হ্যারিয়েট মুডির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রেম না বন্ধুত্ব

প্রিয় বন্ধু, ‘আমি এখনো নোবেল পুরষ্কারের বিড়ম্বনার ভুগছি, আমার এই সর্বশেষ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আমি জানি না কোথাও কোন নার্সিং হোম আছে কিনা যেখানে আমি যেতে পারি...’

প্রিয় বন্ধু, 'আমি এখনো নোবেল পুরষ্কারের বিড়ম্বনার ভুগছি, আমার এই সর্বশেষ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আমি জানি না কোথাও কোন নার্সিং হোম আছে কিনা যেখানে আমি যেতে পারি...'

এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৪ সালে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া পর মার্কিন বন্ধু হ্যারিয়েট ভন মুডির কাছে অনুভূতির কথা লিখেছিলেন। বন্ধুত্বের গভীরতা কতটুকু হলে এভাবে লেখা যায় তা সহজেই অনুমেয়।

১৯১২ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় শিকাগোতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিসেস হ্যারিয়েট ভন মুডির সঙ্গে পরিচয়। ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে ওঠে, যা মিসেস মুডির মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথ মুক্তছন্দে রচিত বাংলা নাটক 'চিত্রাঙ্গদা'র ইংরেজি অনুবাদ 'চিত্রা' তাকে উৎসর্গ করেন।

হ্যারিয়েট মুডির জন্ম ১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের পার্কম্যানে, আর রবীন্দ্রনাথের ১৮৬১। সেই হিসেবে তিনি কবির চেয়ে ৪ বছরের বড়। হ্যারিয়েট বিয়ে করেছিলেন শিকাগোর একজন ধনাঢ্য আইনজীবীর সন্তান ড্যানিয়েল ব্রেনার্ডকে। তবে, অল্পদিনেই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ১৯০৯ সালে আবার বিয়ে করেন তরুণ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম ভন মুডিকে। কিন্তু, বিয়ের এক বছরের মাথায় উইলিয়াম মুডি মাত্র ৪১ বছর বয়সে ব্রেইন ক্যান্সারে মারা যান।

হ্যারিয়েট ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। শিকাগোর ২৯৭০ গ্রোভল্যান্ড (এখন এলিস এভিনিউ) এভিনিউ'র বাড়িটিতে বহু কবি-সাহিত্যিক তার আতিথ্যে থেকেছেন। সেই বাড়িতেই ১৯১৩ সালের জানুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ, তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীও ছিলেন। মিসেস মুডির দীর্ঘ দিনের বন্ধু পোয়েট্রি পত্রিকার সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরো যখন রবীন্দ্রনাথ এবং তার পরিবারকে আশ্রয় দিতে অনুরোধ করেন তখন প্রাথমিকভাবে তিনি সম্মত হননি।

'এটি সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না।' হ্যারিয়েট মুডি নিজেই বলেন, 'তিনি প্রায় দুই বছর ধরে বাড়ি থেকে দূরে ছিলেন এবং বিশ্রামের জন্য মাত্র বাড়ি ফিরেছেন।' হ্যারিয়েট মনরোর কাছ থেকে জরুরি বার্তা পেলেন, 'তিনি একজন বিশিষ্ট কবিকে (ঠাকুর) আমন্ত্রণ জানিয়েছেন করেছেন, যার থাকার জন্য একটা জায়গা দরকার'। মিস মুডি জবাব ছিল, 'আমি সব প্রকার কর্তব্য এবং দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি এবং আমি কোন দায়ভার নিতে অস্বীকার করলাম।'

পরদিন সকালে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে হ্যারিয়েট মনরোকে ফোন করলেন। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, 'আমার মনে হলো- যেহেতু আমার বাড়িতে বহু কবিকে আশ্রয় দিয়েছি- তাই এবার না করা ঠিক হবে না।' তিনি ঠাকুর এবং তার পরিবারকে থাকতে দিতে রাজি হলেন। পোয়েট্রির সম্পাদক আগেই তাকে গীতাঞ্জলির একটা কপি পাঠিয়েছিলেন, যা মিস মুডি মনোযোগ দিয়ে পড়ে শেষ করেন।

হ্যারিয়েটের নিজের ভাষায় ঠাকুরকে প্রথম দেখার বিবরণ ছিল, 'আমি যখন তার জন্য অপেক্ষার করছিলাম তখন হালকা তুষার পড়তে শুরু করে। তিনি যখন এলেন, তখন তার সুরম্য মখমলের টুপি আর সাদা লম্বা দাড়িতে তুষার-গুড়া পড়ে এক রোমান্টিক দৃশ্য তৈরি হলো। অন্যরা বসার ঘরে নীরবে আসন গ্রহণ করলেও.... নিজের কক্ষে যাওয়ার আগে কবি সরাসরি আমার পাশে এসে বসলেন...।' তারা কথা বললেন, এভাবেই তাদের বন্ধুত্ব শুরু হলো, যা বাকি জীবন অটুট ছিল।

রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমারকে হ্যারিয়েট মুডি সম্পর্কে লিখেন, তিনি 'গোরা' উপন্যাসের 'আনন্দময়ী' চরিত্রের সঙ্গে হ্যারিয়েটের সমঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছেন। মুডিকে আমার বড় ভাল লাগছে। এর আতিথ্যের মধ্যে বড় একটি স্বাভাবিক দক্ষিণা আছে। একটি অপর্যাপ্ত মাতৃ ভাব এর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে নানা ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, শুধু বিশেষভাবে আমার নয়, যে কেউ এর কাছে আসছে সকলেই এর স্নিগ্ধতায় অভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছে। এখানে এসে অবধি পরের বাড়িতে আছি বলে একদিনের জন্য অনুভব করিনি...।

(রবিজীবনী, ষষ্ট খণ্ড, পৃ ৩৬২)

মুডির জীবনে রবীন্দ্রনাথর আবির্ভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। তার জীবনীকার অলিভিয়া এইচ ডানবারের ভাষায়, ঠাকুরের সঙ্গে মিস মুডির এই সাক্ষাত তাকে পুনর্জাগরিত করেছিল এবং তার জীবনে নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল... ঠাকুরের এই সফর তার জীবনধারাকে সচল করেছিল, তার জীবনকে করেছিল গতিময়...'

কবি মুডির তত্ত্বাবধানে নিউইয়র্ক ভ্রমণ এবং হার্ভাডের বক্তৃতা শেষ করে ইলিনয়ের, আরবানায় পুত্র রথীন্দ্রনাথের বাসায় ফিরে ধন্যবাদপত্র লিখলেন। ধন্যবাদপত্রটি যা তিনি এভাবে শেষ করেন, 'আমি আপনার প্রেমময় আথিতেয়তা কী পরিমাণ মিস করছি, তা বলে বোঝাতে পারবো না। পশ্চিমে আমার পাওয়া বিরল জিনিসের একটি— আপনারই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর'

কিছু দিন পর হ্যারিয়েট কবিকে আবার শিকাগোতে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে চিঠি লেখেন তার জবাবে কবি জানান, 'আমরা ইউরোপ যাওয়ার আগে হাতে থাকা কয়েকটা দিন আপনার সাহচর্যে ব্যয় করতে পারলে আমারা খুবই আনন্দিত হব। আমার মনে হয় আপনি নিউইয়র্ক থেকে আসতে আসতে আমি শিকাগোতে যেতে পারব। কিন্তু বন্ধু আপনি ক্যালিফোর্নিয়ার কথা কেন বলছেন? আপনি আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন না তো?'

শিকাগোতে হ্যারিয়েটের বাড়িতে বেড়ানোর কিছুদিন পর মধ্য এপ্রিলে কবি 'অলিম্পিক' জাহাজ করে লন্ডন রওনা হন। জাহাজ থেকে তিনি হ্যারিয়েটকে একটি বিদায়ী চিঠি লেখেন। কিন্তু, অল্প দিনেই যে তাদের আবার দেখা হবে সেটা তারা জানতেন না।

প্রিয় বন্ধু, আমরা কাল আমাদের গন্তব্যে পৌঁছব। এই জাহাজ ছাড়ার আগে আমি আপনাকে এ কথা অবশ্যই জানাতে চাই যে, আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি, আপনার সঙ্গে পরিচয় আমার সব কাজে শক্তির এক উৎস হয়ে থাকবে। আশা করি আমাদের আবার দেখা হবে। যদি দেখা নাও হয় তাহলেও আমরা এই বলে আশ্বস্ত হতে পারি যে, ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমাদের সাক্ষাৎ সার্থক হয়েছে। আপনার সঙ্গে পরিচয় শুধু মনোরম ও ক্ষণস্থায়ী সামাজিকতায় আবদ্ধ ছিল না, আমাদের জীবনের লক্ষ অর্জনে তা কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করবে। আসুন, আমরা আত্মার ক্ষুদ্রতা পরিত্যাগ করে মুক্তির লক্ষ্যে ঈশ্বরের সুবিস্তৃত পথে অগ্রসর হই এবং আমাদের জীবন উৎসর্গ করি তার প্রেম ও সেবায়।

দুই মাস পর ১৯১৩ এর জুন মাসে হ্যারিয়েট ব্যবসার কাজে লন্ডন যান। হ্যারিয়েটের আমন্ত্রণে কবি পরিবারসহ লন্ডনে তার অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন। তখন 'পাইলস' এর অপারেশনের জন্য কবি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেসময় হ্যারিয়েট ফ্রান্স বেড়াতে যান। হ্যারিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য তৈরি করতে, ফ্রান্সে অবস্থানরত ভাস্কর জো ডেভিডসনকে আমন্ত্রণ জানান। আগস্ট মাস নাগাদ সেটি শেষ হয়। তখন কবি লন্ডনে তার অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন এবং সেটিকেই স্টুডিও হিসেবে ব্যবহার করেন। সেপ্টেম্বরে তিনি লিভারপুল থেকে কলকাতার উদ্দেশ্য রওনা হন। 'সিটি অব লাহোর' জাহাজ থেকে কবি হ্যারিয়েটকে আরেকটি চিঠি লেখেন।

দেশে ফেরার পরপরই কবির নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা এলো। এই খবরে কবি আনন্দিত হলেও নানা বিরূপ মন্তব্যের শিকার হন। এসব সমালোচনায় তিনি মনকষ্টে ভোগেন। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে হ্যারিয়েট পত্র লেখেন। তার জবাবে ১৯১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে যে উত্তর দেন তাতে কবির মনকষ্টের চিত্র ফুটে ওঠে।

আমার প্রিয় বন্ধু,

আপনার চিঠি পেয়ে এবং সুস্থ হয়েছেন জেনে খুবই খুশি হয়েছি। আমি কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আমার সময় অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ আনুষ্ঠানিকতায় নষ্ট হচ্ছে। আমি জনতার কৌতূহলে ভারাক্রান্ত। এই নষ্ট দিনগুলোর বোঝা আমাকে না কাজ করতে দেয়, না দেয় বিশ্রাম, এটি আমার জন্য বিরাট চাপ। এই পুরস্কার আমার দেশের জন্য সম্মান এনেছে, আমার স্কুলের জন্য পুরস্কার। কিন্তু, আমার জন্য প্রবল অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছে।

চিঠির শেষে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ লিখলেন— আপনার প্রীতিভাজনেষু রবীন্দ্রনাথ। এরপর আবার ১৯১৪ সালের ২২ জানুয়ারি শান্তিনিকেতন থেকে নোবেল পুরস্কারের বিড়ম্বনার কথা জানিয়ে হ্যারিয়েটকে কবি আরেকটি চিঠি লিখেন, যে চিঠির কথা এই প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।

হ্যারিয়েট ও রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে তাদের পত্র যোগাযোগ ১৯১৩ সালে শুরু হয়ে ১৯৩০ পর্যন্ত চলমান ছিল। তাদের পত্রাবলী বিশ্বভারতীর ঠাকুর আর্কাইভ এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে। বন্ধুত্বের জোরালো দাবি নিয়ে ১৯১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবি কলকাতা থেকে হ্যারিয়েটকে সে বছর সেপ্টেম্বরে তার দলের সঙ্গে জাপান যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লেখেন তা শিকাগো লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।

অন্যদিকে ১৯১৮ সালে কবিকে বিপ্লবী আখ্যায়িত করে ব্রিটিশ সরকারের অসত্য প্রচারণার কারণে আমেরিকা সফর বাতিল করতে হয়। ১৯১৮ সালের ১৩ মে কবি হ্যারিয়েটকে লেখেন, 'আমি ভেবেছিলাম একদিন চমৎকার সকালে আপনার দরজায় নিজেকে উপস্থাপন করে আপনাকে চমকে দেব। স্বাভাবিকভাবেই আপনার নাস্তার টেবিলে আমার চেয়ারটিতে বসব'।

সর্বশেষ ১৯৩০ সালের ১২ অক্টোবরে কবি যখন শেষবার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যান। তখন শিকাগো যেতে পারেননি। নিউইয়র্ক থেকে হ্যারিয়েটকে চিঠি লেখেন, 'অনেক ঘুরে আপনার দুয়ারে এসেছি, কিন্তু আপনার প্রিয়মুখ দর্শন হলো না।' কিছু দিন পর কবি লেখেন, 'আপনাকে না দেখে গেলে আমি কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।' তখন 'গ্রেট ডিপ্রেশনে' যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল। হ্যারিয়েটের ব্যবসাও কখন তীব্র ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কবি ৫ ডিসেম্বরে আবার হ্যারিয়েটকে লেখেন, 'আপনার অবস্থা অনুমান করতে পারি, যদি আমাকে দেখার জন্য আপনাকে খুব বেগ পেতে হয়, তাহলে তা আমার কষ্টের কারণ হবে। আমার ক্ষেত্রে, আমি আপনার ভালবাসার বিষয়ে নিশ্চিত এবং আমি তাতে গভীরভাবে তৃপ্ত।' শেষ যে চিঠিটি মুডির দলিল হিসেবে শিকাগো ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। ১৯৩০ সালের ১৫ ডিসেম্বর লেখেন, 'প্রিয় বন্ধু বিদায়, ভালোবাসা ও শুভেচ্ছাসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' এরপর নিউইয়র্ক থেকে কবি লন্ডনের উদ্দেশ্য যাত্রা করেন।

আবদুল্লাহ জাহিদ লেখক, অনুবাদক ও ব্যবস্থাপক, কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি নিউইয়র্কের হলিস শাখা [email protected]

Comments