মুক্তিযুদ্ধ ও পপসম্রাট আজম খান

বাবা কিছুক্ষণ আজম খানের দিকে তাকিয়ে কেবল একটা কথাই বললেন, ‘যুদ্ধে যাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ফিরতে পারবি না।’
আজম খান। ছবি: সংগৃহীত

তখন বয়স আর কত হবে? বড়জোর ১৭। নবম শ্রেণির কিশোর সদ্য পা রেখেছে দশম শ্রেণিতে। পরের বছরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা। বাড়ির সবাই চায়, সে পড়ায় মনোযোগ দিক। কিন্তু ভীষণ ডানপিটে হয়ে উঠেছে সে। স্কুল ফাঁকি দেয় প্রচুর।

ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। ২ সহপাঠীর সঙ্গে স্কুল পালিয়ে সেই কিশোর গেল পল্টন ময়দানে। সেখানে তখন চলছিল 'ক্রান্তি' নামের নতুন এক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ভীষণ আগ্রহে চুপচাপ একপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এমন সময় মঞ্চে শিল্পীরা গাইতে লাগলেন 'ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে'। সেই কিশোর মঞ্চে আবিষ্কার করল শিল্পী আলতাফ মাহমুদকেও।

মুহূর্তেই ডানপিটে কিশোরের শরীরে খেলে গেল কী এক অজানা শিহরণ! তার মনন জুড়ে তখন একটাই চাওয়া, যে করেই হোক জুটতে হবে এখানে। পরদিন আবারও স্কুল ফাঁকি দিয়ে পল্টন ময়দানে হাজির হলো সে। মঞ্চে তখন চলছে নৃত্যনাট্য 'জ্বলছে আগুন খেতে ও খামারে।' সেই দুরন্ত কিশোর সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো। এ জগতেই হবে তার নতুন ঠিকানা।

এমনি করেই বছর পেরিয়ে গেল। ১৯৬৮ সাল। পরিবারের চাপে পড়ে কোনোক্রমে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে প্রশান্তি। অপেক্ষা না করেই ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর অফিসে ছুটে গেল সে। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। কিশোরের অধীর আগ্রহ দেখে বললেন, 'গান গাইতে পার?'

'কিছুটা পারি।'

 'ঠিক আছে, গাও তবে।'

কিশোর গাইতে লাগল, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।' শুনে মুগ্ধ হলেন আলতাফ মাহমুদ, বুঝলেন একে দিয়ে চলবে। এভাবেই সঙ্গীতের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হয়েছিলেন সেদিনের কিশোর আজম খান।

বহু বছর পর সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজম খান বলেছিলেন, 'কত জেলায় জেলায় ঘুরেছি তখন। গান করেছি। আবার পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়ও দিয়েছি। তারপরেও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান করা থামাইনি।'

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে আজম খান অবস্থান নিয়েছিলেন পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে। গণঅভ্যুত্থানে তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল গান, নাচ আর নাটক। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর সত্তরের নির্বাচন আমূল পাল্টে দিয়েছিল কিশোর আজম খানের মনোজগত।

তখনই তিনি বুঝেছিলেন, সংগ্রাম আসন্ন। বুঝতে পেরেছিলেন, গান হতে পারে প্রতিবাদের বড় হাতিয়ার। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনেও ক্রান্তি আর আজম খান হাজির হয়েছিলেন গান, নাচ আর নাটক নিয়ে। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে সমগ্র দেশ ঘুরে গান গাইতে গাইতে দেখতে পেয়েছিলেন আদর্শের প্রতিফলন।

মূলত স্রোতের প্রতিকূলে এসব অভিযাত্রাই আসন্ন যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিল আজম খানকে। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর পাকাপাকিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনাকে বিদায় জানালেন আজম খান।   

দুয়ারে তখন মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত। পৈত্রিক বাড়ি কমলাপুরে তখন আজম খান। তিনি পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে এলাকার সামনে ব্যারিকেড তৈরি করলেন। বাঁশ-লাঠি যা আছে তাই নিয়ে যেভাবেই হোক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের ভারি অস্ত্রের সামনে সেই প্রতিরোধ কতক্ষণই বা টেকে!

আজম খান পরে সেই স্মৃতি মনে করতে গিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'অস্ত্র জোগাড় করছিলাম, মিলিটারি ঠেকাব তাই। কিন্তু তখন কি আর জানতাম পাকিস্তানি মিলিটারি ট্যাঙ্ক নামাবে? রাতের বেলা শুরু হলো গোলাগুলি। ব্যারিকেড কোথায় উড়ে গেল!'

রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা আজম খান। ছবি: সংগৃহীত

তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। তরুণ-যুবকদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যেত পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনী বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পাঁচিল টপকে পালাতেন আজম খান। এভাবে কয়েক মাস চলার পর তার মনে হলো, লুকোচুরি খেলে এভাবে আর কতদিন থাকবেন? তারচেয়ে যুদ্ধে যাওয়া ভালো। ইতোমধ্যে তার বেশ কয়েকজন বন্ধু যুদ্ধে চলে গেছেন।

আজম খান মাকে গিয়ে বললেন, 'মা, আমি যুদ্ধে যাব।' জবাবে মা বললেন, 'আমি জানি না, তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর।'

সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন ভীষণ রাশভারী। তার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কথা ভাবতেই গলা শুকিয়ে এল আজম খানের। যদি শুনেই চড় বসান বাবা! কিন্তু অবশেষে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে 'আমি যুদ্ধে যেতে চাই' বলে ফেললেন আজম খান। শুনে বাবা কিছুক্ষণ ডানপিটে ছেলের দিকে তাকিয়ে কেবল একটা কথাই বললেন, 'যুদ্ধে যাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ফিরতে পারবি না।'

পরদিন ভোরে ৩ বন্ধুকে নিয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু করলেন আজম খান। পুবাইল, কালিগঞ্জ, ঘোড়াশাল, নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে টানা ২ দিন হাঁটার পর অগত্যা আগরতলা পৌঁছালেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আগ্রহী তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য মেলাঘরে খোলা হয়েছিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। মেলাঘর পৌঁছাতেই পুরনো কয়েকজন বন্ধুবান্ধব তাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন।

সেখানেই আজম খানের প্রথম পরিচয় হলো শাফী ইমাম রুমীর সঙ্গে। খুব দ্রুতই ২ জনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। রুমীর হাতেই প্রথম প্রশিক্ষণে হাতেখড়ি আজম খানের। এর মধ্যে ঢাকা প্লাটুনের রুমীরা অপারেশন করতে ঢাকায় চলে গেলেন। কদিন বাদেই খবর এল, রুমীরা বেশ কয়েকজন মিলিটারির হাতে ধরা পড়েছেন।  

এর কিছুদিনের মাথায় প্রশিক্ষণ শেষ হলো আজম খানদের। গেরিলা আক্রমণের জন্য কতখানি প্রস্তুত তা পরখ করার জন্য তাদের পাঠানো হলো সালদা নদী রণাঙ্গনে।

রণাঙ্গনে আজম খান ছিলেন নির্ভীক। গান গাইতে গাইতেই যুদ্ধ করতেন। সেদিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজম খান বলেছিলেন, 'আমি বেশিরভাগ সময় গান গাইতাম আর যুদ্ধ করতাম। সে সময় কিশোর কুমার ছিলেন হিট। তার গানই বেশি গাওয়া হতো। হিন্দি-বাংলা কত গান করছি আর গুলি চালাইছি! এমনও হয়েছে গুলি করছি, গান গাইছি, আবার মুড়ি-মুড়কি চিবাচ্ছি। আমার গান শুনে পাশ থেকে সহযোদ্ধারা বলত – ওই গান থামা, পাক সেনারা শুনলে বুইঝা যাইব তুই কই আছস। তোর মরণের ভয় নাই নাকি? আমি বলতাম, আরে মরবই তো, ভয় পাওয়ার কী আছে! গান গাইয়া লই।'

এরপর আজম খানকে ঢাকা প্লাটুনের সঙ্গে পাঠানো হয় ঢাকায়। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ২ নম্বর সেক্টরের একটি সেকশন ইনচার্জের। সেকশন কমান্ডার হয়ে এ সময় ঢাকা ও চারপাশের বেশ কয়েকটি দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন আজম খান। এরমধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপারেশন ছিল 'অপারেশন তিতাস'। এ অপারেশনে ডেমরার পাশে তিতাস গ্যাসের একটা পাইপ লাইন বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ৩০টিরও বেশি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আজম খান।

আজম খান যুদ্ধে যাওয়ায় তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নেমে এসেছিল নির্যাতন ও নিপীড়ন। বাড়ির সামনের এক দোকানদার তার কাছে দেড়শ টাকা পেতেন। কিন্তু আজম খান যুদ্ধে চলে যাওয়ায় তা আর শোধ করতে পারেননি। ফলে সেই দোকানদার প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পাকিস্তানিদের তার বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিলেন।

পাকিস্তানিরা প্রায়ই তার বাবাকে জিজ্ঞেস করত, 'আজম কাহা হ্যায়?' জবাবে তার বাবা বলতেন, 'আজম নেহি হ্যায়।' আজম খানের মা ভালো উর্দু বলতে পারায় তিনি সেনাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মিটিয়ে নিতেন। কিন্তু তাতেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। আজম খানের ব্যাপারে তথ্য বের করার জন্য তার ছোট ভাইকে ছাদে উল্টো করে ঝুলিয়ে পিটিয়েছিল হানাদার সেনারা।

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আজম খানের ভাই আলম খান ও মোহন খানকে জেরা শুরু করল হানাদাররা। জানাল, খোঁজ না দিলে তাদের মেরে ফেলা হবে। এমন সময় আজম খানের বাবা বললেন, 'আমার ছেলেদের মেরে ফেললে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ!' ঠিক এমন সময় ভারতীয় বাহিনীর বোমাবর্ষণ শুরু হলে তাদের ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।

যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসার পর আজম খানের শুরু হলো এক নতুন যুদ্ধ। সে যুদ্ধের নাম সঙ্গীত যুদ্ধ। যেখানে তার হাতিয়ার ছিল গান আর গিটার। সে অধ্যায়ের সঙ্গে তো আমরা সবাই পরিচিত। সেই যুদ্ধই বাংলা পপ সঙ্গীতের অবিসংবাদিত সম্রাট হিসেবে পরিণত করেছে আজম খানকে।  

এক যুগ আগে আজকের দিনে চলে গিয়েছিলেন পপসম্রাট ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খান। তবে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন তার বিপ্লবী চেতনা আর গানের মধ্য দিয়ে।

তথ্যসূত্র:

History of Bangladesh Rock: The Legacy of Azam Khan/ Maqsoodul Haque

Rock star looks back with nostalgia/ Ershad Kamol: The Daily Star

Comments