‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমার আলো, আমার চোখ’

গ্রাফিক্স: আনোয়ার সোহেল

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাঙালি জাতিসত্তা, স্বকীয়তা আর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার আন্দোলনের অবিস্মরণীয় সেই দিনটি ফিরে এসেছে আবার।

শোকে বিহ্বল ও গৌরবে দীপ্ত অনন্য এ দিনেই মানব ইতিহাসের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় প্রথমবার মানুষ মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রাজপথে। ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ধারণ করা সেই চেতনা বাঙালির মনের ভেতর জাগিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রবাসনা।

আজ সেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। এখন থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৫২ সালের এই দিনে ছিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। সেদিন ডাকা হয় ধর্মঘট। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভেঙে মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সেদিন পথে নেমে এসেছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী অসংখ্য মানুষ। বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'।

ফাল্গুনের সেই দিনে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চলে। শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দীন, সালামসহ আরও অনেকে।

পরবর্তীতে সেই রক্তের দামে আসে বাংলার স্বীকৃতি আর তার সিঁড়ি বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়; ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। বাঙালির ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত উৎকট বৈষম্যের সে রাষ্ট্রে কাঙ্ক্ষিত সমতা ও ন্যায়ের পরিবর্তে ছিল সীমাহীন শোষণ, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অপমান। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন ছিল ওই বৈষম্য আর অপমানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম সরব জবাব।

বায়ান্নর একুশের চেতনাকে ধারণ করেই চুয়ান্নর নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারকে হটিয়ে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট। দাবি ওঠে স্বায়ত্তশাসনের। সেই পরম্পরায় আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিই মুখ্য হয়ে ওঠে।

পরবর্তীতে ছেষট্টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ধীরে ধীরে নিয়ে চলে স্বাধিকারের দিকে। এরপর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বাঙালি জাতিসত্তার মূলে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটা নতুনভাবে পরিচর্যা পায়। বাংলা ভাষা অন্য এক মাত্রায় পৌঁছায় একুশে ফেব্রুয়ারির হাত ধরে।

বায়ান্নতে এই পুরো আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে পাবনা, গাইবান্ধা, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুলশিক্ষার্থীদের হাত ধরে গ্রাম পর্যন্ত এই আন্দোলনটি বিস্তৃত হয়।

তাই একুশের এই চেতনা এতটাই প্রবল ও ব্যাপক যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম সব অঞ্চলেও শহীদ মিনারের দেখা মেলে। আজও মধ্যরাত কিংবা ভোর থেকে ফুল হাতে দলে দলে মানুষ এগিয়ে যাবেন এসব শহীদ মিনারের দিকে। তাদের সবার কণ্ঠে থাকবে বাংলা ভাষা, ভাষা আন্দোলন আর বাঙালির ইতিহাসে অমর হয়ে যাওয়া সেই গান—'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...।' বেদিতে রাখবেন বিনম্র শ্রদ্ধার ফুল।

প্রতি বছর ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এই প্রক্রিয়াটিকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা বলা যাবে না। কারণ গত সাত দশকে একুশের ভাবাদর্শ গোটা জাতির মননে মিশে তা রীতির রূপ ধারণ করেছে; ইংরেজিতে যাকে রিচুয়াল বলা যায়।

আজ সরকারি ছুটির দিন। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। দিনের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে থাকবে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, একুশের কবিতা পাঠের মতো নানা আয়োজন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই এর চেতনাকে উপজীব্য করে লেখা হয়েছে অজস্র কবিতা, গান, ছড়া, নাটক, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। ১৯৫৬ সালে ডি এ রশীদ ও মহিউদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় বের হওয়া 'একুশের সংকলন'-এ প্রকাশিত এমন এক প্রবন্ধে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, 'একুশে ফেব্রুয়ারি অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে আমাদেরকে বিরোধ করতে শেখায়নি, জনসাধারণের ভাষার মর্যাদা, অধিকার ও উন্নতির প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়েছে। এ দিনের চৈতন্য তাই সমগ্র দেশকে ডেকে বলেছে: মাতৃভাষাকে ভালোবাসুন, তার উন্নতির চেষ্টা করুন, তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন—ভাষাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করুন।'

কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এখনো যে আক্ষেপ বয়ে বেড়াচ্ছেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক; তা হলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হওয়া। গত বছর গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভাষা সংগ্রামীদের তিনটি স্লোগান ছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু কর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান ছিল এটাই—জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু কর। মানে শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালতসহ সর্বত্র বাংলা, বাংলা মাধ্যম চালু করা। আক্ষেপ তো একটাই যে, এই স্লোগানটা কার্যকর হল না।

১৯৯৬ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে শিল্পী কবীর সুমন গানে বলেছিলেন, 'পূবের ওই উদ্বোধনে পশ্চিমেরও বোধন হোক/একুশে ফেব্রুয়ারি আমার আলো, আমার চোখ।'

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেসকোর অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি যে চেতনার আলো ফেলেছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে, তা ইউনেসকোর ঘোষণার ভেতর দিয়ে আন্তর্জাতিক রূপ পায়।

এমন পরিস্থিতিতে একুশের সমস্ত গৌরব সঙ্গে নিয়েও এখন পর্যন্ত এর ভিত্তিভূমি বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা চালু না হওয়ার বিষয়টি আক্ষেপেরই বটে। আবার দুয়েকটি বাদ দিলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাও এখন মৃত্যুর অপেক্ষায়। এটা কি একুশের চেতনার পরিপন্থী নয়?

 

Comments

The Daily Star  | English

BDR carnage rooted in 'long-term plot', says investigation commission

It was abetted by intelligence failures, gross negligence, and the involvement of several political figures, according to the commission chief

1h ago