রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু

তার মতো ইতিহাসের মহানায়ককে হত্যা করে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া যায় না। তিনি পুরাণের সেই ফিনিক্স পাখি। ছাই থেকে জেগে ওঠেন স্বর্ণখচিত ইতিহাসের পাতায় স্বমহিমায়।

মুখের ভাষা মানুষের সবচেয়ে বড় আত্মপরিচয়। বাঙালি কতিপয় মুসলমানের মনে যখন ভাষিক পরিচয়ের সংশয় ছিল উর্দু, ফার্সি না আরবি — বঙ্গবন্ধু তখন মাতৃভাষা বাংলার প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান নিয়েছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সমন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল কিন্তু পারে নাই। যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই।'

১৯৫২ সালের ২-১২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গিয়েও বাংলা ও বাঙালির প্রতি ভালোবাসার কথা বিস্মৃত হননি তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'-তে লিখেছেন, 'আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।'

কারাগারের রোজনামচা'য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দান সবচেয়ে বেশি।' জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে বঙ্গবন্ধু সাইকেল নিয়ে ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু একই বইয়ে আরেক জায়গায় ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, 'আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'শহিদ দিবস' ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল।' ওই বছর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৭ দফা মোতাবেক শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিন পর ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই স্বীকৃতি রক্তের আঁখরে লেখা এবং আদায় করা।

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করলেও পূর্ববঙ্গ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। যার বিরুদ্ধে শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও বাংলা শব্দটির অস্তিত্ব রইল না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কৃষ্ণনগরে একটি স্কুলের উদ্বোধনী সভায় যাচ্ছেন। পরদিন নৌকায় ফিরছেন। আশুগঞ্জে স্টেশনে পৌঁছে ঢাকার ট্রেন ধরবেন। বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিনও সঙ্গে। নদী পথে বাংলার রূপ দেখে আর গান শুনে শুনে ফিরছিলেন তারা। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, 'নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটি দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।...আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।' আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। (পৃ. ১১১)

বাংলা সম্ভ্রান্ত মুসলমান বা অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় কারোরই কাছে আদৃত ভাষা ছিল না। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক দল ভাষাটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন সম্পন্ন এক কৃষক পরিবারের সন্তান। এ অঞ্চলের শত শত বছর ধরে শোষিত ভাগ্য-বিড়ম্বিত সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি। সারাজীবন রাজনীতি করেছেন মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য।  বঙ্গবন্ধু গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে অবয়বে মননে একটু বেশি উচ্চতাসম্পন্ন ছিলেন। হয়ে উঠছিলেন এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, সাহস ও সংগ্রামের প্রতীক। তার প্রশস্ত বুক ছিল বাংলাদেশের হৃদয়। পুরো ষাটের দশক তার দৃপ্ত কণ্ঠ আর তর্জনী ছিল বাঙালির রাজনৈতিক নিশানা। ষাটের দশকে বাঙালি তরুণদের মুখে স্লোগান তুলে দিয়েছিলেন, 'পদ্মা, মেঘনা যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা'। এই ঠিকানা হাজার বছরের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার। তার মতো ইতিহাসের মহানায়ককে হত্যা করে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া যায় না। তিনি পুরাণের সেই ফিনিক্স পাখি। ছাই থেকে জেগে ওঠেন স্বর্ণখচিত ইতিহাসের পাতায় স্বমহিমায়।

লেখক: কবি ও গবেষক।

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments