ঐতিহ্য

হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য-অনুষঙ্গ

তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার জীবনযাপনে নিয়ে এসেছে নতুন গতি। জীবন বদলে দেওয়ার এই জাদুর কাঠির সঙ্গে হারিয়ে গেছে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা অনেক জিনিসপত্রও। আশি বা নব্বই দশকে যে যন্ত্রগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়া ছিল, একবিংশ শতাব্দীতে সবই কালের গর্ভে বিলীন।
চরকা। ছবি: সংগৃহীত

তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার জীবনযাপনে নিয়ে এসেছে নতুন গতি। জীবন বদলে দেওয়ার এই জাদুর কাঠির সঙ্গে হারিয়ে গেছে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা অনেক জিনিসপত্রও। আশি বা নব্বই দশকে যে যন্ত্রগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়া ছিল, একবিংশ শতাব্দীতে সবই কালের গর্ভে বিলীন।

এখন আর সন্ধ্যে হতেই গ্রামে গ্রামে হারিকেন জ্বলে না, ঢেঁকির শব্দে মুখরিত হয় না হেমন্তের ধান ভানার উৎসব, লাঙ্গল নিয়ে পরিবারের কেউ মাঠে যায় না আর। মানবসভ্যতার ইতিহাস যুগে যুগে ক্রমেই পরিবর্তিত হয়েছে। চলুন দেখে নিই কী আছে সেই হারানোর তালিকায়-

চিঠি

চিঠির খাম। ছবি: সংগৃহীত

'করুণা করে হলেও চিঠি দিও,

খামে ভরে তুলে দিও আঙ্গুলের মিহিন সেলাই।'

কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় চিঠি পাওয়ার প্রতি যে গভীর আকুলতা, তা-ই ফুটে উঠেছে। হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় চিঠির নামই থাকবে সবার আগে। চিঠি নিয়ে গান, কবিতা, উপন্যাস এমনকি সিনেমাও বানানো হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করা হয় 'হঠাৎ বৃষ্টি' চলচ্চিত্র। চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা মিষ্টি সম্পর্ক এখনও মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়।

টেলিফোন আবিষ্কারের পূর্বে চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এমন কী টেলিফোন আসার পরও চিঠি আদান-প্রদান কমে যায়নি। যান্ত্রিকতার যুগে অনেকেই এখন হলুদ ডাকটিকিটে মোড়া চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে চিঠি হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। এখন আর ডাকবাক্স বা খাকি পোশাক পরিহিত ডাকপিয়নের সাইকেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ শোনা যায় না কোথাও।

হারিকেন

হারিকেন। ছবি: সংগৃহীত

সারাদেশে বিদ্যুতের সহজলভ্যতার কারণে একসময়ের নিত্যকার প্রয়োজনীয় যন্ত্র হারিকেন হারিয়ে যাওয়ার তালিকায়। তবে এখনো কিছু গ্রামাঞ্চলে হারিকেনের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু একসময় ছিল যখন বিকেল হতেই বাড়ির মেয়েরা হারিকেনের কাচ মুছে চিমনীতে কেরোসিন তেল ঢেলে সন্ধ্যার আঁধার ঢেকে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতো। সূর্য ডুবতেই বাড়িতে বাড়িতে জ্বলে উঠতো হারিকেন। একটা গ্রামকে দূর থেকে দেখলে তখন মনে হতো মাটির বুকে আকাশের তারা নেমে এসেছে। অনেকেই হারিকেন জ্বেলে বসে যেতো পুঁথিপাঠের আসরে। 'হাজার বছর ধরে' চলচ্চিত্রে এমন কিছু দৃশ্য আছে যা সেই সময়কার জীবনের চালচিত্র তুলে ধরে। দেশে বিদ্যুতের সংযোগ, সৌরচুল্লির ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ায় হারিকেন হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে।

রেডিও

রেডিও। ছবি: সংগৃহীত

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন 'রেডিও বাংলাদেশ' বেতার ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর পুরান ঢাকা থেকে সর্বপ্রথম সম্প্রচার শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে থেকেই সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা প্রচারিত হয়। টেলিভিশন আসার পূর্বে রেডিও ছিল সংবাদ জানার এবং বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধের সকল সংবাদ রেডিও-র মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো হতো। টেলিভিশন আসার পরও অনেক বাড়িতে রেডিও যন্ত্রটি বাজতে শোনা যেত। গ্রামের দোকানগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা চলতো রেডিও। কিন্তু ক্রমেই টেলিভিশন সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার কারণে রেডিও যন্ত্রটি হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে। তবে রেডিও এফএম অনেকের ফোনেই যুক্ত আছে।

টেলিফোন

টেলিফোন। ছবি: সংগৃহীত

১৮৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল ঢাকার ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ সেদিন থেকেই প্রথম টেলিফোন ব্যবহার শুরু করেন ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহ। দিনটি সম্পর্কে তিনি তার ডায়েরিতে লিখে গিয়েছেন। নবাব আহসান উল্লাহর হাত ধরে শুরু হওয়া টেলিফোন এক সময় সারাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে টেলিফোন ছিল খুবই কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় যন্ত্র। তাই প্রায় প্রতিটি শহুরে বাড়িতে ছিল ল্যান্ড ফোনের লাইন। টেলিফোনের এই ঐতিহ্য বহাল ছিল কয়েক বছর আগেও। তবে সে ঐতিহ্যে অনেকটাই বিলীয়মান মোবাইল ফোনের ব্যাপক জনপ্রিয়তায়।

ক্যাসেট

ক্যাসেট। ছবি: সংগৃহীত

গানপাগল বাঙালির গান শোনার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। সত্তরের দশকে ক্যাসেটের আবির্ভাব ছিল সংগীতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বলা যায়, ১৯৮০-এর দশকে রাজত্ব করেছে ক্যাসেট। গ্রাম কী শহর সর্বত্রই ছিল ক্যাসেটের জয়জয়কার।

বাংলা সিনেমার আধুনিক গান কিংবা পল্লীগীতি, নজরুল সংগীত অথবা ওপার বাংলার জনপ্রিয় গান সবই বেজে উঠতো বাড়িতে বাড়িতে ক্যাসেটের ভেতর।

একটি ক্যাসেটের ভেতর লম্বা সরু সেলুলয়েডের ফিতা থাকত। এ ক্যাসেট দিয়ে গান রেকর্ড এবং গান বাজানো সবই করা যেত।

ভিসিআর

ভিসিআর। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭০-এর দশকে প্রথম বাজারে আসে ভিসিআর। ভিসিআর যন্ত্রটি মূলত চলচ্চিত্র দেখার কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে ঘরে বসে চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এই যন্ত্রটির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। যন্ত্রটির ভেতরে ক্যাসেট ঢোকালেই ঢাকাই ছবির প্রিয় মুখ কিংবা হলিউড, বলিউডের পছন্দের সিনেমাগুলো চলতে শুরু করতো।  গ্রামাঞ্চলে চাঁদা তুলে ভিসিআরে ছবি দেখা হতো। কিন্তু ঘরে ঘরে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের সুবিধা আর ইউটিউব ব্যবহারের ফলে ভিসিআর হারিয়ে গেছে জীবন থেকে।

লাঙ্গল

লাঙল। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। একটা সময় ছিল, যখন ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের চাষিরা কাঠের তৈরি লাঙ্গল হাতে ছুটে যেত মাঠে। লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করতেন এদেশের কৃষকেরা। জমি চাষের মেশিনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে লাঙ্গলের ব্যবহার কমতে থাকে। বর্তমানে কৃষিকাজে লাঙ্গলের ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের পরিশ্রম আর শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসেবে এখনো অনেক বাড়িতে দেখা মিলবে লাঙ্গলের।

পালকি

পালকি। ছবি: সংগৃহীত

পালকি মানুষ বহন করার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন। এই বাহনে একজন বা দু'জন যাত্রী নিয়ে ২, ৪ বা ৮ জন বাহক এটিকে কাঁধে তুলে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে ধনী শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে পশুচালিত যানবাহন এবং পরবর্তীতে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার ক্রমশ কমতে থাকে।  ১৯৩০-এর দশকে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন শুরু হয়, ফলশ্রুতিতে পালকির ব্যবহার একেবারে উঠে যায়। তবে গ্রামাঞ্চলে ৮০-র দশকেও এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে কোনো নারী সদস্য বা বিয়ের কনে-কে বহন করার জন্য পালকির ব্যবহার ছিল। তবে ধীরে ধীরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যানের চলাচল এবং প্যাডেল চালিত রিক্সা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে পালকি বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন।

চরকা

চাঁদের বুড়ি চরকা কাটার গল্প ছোটবেলা থেকেই সবারই মুখে মুখে। চরকা হলো তুলা থেকে সুতা তৈরির যন্ত্র যার ব্যবহার এখন খুব বেশি আর দেখা যায় না। শিল্প বিপ্লবের আগে ইউরোপে সুতা কাটতে চরকার ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেখানে সুতা কাটতো প্রবীণ নারীরা।

'ইসামীর ফুতুহ-উস-সলাতীন' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ভারতে চরকার ব্যাপক প্রচলন ছিল। বাংলায় এ যন্ত্রের প্রচলন ঘটে চৌদ্দ শতকের শেষ দিকে। ১৬ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্তো বার্বোসা লিখেছিলেন, 'বাংলার লোকজন চরকায় সুতা কেটে পোশাক তৈরি করতো। পুরুষেরা তৈরি করতো চরকাযন্ত্র আর মেয়েরা সে যন্ত্রে সুতা কাটতো। মূলত মোটা সুতিবস্ত্র বুননের জন্য যে সুতোর দরকার হতো তা চরকায় কাটা হতো।'

কাপড় বোনার ইলেকট্রনিক মেশিন আসার পর থেকে চরকা হারিয়ে যায় আস্তে আস্তে। তবে প্রাচীনকালের ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে এখনো কিছু বাড়িতে দেখা মিলবে সুতো বোনার এই যন্ত্রটির।

Comments