একুশের একাত্তর

ঢাকায় ছাত্রহত্যার সংবাদ পেয়ে উত্তাল দিনাজপুর

দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলন
দিনাজপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে ২১ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১ জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের অষ্টাদশতম পর্বে থাকছে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)

ভাষা আন্দোলনের তীব্র স্রোত পৌঁছে গিয়েছিল উত্তরের জনপদ দিনাজপুরেও। দিনাজপুর বরাবরই ছিল রাজনীতি সচেতন। এখানে ছিল বাম মতাদর্শের তীব্র প্রভাব।

রাজনৈতিক পরিবেশের কারণেই পরবর্তীতে দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ১৯৪৮ সালেই সূচনা হয়েছিল দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনের।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবে তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সদস্যদের বিরোধিতা ও খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মতো গর্জে উঠেছিল দিনাজপুরের ছাত্রসমাজও।

সেসময় দিনাজপুরের বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৩ মার্চ দিনাজপুর শহরে হরতাল হয়। মিছিল থেকে স্লোগান উঠেছিল—'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'।

ছাত্রদের মিছিল দিনাজপুর শহরের প্রধান রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে।

মিছিল শেষে সেদিন বিকেলে কংগ্রেস ময়দানে বিশাল জনসভা আয়োজিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন খান বাহাদুর আমিনুল হক।

২১ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরে হরতাল ও ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। শহরের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সকাল থেকেই শহরের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলগুলো দিনাজপুর শহরের প্রধান রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে মাদ্রাসা ময়দানে এসে শেষ হয়।

কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী, ১১ মার্চকে আন্দোলনের মূল দিন হিসেবে ধরে দিনাজপুরে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সেদিনের কর্মসূচি সফল করতে দিনাজপুরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীরা টিনের চোঙা ফুঁকে প্রচার চালান। একই সঙ্গে নগরীতে পোস্টারিং করা হয়, বিলি করা হয় লিফলেট।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দিনাজপুরের প্রশাসন ও জেলা প্রশাসক ১১ মার্চের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে।

১১ মার্চ দিনাজপুর শহরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তাদের মিছিলে যোগ দেন দিনাজপুরের সর্বস্তরের জনতা। মিছিলটি দিনাজপুর শহরের প্রধান রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মীর্জা নুরুল হুদা ছোটি।

পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করলে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। মিছিল থেকে আন্দোলনের নেতা মীর্জা নুরুল হুদা ছোটি, দবিরুল ইসলাম, আসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও গোলাম রহমানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে আটক করে। তাতেও আন্দোলন থামেনি।

আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে সামনের সারিতে চলে আসেন দিনাজপুরের ছাত্রনেতা আবদুল হক, মুস্তাফা নুরুল ইসলাম, মতিউর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।

পরবর্তী ৪ বছরে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনে নানা পরিবর্তন হয়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ছাত্রনেতা আবদুল হাফিজ, মোহাম্মদ ফরহাদ, মোহাম্মদ নাসিম, দলিলউদ্দিন প্রমুখ।

শুধু দিনাজপুর শহরই নয়, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সেখানকার প্রত্যন্ত জনপদেও। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, পাঁচদোনা ও বক্তারপুরে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একাধিক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিলেন।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ। বিক্ষোভে শামিল হয় দিনাজপুরের বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাও।

মিছিল শেষে দিনাজপুরে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় বক্তব্য দেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হাজী মোহাম্মদ দানেশ, গুরুদাশ তালুকদার, আবদুল রহিম, মীর্জা নুরুল হুদা, আসলেহ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

১০ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরে মীর্জা নুরুল হুদার সভাপতিত্বে জনসভায় ছাত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। দিনাজপুর শহরে গোপনে পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করা হয়।

কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্দোলনের মূল দিন হিসেবে ধরে নিয়ে দিনাজপুরের ছাত্র-জনতা গোপনে প্রচারণা চালান। এ কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আবদুর রহিম।

মূল আন্দোলনের দিনকে সফল করতে দিনাজপুরে প্রতিদিনই সমাবেশ হয়েছিল।

২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন দমন করতে দিনাজপুরের বিচলিত জেলা প্রশাসন ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শহরে ১৪৪ ধারা দিয়ে সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে। এই নিষেধাজ্ঞায় বিচলিত না হয়ে সবাই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরে হরতাল ও ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। শহরের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সকাল থেকেই শহরের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলগুলো দিনাজপুর শহরের প্রধান রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে মাদ্রাসা ময়দানে এসে শেষ হয়।

সেদিন দিনাজপুর জেলা স্কুল মাঠে মাহমুদ আল মোকাররম হোসেনের সভাপতিত্বে জনসভা হয়। সভায় বক্তব্য দেন মীর্জা নুরুল হুদা, আসলেহ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল হাফিজ প্রমুখ।

জনসভা শেষে সন্ধ্যায় ছাত্র-জনতার মিছিল থেকে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা।

কেবল দিনাজপুর শহরই নয়। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের পার্বতীপুরেও নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। সেদিন সকাল ১০টার দিকে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-জনতার মিছিল পার্বতীপুরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে পার্বতীপুর হাইস্কুল মাঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জনসভা হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি পার্বতীপুরের আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ ফেব্রুয়ারির দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পার্বতীপুর (দিনাজপুর), ২২শে ফেব্রুয়ারী। গতকল্য বেলা ১০ ঘটিকার সময় প্রায় ৫ হাজার ছাত্রছাত্রী ও জনসাধারণ সমবায়ে এক বিরাট শোভাযাত্রা পার্বতীপুরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এইদিন সমস্ত দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হরতাল পালন করে। অতঃপর পার্বতীপুর হাইস্কুলের খেলার মাঠে এক বিরাট সভা হয়। সভায় পাক প্রধানমন্ত্রী জনাব খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবকে তাঁহার চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করিয়া বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য অনুরোধ করা হয়। গণভোটের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলা নির্ধারণের দাবী করিয়া কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়।'

ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রহত্যার সংবাদ দিনাজপুরে পৌঁছায় ২২ ফেব্রুয়ারি। ছাত্রহত্যার সংবাদ পৌঁছামাত্র দিনাজপুর শহরে ছাত্র-জনতার বাঁধ ভাঙা মিছিল বের হয়। উত্তাল হয়ে উঠে দিনাজপুর। মিছিলে ছিল একইসঙ্গে শোক, ক্রোধ ও তীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ।

আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহর ছাড়িয়ে সংলগ্ন এলাকায়ও। ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিলে যোগ দেয় শ্রমজীবী থেকে সর্বস্তরের জনতা। মিছিলে ছিল, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'নুরুল আমীনের রক্ত চাই', 'মন্ত্রিসভা গদি ছাড়'সহ নানান স্লোগান।

মিছিল শেষে দিনাজপুরে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় বক্তব্য দেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হাজী মোহাম্মদ দানেশ, গুরুদাশ তালুকদার, আবদুল রহিম, মীর্জা নুরুল হুদা, আসলেহ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে দিনাজপুর পরিণত হয় মিছিলের শহরে। পুলিশ আন্দোলনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যন্ত এলাকাতেও।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রহত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ২৯ ফেব্রুয়ারির দৈনিক আজাদ পত্রিকায়।  প্রতিবেদনে বলা হয়, 'দিনাজপুর, ২৪শে ফেব্রুয়ারী।— এখানে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" দাবীতে ছাত্ররা কিছুদিন ধরিয়া শোভাযাত্রা এবং সভা করিয়া আসিতেছিল। ঢাকার ছাত্রদের শাহাদাতের কথা এখানে পৌঁছানোমাত্র সিনেমা হল ও অন্যান্য দোকানপাট বন্ধ হয় এবং সমস্ত শহরে এক গভীর শোকের ছায়া পতিত হয়। পরের দিনও পূর্ণ হরতাল পালন করা হয় এবং মাঠে মুসলিম লীগ সেক্রেটারীর সভাপতিত্বে এক বিরাট সভা হয়। সভায় "রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই" দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। শহীদানের জন্য শোক প্রকাশ ও তাদের রূহের মাগফেরাৎ কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। ঠাকুরগাঁ, সেতাবগঞ্জ, ফুলবাড়ী, হিলি, পার্বতীপুর প্রভৃতি মফস্বল হইতেও অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে।' 

দেবীগঞ্জের ২২ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট নিয়ে পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ২৯ ফেব্রুয়ারির আজাদ পত্রিকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'দেবীগঞ্জ, ২৩ শে ফেব্রুয়ারী। অদ্য স্থানীয় স্কুলের ছাত্ররা ঢাকায় ছাত্রীদের উপর গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করে। স্থানীয় ছাত্ররা বিরাট মিছিল সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঢাকায় নিরীহ ছাত্রদের উপর এই জুলুমের তীব্র প্রতিবাদ, গুলীবর্ষণ সম্পর্কে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবী জ্ঞাপন করিয়া কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় শহীদদের রূহের মাগফেরাত কামনা করা হয়।'

১৯৫৩ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা দিনাজপুরের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করেন।

তথ্যসূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া'/ আহমদ রফিক

৪, ১৩ ও ১৭ মার্চ ১৯৪৮ এবং ২৪, ২৭, ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, দৈনিক আজাদ

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago