‘মায়ের কাছে প্রথম চিঠি’: জননীর প্রতি পত্রের নৈবেদ্য

সংকলন গ্রন্থ ‘মায়ের কাছে প্রথম চিঠি’। ছবি: স্টার

যা কিছু কথায় বলা যেত না, তা প্রকাশিত হতো চিঠির অক্ষরে, শব্দমালায়। যন্ত্রসভ্যতার কাছে সেই ভাবনা, উপলব্ধি ও যোগাযোগের পারস্পরিক সেতুবন্ধন হয়ে থাকা চিঠির পরাজয় হয়তো ঘটেছে। কিন্তু সময়ের দলিল হয়ে থাকা এসব চিঠির প্রতি প্রেম কিংবা আবেদন যে ফুরোয়নি, তা টের পাওয়া যাবে 'মায়ের কাছে প্রথম চিঠি' শীর্ষক সংকলন গ্রন্থে।

এই চিঠিপত্র এক সময় হয়ে উঠত সমকালের নিরিখে এক উৎকৃষ্টতম সাহিত্য, দুই পরিবার কিংবা ব্যক্তির মধ্যে খবর আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম। পত্রের ভাষায় বর্ণিত হতো নানা চিত্ররেখা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালবাসার নানা টুকরো কথা। জানা যেত, পরিবেশকে, পরিস্থিতিকে, মানুষের অন্তরের ভাবাবেগকে।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কীর্তির বিশেষ আরেক শাখা ছিল এ পত্র সাহিত্য। চিঠি নিয়ে তার একটি উক্তিও এখানে স্মরণযোগ্য—'পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নূতন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরো একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি। চিঠিপত্রে যে আমরা কেবল প্রত্যক্ষ আলাপের অভাব দূর করি তা নয়, ওর মধ্যে আরো একটু রস আছে যা প্রত্যক্ষ দেখা-শোনায় নেই।'

এবারের মা দিবসে মায়ের প্রতি প্রণতি জানাতে 'অজর' এই চিঠিকেই বেছে নিয়েছে ক্যাডেট কলেজ ক্লাব লিমিটেড। প্রকাশ করেছে 'মায়ের কাছে প্রথম চিঠি' শিরোনামের সংকলন গ্রন্থ।

ছবি: স্টার

বারো বছর বয়সে একটি কিশোর বা কিশোরী পরিচিত বাড়ির পরিবেশ ছেড়ে যখন ক্যাডেট কলেজের মতন কড়াকড়ি নিয়মের আবাসিক প্রতিষ্ঠানে একা প্রবেশ করে, তখন তার মনের ভেতর অজানা অনেক ভয়, নিঃসঙ্গতা কাজ করে। সে নিমজ্জিত হয় বন্দিত্বের কঠিন বাস্তবতায়। সেই একাকি নিমজ্জনের প্রথম রাতের পর কিশোরবেলায় মাকে ছেড়ে, পরিবারকে রেখে, প্রথম দিনটির অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, মায়ের কাছে লেখা চিঠিতে সেই অভিব্যক্তিগুলো ফুটে উঠেছে।

এই সংকলনের জন্য ষাটোর্ধ্ব বয়সি মানুষটিও স্মৃতির খাতা খুলে পেছনের দিনে চলে যাবার অনুভূতি স্মরণে এনে মাকে চিঠি লিখেছেন। আবার যাদের মা বেঁচে নেই তিনি এই চিঠি লিখেছেন আকাশের ঠিকানায়।  

১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজের (বর্তমান ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ) প্রথম ব্যাচ থেকে শুরু করে গেল বছর যে ক্যাডেট ভর্তি হয়েছেন, তাদের চিঠিও ঠাঁই পেয়েছে এই সংকলন গ্রন্থে।

এতে অংশী হয়েছে দেশের ১২টি ক্যাডেট কলেজের সবগুলো।

সংকলনে গ্রন্থিত বেশির ভাগ চিঠিই বাংলায় লেখা। কোনো কোনোটা ইংরেজিতে। বাংলা চিঠির কোনোটাতে আবার ভাষা ঠিক নেই, বানান ভুল, কখনো বাক্য অসম্পূর্ণ। তবে ভাষা বা প্রকাশভঙ্গি যা-ই হোক, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ছাপিয়ে চিঠিগুলোর ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে আছে মায়ের প্রতি ভালোবাসার অনিন্দ্য প্রকাশ।

উদ্যোক্তাদের ভাষ্য, এগুলো কেবল চিঠি নয়; সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের বলিষ্ঠ দলিলও বটে। চঞ্চল সময় যতই এগুবে, এই গ্রন্থের আবেদন ততই বাড়তে থাকবে।

গত ১১ মে মা দিবসে ঢাকার পূর্বাচলে ক্যাডেট কলেজ ক্লাবের লিট সোসাইটির উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও আয়োজনে মায়েদের উপস্থিতিতে 'মায়ের কাছে প্রথম চিঠি' গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন হয়।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মাকে লেখা চিঠি নিয়ে এমন একটি উদ্যোগের পরিকল্পনা আছে সাবেক ক্যাডেট এবং স্থপতি, নাট্যকার ও চিত্রশিল্পী শাকুর মজিদের কাছ থেকে।

ছবি: স্টার

ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। জাহেদী ফাউন্ডেশনের কর্ণধার ও রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান নাসের শাহরিয়ার জাহেদী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে।

আরও ছিলেন ক্লাবের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মাদ আলমগীর ও অন্যান্য ক্লাব সদস্যরা। উপস্থিত ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট হারুন-উর রশিদ; সংকলন গ্রন্থে যার লেখা চিঠি সবার প্রথমে জায়গা পেয়েছে।

অনুষ্ঠানে জুয়েল আইচ তার বক্তব্যে বলেন, 'কবি নজরুল লিখেছিলেন, "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর"। কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অধিকাংশ করিয়াছে মা, কিছুটা তার নর।'

ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী বলেন, 'মায়ের কাছে একবার জানতে চেয়েছিলাম, তোমার জীবনের সেরা অনুভূতি কী? মা জানালেন, আমার ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার ঘটনা।'

অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক মোহাম্মদ আবু রইস, সাবেক ক্যাডেটদের মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। মায়েরাও সেখানে বক্তব্য দেন এবং সন্তানরা তাদের মায়েদের নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করেন। চিঠির লেখকরা তাদের মায়েদের নিয়ে ক্যাডেট জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

সংকলন গ্রন্থটির প্রচ্ছদ আঁকাসহ অলংকরনের কাজটি করেছেন সম্পাদনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য লুৎফুল হোসেন।

সম্পাদনা পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন—শাকুর মজিদ, মো. শাহজাহান কামাল, এ কে এম মাজহারুল ইসলাম, লিট সোসাইটির লাইব্রেরি, প্রিন্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন কমিটির আহ্বায়ক ফাতেমা দোজা এবং পরিচালক মাফরুহা আক্তার রুমানা।

Comments

The Daily Star  | English

Shutdown is another economic peril

Vowing to continue an indefinite work stoppage and stage a protest march on tax offices, the NBR Reform Unity Council has intensified its demands

8h ago