যুবরাজ শাহ জাহানের ঢাকা অভিযান

সম্রাট শাহ জাহান। ছবি: সংগৃহীত

মুঘল সম্রাট শাহ জাহান তাজমহল নির্মাণের জন্য সুপরিচিত, তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে সিংহাসনে আরোহণের অনেক আগে তিনি এক সপ্তাহ ঢাকায় কাটিয়েছিলেন।

তখন শাহ জাহান ছিলেন একজন শাহজাদা—যার নাম ছিল যুবরাজ খুররম। এ সময় তিনি তার পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। সম্রাটের প্রভাবশালী স্ত্রী নূর জাহান রাজদরবারে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং শাহ জাহান সম্রাট হলে তিনি ক্ষমতা হারাতে পারেন—এমন ভয় তার ভেতর কাজ করত। ১৬২২ সালের এপ্রিলে, তিনি তার মেয়ে ল্যাডলি বেগমকে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে বিয়ে দেন; এই আশায় যে তার মাধ্যমে তিনি তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবেন।

শাহ জাহানকে কোণঠাসা করতে নূর জাহান পারস্যের শাহ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর মোকাবিলায় তাকে কান্দাহারে পাঠানোর জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীরকে রাজি করান। কিন্তু যুবরাজ এই পরিকল্পনা বুঝতে পেরে সেখানে যেতে অস্বীকার করেন; যা ছিল কার্যত বিদ্রোহ। তিনি দাক্ষিণাত্যে সৈন্য জড়ো করেন, কিন্তু পরাজিত হওয়ার পর পূর্ব দিকে বাংলার দিকে পালিয়ে যান। নদীবিধৌত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলা বিদ্রোহীদের জন্য একটি প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল ছিল। ১৬২৩ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তার ছোট সেনাবাহিনী নিয়ে উড়িষ্যায় প্রবেশ করেন।

দিল্লির মুঘল দরবার অবিলম্বে বিষয়টি নিয়ে ঢাকার সুবাদার (গভর্নর) ইব্রাহিম খানকে সতর্ক করে। তাকে উড়িষ্যার সুবাদার আহমদ বেগ খানের ওপর নজর রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু শাহ জাহান যখন উড়িষ্যায় প্রবেশ করেন, তখন আহমদ বেগ কিছুই করেননি। এর পরপরই যুবরাজ বর্ধমানে চলে যান, সেখানকার দুর্গ দখল করেন এবং মুঘল প্রশাসনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন।

ইব্রাহিম খান দ্রুত পদক্ষেপ নেন। তিনি যশোর, ত্রিপুরা, ভোলা, সিলেট, ফুলডুবি এবং কাছাড়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাঁড়িগুলো সুরক্ষিত করেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী ইদ্রিসকে ৫০০ অশ্বারোহী এবং ১০০০ গোলন্দাজসহ ঢাকার হেরেমের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যুবরাজ ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে পারেন বুঝতে পেরে ইব্রাহিম খান আকবরনগরে (রাজমহল) অগ্রসর হন তাকে রাজধানীতে পৌঁছানোর আগেই প্রতিহত করার জন্য;  যা ছিল মধ্যযুগীয় সামরিক কৌশলের একটি আদর্শ উদাহরণ।

১৬২৪ সালের শুরুতে শাহ জাহান কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে ইব্রাহিম খানকে পক্ষ ত্যাগের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি অনুগত সুবাদার তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে একটি বড় যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

দুর্ভাগ্যবশত, ইব্রাহিম খান তার অভিজ্ঞ সৈন্যদের অন্যত্র মোতায়েন করেছিলেন এবং অনভিজ্ঞ সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি যুদ্ধে নিহত হন একজন আফগান সৈনিকের হাতে; যিনি তার পরিচয় জানতেন না। শাহ জাহানের বাহিনী জয়লাভ করে।

পরাজিত সুবাদারের দক্ষতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে যুবরাজ নিশ্চিত করেন যে ইব্রাহিম খানের মস্তক প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা হবে না এবং তার ছেলের কবরের পাশে তার দেহ দাফন করার অনুমতি দেন।

জয় নিশ্চিত হওয়ার পর শাহ জাহান তার অনুগত সেনাপতিদের পুরস্কৃত করেন। রাজমহলের যুদ্ধে সহায়তা করা দারাব খানকে বর্ধিত সামরিক শক্তিসহ ঢাকার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়।

শাহ জাহান ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। রাজমহল প্রাসাদ রাজা ভীমের তত্ত্বাবধানে অর্পণ করে তিনি পান্ডুয়ার শেখ নূর কুতুব আলমের মাজার জিয়ারত করেন এবং ঘোড়াঘাটে শিবির স্থাপন করেন। এরপর তিনি খাজা ইদ্রাককে ঢাকায় পাঠান যেকোনো অস্থিরতা শান্ত করার জন্য। রাজমহল ছাড়ার ছয় দিন পর তিনি শাহজাদপুরে শিবির স্থাপন করেন এবং তিন দিন পর ১৬২৪ সালের মে মাসে ঢাকায় পৌঁছান।

খাজা ইদ্রাকের প্রচেষ্টা সফল হয়। কোনো প্রতিরোধ সেখানে ছিল না। ইব্রাহিম খানের বিধবা স্ত্রী তার জিনিসপত্র নিয়ে পাটনায় পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু শাহ জাহানের অগ্রগামী বাহিনী তাকে থামিয়ে দেয়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে স্থানীয় কর্মকর্তা এবং মুঘল কর্মকর্তারা যুবরাজকে স্বাগত জানাতে সারবদ্ধভাবে এগিয়ে আসেন। এমনকি প্রয়াত সুবাদারের বিধবা স্ত্রীও তাকে সশ্রদ্ধ অভ্যর্থনা জানান।

শাহ জাহান ঢাকা দুর্গে বসবাস শুরু করেন, পুরান ঢাকার যে জায়গাটিকে আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে চিনি। বাংলার অঘোষিত শাসক হিসেবে তিনি কোচবিহার এবং কামরূপসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করেন। তবে তার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দিল্লির সিংহাসন দখলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। ইব্রাহিম খানের ভাতিজা আহমদ বেগ এর আগেই ৪৫ লাখ টাকা এবং ৫০০টি হাতি হস্তান্তর করেছিলেন। প্রয়াত সুবাদারের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে শাহ জাহান রেশম, মুসাব্বার, অস্ত্র এবং অতিরিক্ত ৪০ লাখ টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হস্তগত করেন।

ঢাকায় এক সপ্তাহ অবস্থানের পর শাহ জাহান নদীপথে শহর ত্যাগ করেন। সেনাপতিরা যান স্থলপথে।

Comments

The Daily Star  | English

Iran announces new wave of attacks on Israel: state TV

Israel says conducted 'extensive strikes' in Iran's west, while explosions near Tel Aviv, sirens blare across Israel; smoke rises after explosion in Iran’s Tabriz

13h ago