কথা বলতে পারলেও নিজের ভাষার বর্ণমালা চেনে না রাখাইন শিশুরা

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারায় ও ভাষাগত দূরত্বের কারণে তারা দিন দিন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে।
২০১৫ সালে বিহারের পাশে ২০ রাখাইন শিশু নিয়ে গোলপাতার ঘরে ‘রাখাইন ভাষা শিক্ষা স্কুল’ চালু করেছিলেন কুয়াকাটার মিশ্রীপাড়া সীমা বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ উত্তম ভিক্ষু। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় করোনা মহামারিতে তা বন্ধ হয়ে যায়। ছবি: স্টার

মাতৃভাষায় কথা বলতেও পারলেও বর্ণমালা না জানায় নিজের ভাষায় লিখতে বা পড়তে পারছে না রাখাইন শিশুরা। অনেকের কথ্য ভাষায়ও বাংলা ও ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে।

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাব, যথাযথ চর্চা, মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা সংকট ও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় বসবাসকারী রাখাইনদের ভাষা।

স্থানীয়রা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ১৭৮২ সালে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ থেকে পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও বরগুনার তালতলীতে এসে বসতি স্থাপন করে রাখাইনরা।

পরে তারা বেশ কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বরগুনা জেলার তালতলী ও পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী ও কলাপাড়ার উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে তোলে বসতি। জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলে আবাদি জমি।

ধীরে ধীরে তাদের পাশেই গড়ে ওঠে বাঙালিদের বসতি।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারায় ও ভাষাগত দূরত্বের কারণে তারা দিন দিন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে।

বর্তমানে কলাপাড়া উপজেলার কয়েকটি স্থানে ২৮টি পাড়ায় প্রায় ৩০৪ রাখাইন পরিবারের বাস। এর মধ্যে মিশ্রিপাড়া, লক্ষীপাড়া, মম্বিপাড়া, আমখোলা পাড়া, গোড়াআমখোলা পাড়া, পাঞ্জুপাড়া, কালাচাঁনপাড়া, নয়াপাড়া, মংথেপাড়া, নাইউরীপাড়া, কেরানীপাড়া, বেতকাটাপাড়া, বৌলতলীপাড়া ও নাচনাপাড়া উল্লেখযোগ্য।

মিয়ানমারের উপভাষা রাখাইনে কথা বলতে অভ্যস্ত এ জনগোষ্ঠীর জন্য মাতৃভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা না থাকায় বিকল্প হিসেবে বাংলা ভাষাতেই তারা পড়াশোনা করছে।

ফলে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও নিজেদের ভাষায় পড়তে ও লিখতে পারছে না রাখাইন শিশুরা।

কুয়াকাটা কেরানীপাড়ার বাসিন্দা চিংথান রাখাইন (৪৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ছেলে খেনজো বরিশাল সরকারি হাতেম আলী কলেজে অনার্স পড়ছে। মেয়ে মোমেসে বরিশালের বাকেরগঞ্জের পাত্রী শিবপুর স্কুলে পড়ছে। ২ সন্তানের কেউই রাখাইন ভাষায় লিখতে বা পড়তে পারে না। শুধু বলতে পারে। স্কুলে রাখাইন ভাষা শেখার সুযোগ না থাকায় সন্তানদের এ ভাষা শেখাতে পারিনি। আমাদের ভাষা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।'

একই এলাকার ম্যানজো রাখাইন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বড় মেয়ে ছুইছেলাং (১৩) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। তাকে মাতৃভাষা শিখাতে পারিনি। সে রাখাইন ভাষায় লিখতে বা পড়তে পারে না। শুধু আমাদের মুখে শুনে সে বলতে শিখেছে।'

কুয়াকাটা এলাকায় একাধিক বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ বলছেন, একদিকে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না থাকায় বাংলা ভাষাতেই লেখাপড়া করতে হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়িতেও রাখাইন ভাষার চর্চা কম।

তারা বলছেন, একসময় বৌদ্ধ বিহারগুলোয় ভিক্ষুরা রাখাইন শিশুদের রাখাইন ভাষা শেখালেও এখন বর্ণমালার বইয়ের অভাবে তাও হচ্ছে না। রাখাইন ভাষার বর্ণমালার বইগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম বা মিয়ানমার থেকে আনতে হয়, যা এখন দুষ্প্রাপ্য।

কুয়াকাটার বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ইন্দ্র বংশি ভিক্ষু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাখাইন ভাষা শেখানোর সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ নেই। রাখাইন শিশুরা তাদের মাতৃভাষা শিখতে পারছে না। তারা প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে তখন শিশুদের বিহারে এনে রাখাইন ভাষা শেখানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সবাইকে আনা যায় না।'

২০১৫ সালে বিহারের পাশে ২০ রাখাইন শিশু নিয়ে গোলপাতার ঘরে 'রাখাইন ভাষা শিক্ষা স্কুল' চালু করেছিলেন কুয়াকাটার মিশ্রীপাড়া সীমা বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ উত্তম ভিক্ষু। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় করোনা মহামারিতে তা বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, 'স্কুলটি চালু করতে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থারও প্রয়োজন।'

পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাখাইন শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে উঠেনি। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়েই তারা পড়াশোনা করছে।'

Comments