরু করে। কুড়িগ্রামে আন্দোলনকারীদের আড্ডার স্থান ছিল শহরের সত্যেন বাবুর চায়ের স্টল ও আম্মাজি হোটেল।
ভাষা আন্দোলনকারীরা আন্দোলনকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে দেয়ালে দেয়ালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পোস্টারিং করেন ও লিফলেট বিতরণ করেন। একই সঙ্গে কুড়িগ্রাম মহকুমার অধীনে থানাগুলোয় প্রচারণা চালানো হয়।
১৯৪৮ সালের মে মাসে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কুড়িগ্রাম সফর করেন। এটি কুড়িগ্রামের নেতাকর্মীদের ভীষণভাবে উজ্জীবিত করেছিল। মওলানা ভাসানী তখন কুড়িগ্রাম সদর, বামনডাঙ্গা, ভুরুঙ্গামারিসহ বেশ কয়েকটি স্থানে জনসভা করেছিলেন। সেসময় তার সফরসঙ্গী ছিলেন শামসুল হক ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
ভাসানীর সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয়েছিল। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছিলেন। মওলানা ভাসানীর এমন বক্তব্যে কুড়িগ্রামের সর্বত্র বাংলা ভাষার স্বপক্ষে অঘোষিত জনপদ গঠন হয়ে যায়। সেখানে জোরেশোরে বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে।
১৯৪৮ সালের নভেম্বরে কুড়িগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কুড়িগ্রাম মহকুমার শাখা প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বক্তব্য দেন খয়রাত হোসেন, মতিউর রহমান প্রমুখ। তারা ছাত্রসমাজকে উজ্জীবিত করতে ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে সাংগঠনিক কাজে কুড়িগ্রামে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেসময় তিনি স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' ঘোষণার মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের অন্যান্য শহরের মতো কুড়িগ্রামের মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি কুড়িগ্রামে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে কুড়িগ্রামে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট হয়। সেদিন ছাত্ররা মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান রাস্তা প্রদক্ষিণ করে।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রহত্যার সংবাদ কুড়িগ্রামে পৌঁছামাত্রই সেখানকার ছাত্রনেতারা হাবিবুর রহমান খোকার বাসায় জরুরি বৈঠক করেন। মোস্তফা বিন খন্দকারের সভাপতিত্বে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রেজা হোসেন খন্দকার, হাবিবুর রহমান, আলী আসাদ, আয়নুল হক, এটিএম আফজাল, আবদুল জলিল প্রমুখ।
সভায় ঢাকায় ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে সর্বাত্মক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর ঢোল পিটিয়ে মহল্লায় মহল্লায় প্রচারণা চালানো হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে কুড়িগ্রামের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে আসে। তারা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'নুরুল আমীনের পদত্যাগ চাই', 'ছাত্র হত্যার বিচার চাই'সহ নানান স্লোগানে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায়।
কুড়িগ্রাম শহর কয়েকবার প্রদক্ষিণের পর ছাত্রদের মিছিল যখন কুড়িগ্রামের জাহাজ কোম্পানির মোড় পার হচ্ছিল তখন মুসলিম লীগ নেতার নির্দেশে পুলিশ ছাত্রদের সেই মিছিলে লাঠিচার্জ শুরু করে। লাঠিচার্জের একপর্যায়ে ছাত্ররা ইটপাটকেল ছুঁড়তে শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।
একপর্যায়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আন্দোলনকারীরা কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে যান। সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও শোকসভায় বক্তব্য দেন আবদুল হামিদ, আবদুল আহাদ, আব্দুল্লাহ হেল বাকী, হাবিবুর রহমান খোকা, বাদল রুদ্র প্রমুখ।
সেদিন কুড়িগ্রাম হাইস্কুলে শোকসভা হয়। সভায় অনেকের মধ্যে বক্তব্য দেন শামসুল হক, আবদুস সামাদ, আমানউল্লাহ, আজিজুল হক, ওসমান আলী, চিত্ত পাল ও আবদুল হামিদ।
২২ ফেব্রুয়ারি মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন ভাষা সংগ্রামী ও তৎকালীন কুড়িগ্রাম জুনিয়র হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র একেএ সামিউল হক। তিনি বলেন, 'ছাত্র জনতার মিছিলটি জাহাজ কোম্পানি মোড় পার হয়ে মুসলিম লীগ নেতা পনির উদ্দিনের বাড়ির সামনে এলে তিনি মিছিলকারীদের দিকে তেড়ে এসে বলেন, 'পাকিস্তান পাইছ, তোমরা সেটাকে ধ্বংস করতে চাও। আমরা মুসলমান, আমাদের ভাষা হবে উর্দু।'
'তিনি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পুলিশকে মিছিল ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেন।'
২৪ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম হাইস্কুল ছাত্রদের উদ্যোগে ছাত্র সমাবেশ হয়। সেখানে অন্যান্য স্কুলের ছাত্ররাও উপস্থিত ছিল। সেদিন ছাত্রদের মিছিল কুড়িগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে এসে শেষ হয়। মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের বিড়ি শ্রমিকরাও।
কুড়িগ্রামের ভাষা আন্দোলনে পালাগানের দল, যাত্রা দল ও বাউলদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। তাদের পরিবেশনায় হাস্যরসাত্মক সংলাপের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে দাবি তুলে ধরতেন। কুড়িগ্রামে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে অবদান রেখেছিলেন জুলহাস উদ্দিন, আলী আমজাদ, অজিত কুমার রায় প্রমুখ।
২৪ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম শহরে ব্যাপক পুলিশি টহল পরিচালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতাকারী মুসলিম লীগ নেতা এমএনএ পনির উদ্দিন ও নজির হোসেন খন্দকার প্রকাশ্যে মাঠে নামেন। সেসময় মুসলিম লীগের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ ছাত্রনেতাদের ধরতে নিয়মিত তাদের বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে কুড়িগ্রামের ছাত্রনেতাদের দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচতে আন্দোলনের নেতাকর্মীরা বহুদিন পর্যন্ত দূরের আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
কুড়িগ্রামে মুসলিম লীগের আধিপত্য থাকায় ভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের অনেককে অনেক হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছিল। ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের গওহর পার্ক মাঠে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন কুড়িগ্রামের ভাষা আন্দোলনকারীরা।
তথ্যসূত্র: ভাষা আন্দোলন/ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক
ভাষা আন্দোলন কোষ প্রথম খণ্ড/ এম আবদুল করিম
Comments