অযত্নে নষ্ট হচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

জেলা প্রশাসনের এক পুরনো-স্যাঁতসেঁতে ভবনে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে চলেছে নীলফামারীতে সামাজিক উদ্যোগে সংগৃহীত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
অযত্নে নষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
নীলফামারী ‘জেলা প্রশাসন জাদুঘরে’ অযত্নে রাখা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/ স্টার

জেলা প্রশাসনের এক পুরনো-স্যাঁতসেঁতে ভবনে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে চলেছে নীলফামারীতে সামাজিক উদ্যোগে সংগৃহীত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

১৯৮৪ সালে মজিবর রহমানের নেতৃত্বে নীলফামারী ও এর আশেপাশের এলাকার নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুসন্ধানী কয়েকজন নিজ উদ্যোগে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ শুরু করেন।

শুরুতে এগুলো জেলা শহরে গণগ্রন্থাগারের কক্ষে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়।

এক পর্যায়ে কক্ষটিতে জায়গা না হওয়ায় তারা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সেগুলো জেলা প্রশাসন জাদুঘরে স্থানান্তর করেন।

এই জাদুঘর ভবনটি একসময় তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের (এসডিও) অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

বর্তমানে পুরনো এই ভবনকে 'জেলা প্রশাসন জাদুঘর' নামকরণ করেছে জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ। এই নামে সাইনবোর্ডও টানানো হয়েছে।

গুরুত্ব বিবেচনা করে সাংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশনায় ২০১৭ সালে সদর উপজেলার নীল সাগর পর্যটন কেন্দ্রের কাছে প্রায় ৪ একর জমিতে পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর নির্মাণ শুরু হয়।

জাদুঘরটির নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে প্রায় শেষ হলেও উদ্বোধন না হওয়ায় ২ বছর ধরে ভবনটি খালি পড়ে আছে। অন্যদিকে পুরনো-স্যাঁতসেঁতে ভবনে অযত্নে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো এখন নষ্ট হওয়ার পথে।

অযত্নে নষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
শালগাছ খোদাই করে তৈরি এককোষী নৌকা। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/ স্টার

সরেজমিনে জেলা প্রশাসনের জাদুঘর পরিদর্শন করে দেখা যায়, সেখানে সংরক্ষিত মূল্যবান নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে ব্রিটিশ আমলের ১৫ কেজি ওজনের লোহার তালা, কেরোসিনচালিত বড় টেবিল ফ্যান, বৃহদাকার শালগাছ খোদাই করে তৈরি হাজার বছর আগের একটি এককোষী নৌকা, হাতির দাঁতে তৈরি নানান শৌখিন সামগ্রী, কাঠখোদাই করে তৈরি বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুখাবয়ব, কষ্টিপাথর, কাঁচ, বাঁশ ও লোহার তৈরি আরও অনেক নিদর্শন।

পুরনো ভবনটিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। ধুলোবালির আস্তরণে সংরক্ষিত অনেক নিদর্শন নষ্ট হওয়ার পথে। এককোষী শালের কান্ড থেকে তৈরি নৌকাটিকে ভবনের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। সেটির অংশবিশেষ পচে গেছে বা ভেঙে গেছে।

জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ২ জনকে সেখানে মাস্টার রোলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে তাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।

তাদের একজন রতন কুমার রায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা ২ জন দর্শনার্থীদের জাদুঘরটি ঘুরিয়ে দেখার কাজ করেন। যদিও সেখানে ২ ঘণ্টা অবস্থান করেও কোনো দর্শনার্থীকে আসতে দেখা যায়নি।

রংপুর গবেষণা পরিষদের সহসভাপতি, ইতিহাসবিদ আব্দুল হাফিজসহ এলাকার খ্যাতিমান ব্যক্তিরা দ্রুত নতুন ভবনে জাদুঘর চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। নষ্ট হওয়া থেকে প্রত্নসম্পদসমূহ রক্ষা করতে সেগুলো দ্রুত স্থানান্তরের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

রংপুর জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক হাবিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণের জন্য সেগুলোয় প্রয়োজনীয় রাসায়নিক ট্রিটমেন্ট দেওয়া জরুরি। ধূলোবালি ও জলীয়বাষ্প নিয়ন্ত্রণসুবিধা আছে এমন বিশেষ কক্ষে সেগুলোকে রাখা প্রয়োজন। সেখানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর ব্যবস্থাও থাকতে হবে।'

তবে জেলা প্রশাসনের জাদুঘরটিতে এসব ব্যবস্থা নেই।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বগুড়ায় আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নীলফামারী জাদুঘর (নতুন ভবন) উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। লোকবল সংকট থাকায় দেরি হচ্ছে। এক মাসের মধ্যে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পরিদর্শনে আসবার কথা আছে। পরিদর্শনের পর তার নির্দেশনা অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

নীলফামারী জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ ৪/৫ দিন আগে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নতুন জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছি। এটি চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব। জেলা প্রশাসনের জাদুঘরে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেব।'

Comments