জালালিয়ার শিঙাড়া: ৭৭ বছর পেরিয়ে আজও আড্ডার সঙ্গী
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2022/12/27/aaddddaar_ttaanei_sb_byysiiraai_aasen_jaalaaliyyaayy_.jpg?itok=axinllkP×tamp=1672079457)
আবদুল হাকিমের বয়স প্রায় ৮৫। বয়সের ভারে তার সঙ্গী হয়েছে লাঠি, শরীরও ভেঙে পড়েছে অনেকখানি। কিন্তু আজও প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় সেই এক রুটিন রয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর তিনি আসেন জালালিয়াতে।
'এখনও নিয়মিত কেন আসেন জালালিয়াতে?' প্রশ্ন করতেই মৃদু হাসলেন আবদুল হাকিম। এরপর বেয়ারাকে ডেকে গরম শিঙাড়া দিতে বললেন। শিঙাড়ায় কামড় বসিয়েই বললেন, 'এখানে এলে আমার বয়সটা যেন কমে যায়। সেই কলেজ লাইফে চলে যাই। আমরা বন্ধু-বান্ধবরা তখন আসতাম জালাল মিয়ার টংয়ে। তখন তো টং দোকানই ছিল। নালার ওপর কাঠ দিয়ে বসানো টং দোকান। তখন শিঙাড়ার দাম ছিল ১ আনা করে। এখনো যখন এখানে আসি মনে হয় সেই বুঝি কলেজ জীবনে চলে গেলাম।'
শুধু আবদুল হাকিমই নন, সন্ধ্যা হলে জালালিয়াতে দেখা মেলে এমন অজস্র মানুষের। বেশিভাগই আসেন শিঙাড়া খেতে খেতে আড্ডা দিতে।
জালালিয়ায় শিঙাড়া খেতে এসেছিলেন ফেনী কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শরীফ। তিনি বললেন, 'অন্য কোথাও শিঙাড়া খাই না। কারণ জালালিয়ার মতো শিঙাড়া আর কোথাও নেই। শিঙাড়ার সঙ্গে যে বাহারি সস-চাটনির দরকার নেই, শুধু কাঁচা পেঁয়াজই যথেষ্ট তা জালালিয়ার শিঙাড়া খেয়েই বোঝা যায়।'
দ্বিমত করলেন না পাশে বসা শরীফের বাবা সরকারি কর্মকর্তা আহমদ আলীও। তিনি বললেন, 'জালালিয়ার শিঙাড়া আসলে এক আবেগের জায়গা। আপনি যত জায়গায়ই শিঙাড়া খান না কেন, সেই স্বাদ আর আবেগটা পাবেন না। আমার দাদা যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন তখন সঙ্গে নিয়ে যেতেন জালালিয়ার শিঙ্গাড়া। দাদাও নেই, বাবাও নেই। এখন আমরা বাপ-বেটাই খাই।'
এমন অজস্র স্মৃতিতে পরিপূর্ণ ফেনীর জালালিয়া। ২ দশক আগেও মূলত খাবার হোটেল হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে একইসঙ্গে মিষ্টি, ফাস্টফুডের দোকান ও কফিশপ এটি।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2022/12/27/sdybhaajaa_jaalaaliyyaar_mcmce_shinggaarraa_0.jpg?itok=xldUSbna×tamp=1672079504)
১৯৪৫ সাল। ফেনী শহরের প্রাণকেন্দ্র ট্রাংকরোডে রাজাঝির দিঘির পাড়ে ছোট পরিসরে খাবার হোটেল চালু করেন জালাল আহমেদ। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম দেন জালালিয়া।
৪০ এর দশকের শেষদিকে সেই খাবার হোটেলে কারিগর হিসেবে কাজ করতেন আবদুল কাদের নামের একজন। তার হাতেই উৎপত্তি জালালিয়ার এই শিঙাড়ার। শুরুর দিকে শিঙাড়ার দাম ছিল ৪ পয়সা করে। ওই সময় শিঙাড়ার পাশাপাশি জালালিয়াতে বিক্রি হতো ভাসা তেলের পরোটা, লালমোহন ও কালোজাম মিষ্টি। কিন্তু শিঙাড়াই জালালিয়াকে করে তোলে অনন্য।
তখন রাজাঝির দীঘির পাড়েই ছিল ফেনী মহকুমা আদালত। বাদী-বিবাদী ও বিচারপ্রার্থীদের আগমনে মুখরিত থাকত জালালিয়া। ৩ দশক আগে আদালত স্থানান্তরিত হলেও জালালিয়ার শিঙাড়ার সুনাম ততদিনে মানুষের মুখে মুখে।
বর্তমানে কেবল ফেনী শহরেই জালালিয়ার রয়েছে ৫টি শাখা। সব শাখাতে মিষ্টি ও ফাস্টফুড বিক্রি হলেও শিঙাড়া সবগুলোতে বিক্রি হয় না। কেবল আদি শাখাতেই পাওয়া যায় শিঙাড়া।
জালালিয়ার শিঙাড়া খেতে বন্ধুসহ এসেছিলেন পশ্চিম উকিল পাড়ার বাসিন্দা করিমুল হক। তিনি ফিরে গেলেন পুরনো সময়ে।
বললেন, 'এই জালালিয়ার পাশেই ছিল সুরত সিনেমা হল। মনে আছে, হলের ম্যাটিনি শো যখন শেষ হতো দর্শকরা সোজা ঢুকত জালালিয়ায়। তখনকার জালালিয়া তো এখনকার মতো সুরম্য, এত সাজানো ছিল না। তখন ছিল দোচালা টিনের হোটেল। শিঙাড়ার দাম ছিল ৪ আনা করে। মানুষে ভরা থাকত। আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম কখন বসার সুযোগ পাব।'
সরকারি কর্মকর্তা নিজামুল হোক ভূঁইয়া জালালিয়ায় শিঙাড়া খেতে আসেন ৪০ বছর ধরে। তিনি বললেন, '১০ টাকার অনুপাতে অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে জালালিয়ার শিঙাড়া আকারে কিছুটা ছোট হলেও খেতে বেশ সুস্বাদু।'
'সত্যি বলতে গেলে নাম একবার হয়ে গেলে খাবারের মান কমে যায়। কিন্তু জালালিয়ার ক্ষেত্রে উল্টো হয়েছে। আমি প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে জালালিয়াতে আসি। তাই বলতে পারি, ৩০-৪০ বছর আগে জালালিয়ার শিঙাড়া বা অন্য খাবারের যে মান ছিল তা এখন অনেক উন্নত হয়েছে। অন্যরা অনুকরণ করেও জালালিয়ার পর্যায়ে আসতে পারেনি', যোগ করেন তিনি।
৭৭ বছর আগে যে জালালিয়ার শিঙাড়া ৪ পয়সা করে ছিল, কালের বিবর্তনে সেই শিঙাড়ার দাম এখন দাঁড়িয়েছে ১০ টাকায়। তবে আজও ৪০ এর দশকের মতো ফেনীবাসীর নাস্তার অনুষঙ্গ হয়ে আছে এই শিঙাড়া।
জালালিয়ার অন্যতম স্বত্বাধিকারী জিয়াউদ্দিন আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের শিঙাড়ার বৈশিষ্ট্য হলো আপনি যখনই আসবেন তখনই এটি গরম গরম খেতে পারবেন। সকাল ১০টা থেকে আমরা শিঙাড়া বানিয়ে বিক্রি শুরু করি। শিঙাড়া বিক্রি শেষ হয় রাত ১০টায়।'
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2022/12/27/jaalaaliyyaar_bikhyaat_shinggaarraa_0.jpg?itok=ryz3loGP×tamp=1672079586)
'কী উপকরণ ব্যবহার করেন শিঙাড়ায়?' জিজ্ঞেস করতেই মৃদু হাসলেন জিয়াউদ্দিন। বিষয়টি গোপনীয় হলেও তিনি কিন্তু লুকালেন না। বললেন, 'আমাদের শিঙাড়ার উপাদান বাকি সবার মতোই। মূল উপাদান আলু, জিরা, কাঁচামরিচ। আর আমরা বাদাম দিই। থাকে আমাদের নিজেদের বানানো আলাদা একটা মশলা। এগুলোই! বাকিটা হাতের ওপর।' বোঝা গেল জালালিয়ার সেই মশলাতেই যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে।
জিয়াউদ্দিন আরও বললেন, 'তবে একটি জিনিস বলতেই হয়, আমরা শিঙাড়ার সঙ্গে কিন্তু কোনো সস বা সালাদ দিই না। একমাত্র কাঁচা পেঁয়াজ। পেঁয়াজের দাম যখন যেমনই হোক না কেন, কাঁচা পেঁয়াজ হলো জালালিয়ার শিঙাড়ার বিশেষত্ব। গত ৭৭ বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে।'
জিয়াউদ্দিন এই প্রতিবেদককে নিয়ে গেলেন ৩ তলার রান্নাঘরে। দেখা গেল এক কোণে শিঙাড়ার জন্য আলু সেদ্ধ হচ্ছে, এক পাশে ময়দার ছাঁচে আলু ঢুকিয়ে শিঙাড়ার অবয়ব দেওয়া হচ্ছে। এক কোণে কড়াইতে ডুবো তেলে ভাজা হচ্ছে শিঙাড়া। প্রস্তুত হলে মুহূর্তেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিচ তলায় ক্রেতাদের জন্য। যেন শিঙাড়া তৈরির মহাযজ্ঞ!
জিয়াউদ্দিন বললেন, 'রাতেই আমরা শিঙাড়ার মশলা ও আলু প্রস্তুত করে রাখি। সকাল হতেই শুরু হয় বাকি প্রস্তুতি। সকাল ১০টা থেকে ভাজা শুরু হয়। চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।'
আমরা যখন জালালিয়ার শিঙাড়া খেয়ে বের হচ্ছি তখন ঘড়িতে রাত ৯টা। নিচ তলায় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ২০-২২ জনের জন্য। কিন্তু তখনো দ্বিগুণের বেশি লোক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন শিঙাড়া খাওয়ার জন্য। কেউ উঠলে বাকিদের কেউ বসে খাওয়ার সুযোগ পাবেন। এমন ভিড় জানান দেয় কতটা জনপ্রিয় এই শিঙাড়া। আর শিঙাড়া খাওয়ার সুবাদে আড্ডা ও স্মৃতিচারণ তো বাড়তি পাওনা।
Comments