সংস্কারের নামে ৩০০ বছরের পুরোনো সতীদাহ মন্দিরের আদিরূপ বদল
সংস্কারের নামে চুনকাম করে ইতিহাসের অমানবিক এক প্রথার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার ৩০০ বছরের পুরোনো সতীদাহ মন্দিরের আদিরূপ বদলে ফেলেছে উপজেলা প্রশাসন।
মন্দিরটির অবস্থান নবীনগর উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার পূর্বে বিদ্যাকুট গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও লোকসংস্কৃতি গবেষকদের ভাষ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরটি সংস্কারের জন্য সম্প্রতি নবীনগর উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগী হয়। এক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের কোনো পরামর্শ ছাড়াই মন্দির পরিষ্কার করে তাতে চুনকাম করা হয়।
তারা বলছেন, এভাবে সংস্কারের কারণে মন্দিরটি আদিরূপ নষ্ট হয়ে গেছে।
আর এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভাষ্য, মন্দিরটি অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত নয়। যারা সংস্কারের কাজটি করেছেন তারা ঠিকভাবে এটি করেননি। কারণ সংস্কারের নামে কোনো পুরাকীর্তির আদিরূপ বদলে ফেলা যায় না।
সতীদাহ প্রথা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করার এক অমানবিক প্রথা। মূলত এই প্রথাটি ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির দখল নিতে এবং পারিবারিক মানসম্মান নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা সদ্য বিধবা হওয়া নারীকে জোর করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারতেন।
রাজা রামমোহন রায় ১৮১২ সালে সতীদাহবিরোধী সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। ১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার গভর্নর হয়ে আসলে রামমোহন রায় তার কাছে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য আবেদন করেন। পরে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস করেন লর্ড বেন্টিঙ্ক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা তথ্য বাতায়নে দেওয়া তথ্য অনুসারে, বিদ্যাকুট গ্রামের প্রসিদ্ধ হিন্দু জমিদার দেওয়ান বাড়ির বাসিন্দা দেওয়ান রাম মানিক সতীদাহ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতার বিখ্যাত সাংবাদিক অনিলধন ভট্টাচার্যের জন্ম এই বিদ্যাকুট গ্রামে। অনিলধন ভট্টাচার্য রচিত 'শাশ্বত ত্রিপুরা' গ্রন্থেও এই সতীদাহ মন্দিরের কথা উল্লেখ আছে।
এই গ্রন্থে বিদ্যাকুট গ্রামটিকে ত্রিপুরা রাজ্যের 'নবদ্বীপ' বলে অভিহিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদ্যাকুট ছাড়াও আশপাশের মেরকুটা, সেমন্তঘর, শিবপুর ও বাঘাউড়া গ্রামের হিন্দুরা সতীদাহের জন্য এই মন্দিরটি ব্যবহার করতেন। আইন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ করার পরেও এখানে সতীদাহের ঘটনা ঘটে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপনের মতে, বিদ্যাকুট গ্রামের সতীদাহ মন্দিরটির বয়স ৩০০ বছরের বেশি। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি গ্রামের এক গৃহবধূ বনলতা দেবীর কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকারের একটি চিঠি সংগ্রহ করেন। তৎকালীন ত্রিপুরার রাজার কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে সতীদাহ প্রথা বন্ধের নির্দেশ ছিল।
স্বপন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১০০ বছরের পুরোনো স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করে থাকে। কিন্তু এটিকে এখনও পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি।'
মন্দিরটি এ এলাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, 'না বুঝে অপরিকল্পিত উপায়ে সংস্কার করার কারণে মূল্যবান এই নিদর্শনটির আদিরূপ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নষ্ট হয়েছে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মন্দিরটি অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত নয়। এটি সম্পর্কে আমার জানাও ছিল না। স্থাপনাটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা যায় কিনা দেখব।'
এত দিনেও কেন এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কার্যালয়ে লোকবল সংকট রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ বিষয়ে এখনো পুরোপুরি জরিপের (সার্ভে) কাজ সম্পন্ন করা হয়নি। এই কাজটি সময় সাপেক্ষ এবং এটি করতে দক্ষ জনবলের দরকার।
এই কর্মকর্তা বলেন, জেলা পরিষদ আইনে স্থানীয়ভাবে পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করার কথা বলা আছে। তারাও এটি সংরক্ষণ করতে পারতেন। কেন তারা সেটি আজও পর্যন্ত করেননি, এটি তারা বলতে পারবেন।
এমন প্রাচীন একটি স্থাপনাকে এভাবে সংস্কার করা যায় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'যারা এমনটি করেছেন তারা ঠিক করেননি। কারণ পুরাকীর্তির আদি রূপকে বদলে ফেলা যায় না। চুনকাম যারা করেছেন তাদের উচিত ছিল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা নেওয়া।'
বিদ্যাকুট গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি সদস্য মো. ছানাউল্লাহ জানান, যে পরিবার এই মন্দির নির্মাণ করেছিল তারা বহু আগে দেশত্যাগ করেছেন। তবে এখনও টিকে আছে মন্দিরটি। দীর্ঘদিন এটি পরগাছায় আচ্ছাদিত ছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন মনে করেন, 'সতীদাহ প্রথার সেই কালো অধ্যায় সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্মকে জানাতে প্রাচীন এই মন্দিরটির আদিরূপ অক্ষুন্ন রেখে এর রক্ষণাবেক্ষণ দরকার।'
গ্রামের শত বছরের পুরোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যাকুট অমর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিল্লাল মিয়া চৌধুরী বলেন, 'রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করে ধর্মান্ধতা, কূপমন্ডুকতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও মধ্যযুগীয় বর্বরতার অন্ধকার পথ থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। সেই যুগ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হলে এই নিদর্শনটি টিকিয়ে রাখতে হবে।'
নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ একরামুল সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় এই মন্দিরটি আগাছায় পূর্ণ ছিল। প্রায় দেড় বছর আগে বিদ্যাকুটের সাবেক চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এটিকে লাল-সাদা রঙে রাঙানোর পাশাপাশি একটি সাইনবোর্ড লাগিয়েছে।'
কোনো পুরাকীর্তির আদিরূপ পরিবর্তন করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে এটি করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করেনি।'
তবে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই সতীদাহ মন্দিরটির চুনকাম করতে তৎকালীন উপজেলা প্রশাসন অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। আমরা শুধুমাত্র দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করেছি।'
Comments