ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: বাঙালির চিরকালের আশ্রয়

সুদীর্ঘকালের অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অবিদ্যা ও কূপমণ্ডুকতার নিগড়ে জিম্মি অসহায় বাঙালি সমাজকে মুক্ত করতে যে কয়েকজন বাঙালি মনীষা জন্ম নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অদ্বিতীয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ছবি: সংগৃহীত

সুদীর্ঘকালের অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অবিদ্যা ও কূপমণ্ডুকতার নিগড়ে জিম্মি অসহায় বাঙালি সমাজকে মুক্ত করতে যে কয়েকজন বাঙালি মনীষা জন্ম নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অদ্বিতীয়।

গোটা ইংরেজ আমলের প্রায় দুইশ বছরে এমন মহৎপ্রাণ-কর্মবীর ভারতবর্ষে খুব একটা চোখে পড়ে না। 'অজেয় পৌরুষ' এবং 'আপসহীন মনুষ্যত্বে' তিনি একক বাঙালি সত্তা। রাজা রামমোহন রায়কে বাংলা রেনেসাঁস বা নবজাগরণের বরপুত্র বলা হয়। বিদ্যাসাগরের সামগ্রিক অবদান রামমোহনের চেয়েও গভীর এবং অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। তবু বিদ্যাসাগর যেন কোন অজ্ঞাত কারণে কিছুটা নিষ্প্রভ, উপেক্ষিত। অনেকে তাকে কেবল 'দয়ার সাগর', 'করুণার সাগর' বলে বাহবা দিয়েই তৃপ্তি লাভ করেন কিংবা দায় সারেন। বাঙালি সমাজকে, বাঙালি জীবনকে মুক্তির পথ দেখাতে বিদ্যাসাগরের প্রতিটি কর্মযজ্ঞ যে কতটা সুদূরপ্রসারী তা আমরা আজও অনুধাবন করতে পারি না। গড়পড়তা দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকে বিচার করা সমীচীন হবে না।

বাংলা রেনেসাঁস যে সর্বব্যাপী হয়নি- তা যে পুরো বাঙালি সমাজকে স্পর্শ করতে পারেনি- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জাগরণকালে 'ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী'র সুনাম-দুর্নাম সম্পর্কে সবাই জানি। ইউরোপীয় জীবনাদর্শ, কর্মোদ্দীপনা, মানবমহিমা প্রতিষ্ঠার প্রেরণা কেউ কেউ মানবমুক্তির প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

ঔপনিবেশিককালে কতিপয় ব্যক্তিত্ব এতটা আলোকিত ছিলেন যে তাদের মতো আলোকিত মানুষ গত দুইশ বছরেও খুব একটা চোখে পড়ে না। একালে তো ওনারা বিস্ময়মানব! রেনেসাঁসের প্রাণপুরুষখ্যাত রাজামোহন রায়ের ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের কথা সকলেই জানে। 'ব্রাহ্ম সমাজ' প্রতিষ্ঠা এবং 'সতীদাহ উচ্ছেদ' প্রয়াসে তার অনন্য অবদানের কথা সর্বজনবিদিত।

সাহিত্য সংস্কারে মাইকেল মদুসূদন দত্ত ছিলেন অগ্রপথিক। তিনি সাহিত্যে নবযুগ আনেন আঙ্গিক-প্রকরণে এবং নবতর দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারে, শিক্ষা-বিস্তারে, বিধবা-বিবাহ প্রচলনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করলেন। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মানবমহিমার জাগরণ ও বিকাশের পরম্পরায় নিঃসন্দেহে অবিসংবাদিত ভূমিকায় সমাসীন। আরও অনেক মানবতাবাদী আত্মত্যাগী বরেণ্যজনের দৃষ্টান্ত আমরা হাজির করতে পারব অনায়াসে; কিন্তু বিদ্যাসাগর একজনই। বিদ্যাসাগরের অবদান অনন্য। তার কাজের তাৎপর্য ও ব্যাপ্তি সুগভীর-সুপ্রশস্ত।

'বিধবা বিবাহ' প্রচলনকেই বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে এটি তার জীবনে অসাধারণ অর্জন। এটি তার মনুষ্যত্বের পরীক্ষা। এ কারণে তাকে করুণাসাগর কিংবা মানবতার বিগ্রহ বলেন অনেকে। আমরা মনে করি বিদ্যাসাগরের আরও তাৎপর্যপূর্ণ কর্মস্পৃহা লুকিয়ে আছে অন্যত্র। তা বলবার আগে তার ব্যক্তি-স্বভাব সম্পর্কে দুটো বৈশিষ্ট্যের কথা বলা দরকার- 

ক. বাহ্যিক আবরণে একে তো তিনি টিকিপরা ব্রাহ্মণ; অন্তঃকরণে উদার-অসাম্প্রদায়িক-মানবিকতাবোধে উচ্চকিত।

খ. ভেতরে করুণা ও দয়ার ফল্গুধারা প্রবহমান কিন্তু সমান্তরালে মনোলোকে প্রচণ্ড জেদ, আপসহীনতা এবং একগুঁয়েমির প্রচণ্ডতাও ক্রিয়াশীল ছিল।

এই জেদ এবং আপসহীনতা তার চরিত্রের বলিষ্ঠ দিক। এই স্বভাবই তাকে চরম প্রতিকূল স্রোতেও নিরলস কাজ করার প্রেরণা যুগিয়েছে সন্দেহ নেই। তাকে করেছে মহত্তম। কিন্তু তার মহৎ ও বড় কাজের উদ্দেশ্য ও গতি-প্রকৃতিকে করেছে স্থবির এবং সীমায়িত। তার চরিত্রে যদি আপসকামিতা থাকত তবে হয়তো বিদ্যাসাগরের অনেক প্রতিষ্ঠানই আজও বাঙালি সমাজে সগৌরবে টিকে থাকত। আফসোস জাগে, বিদ্যাসাগরের মতো এমন মানব-অন্তঃপ্রাণ মানুষের হিতকরী প্রয়াসগুলো সমসাময়িককালের ক্ষমতাসীন ইংরেজ এবং বাঙালি উচ্চ পদবিধারী কর্তাব্যক্তিগণের বৈরি মনোভাবের কাছে অনেকাংশেই পরাভূত হলো! বিদ্যাসাগরের অন্তরে ছিল বাঙালি মায়ের মতো দরদ, দয়া আর করুণার ঝর্ণাধারা। আধুনিক ইউরোপীয় জীবনদৃষ্টি এবং তাদের কর্মোদ্দীপনা ছিল তার। রেনেসাঁসের ফলে প্রাপ্ত মানবমহিমাকে তিনি সহজাতভাবেই আশ্রয় করেছিলেন। বিদ্যাসাগর তার কালের চেয়ে প্রাগ্রসর মানুষ ছিলেন। তাই তার কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে কোনও ভাবনাই কর্তাব্যক্তিদের মনে রেখাপাত করেনি অথবা অন্যভাবে বলা যায়- ক্ষমতাসীন বর্গের কর্তারা কখনোই চান না প্রজাকূল প্রকৃত শিক্ষার দিশা পাক কিংবা মানুষের মুক্তি ত্বরান্বিত হোক।

বিদ্যাসাগরের জীবনের দুটো ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই এই আপত্তিকর বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে চাকরি ছেড়ে বিদ্যাসাগরের প্রথম দফায় যখন সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেন, তখন তার পেছনে একটি বড় চিন্তা কাজ করেছিল- সেটি হলো তার শিক্ষা-ভাবনাকে ভালোভাবে কাজে লাগাবেন তিনি। এই স্বপ্নই তাকে তাড়া করছিল সেই সময়। সংস্কৃত কলেজের আমূল সংস্কারের জন্য প্রথমেই পাঠক্রম পরিবর্তন করতে তিনি তার প্রস্তাবনাও পেশ করলেন। বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অনন্যতা মূলত এই শিক্ষা-দর্শন ও চিন্তায়। বাঙালি সমাজ ও বাঙালি সর্বস্তরের মানুষকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন এবং প্রয়াস লালনকারী বাঙালিজনের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিদ্যাসাগরকেই আমরা ব্যাপকভাবে পাই। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন সংস্কৃত জ্ঞানভান্ডার ও ইংরেজি জ্ঞানভান্ডারের সম্মিলিত সম্পদে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের স্বদেশীয় ভাষাসমূহকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হলো- পাশ্চাত্য প্রভাবিত হয়েও বিদ্যাসাগর নিজস্ব সমাজ ও স্বদেশের কৃষ্টি-কালচারকেই মূলত বিকশিত করতে চেয়েছিলেন। তার শিক্ষাদর্শ নিঃসন্দেহে বি-উপনিবেশবাদী কাঠামোতে সিদ্ধ। আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক সভ্যতার প্রণোদনায় ভারতীয় সমাজকে উজ্জীবিত করাই বিদ্যাসাগরের ব্রত ছিল। তবে তা একান্তই স্বীয় সমাজের উপাদান ও শক্তির উদ্বোধনের ভেতর দিয়ে। বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টা যে বাধাগ্রস্ত হবে- তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না! এই কাজে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্ত। কারণ আর কিছুই নয়- বিদ্যাসাগর তাকে তোয়াজ করতেন না; আপনকর্মে বিভোর থাকতেন সর্বদা। ফলে রসময় দত্তের মানসিক সংকীর্ণতা ও ঈর্ষা বাঁধ সাধলো বিদ্যাসাগরের শিক্ষাদর্শ বাস্তবায়নে।

বিদ্যাসাগরের সমর্থনেও ছিলেন অনেক ইংরেজ এবং সংস্কৃত কলেজের কতিপয় পদ্ধতি। কেননা বিদ্যাসাগর অল্পদিনেই তার মেধা, শ্রম ও কর্মদক্ষতা দিয়ে সংস্কৃত কলেজের প্রাণ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কর্মে অনিচ্ছুক বড়কর্তা রসময় দত্তের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতদ্বৈততা চরমে উঠল। অসম্ভব জেদি ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বিদ্যাসাগর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন শিক্ষাবিভাগের কর্মকর্তা ড. ময়েটের কাছে। সংস্কৃত কলেজের তেরজন পদ্ধতি মিলে আবেদন করেছিলেন- বিদ্যাসাগরকে যেন কলেজ না ছাড়ে! রসময় দত্ত বিদ্যাসাগরকে পদত্যাগের কারণ দর্শাতে বলেন। জবাবে বিদ্যাসাগর যা লিখেছিলেন তা কর্তৃপক্ষের কাছে হুবুহু পাঠাতে পারেননি রসময় দত্ত। কারণ রসময় দুরুহ সব কাজ চাপিয়ে দিতেন বিদ্যাসাগরের কাঁধে। এছাড়া সত্য-মিথ্যা অনেক গুজব ছড়াতেন বিদ্যাসাগরকে জব্দ করতে। বিদ্যাসাগরের জবাবের মধ্যে ছিল সত্যতা, স্পষ্টবাদিতা, অন্যায়ের প্রতি তীব্র দ্রোহ, চারিত্রিক দৃঢ়তা, তীব্র জেদ ও আত্মাভিমান। কলেজ ছাড়ার পর অনেক হিতৈষীরা যখন আফসোস করতেন- বিদ্যাসাগর খাবে কী- তার তো শিক্ষার্থী-পরিবারসহ অনেক পোষ্য- তিনি একমাত্র উপার্জনকারী। বিদ্যাসাগর হিতৈষীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, 'রসময় দত্তকে বলো বাজারে আলুপটল বেচব, তবু মত বিকিয়ে চাকরি করব না।' বিদ্যাসাগর তারপর চাকরিহীন সময় কাটান ১ বছর ৮ মাস। তাই বলে নিষ্ক্রিয় বসে থাকবার মানুষ তো তিনি নন। 'বেতালপঞ্চবিংশতি' প্রকাশিত হয় এই সময়। 'বাঙ্গালার ইতিহাস' (দ্বিতীয় ভাগ), 'জীবনচরিত' গ্রন্থ রচনার কাজ চলতে থাকে। স্বাধীন ব্যবসায়ের ক্ষেত্র হিসেবে 'সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরিও' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরের বছরই বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে একযোগে স্থাপন করেন ছাপাখানা 'সংস্কৃত যন্ত্র'। এতেই বোঝা যায় তার কর্মপ্রেরণার মূলে ছিল নিজস্ব শিক্ষাদর্শ এবং তা কার্যকর করবার জন্য তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন সেই মহৎ ব্যক্তিগত অথচ জাতীয় দায়িত্ব।

মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের জন্য কোন ধরনের পুস্তক রচনা আবশ্যক- তাও তিনি স্থির করেছিলেন। বলা যায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদ তিনিই প্রথম নির্মাণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের শিক্ষাদর্শ ব্যাপ্ত হয়েছিল মূলত শিক্ষা-সংস্কারের তাগিদ থেকে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অসাড়তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা-কারিকুলামের খোলনলচে তিনি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠন, মেট্রোপলিটন কলেজ গড়া তার প্রাথমিক প্রয়াস। আরও ব্যাপক এবং বড় দুটো প্রয়াস ব্যর্থ হয় তাঁর- 

ক. জনশিক্ষার জন্য বঙ্গবিদ্যালয়, গুরুট্রেনিং স্কুল প্রভৃতি স্থাপন করে শিক্ষার আলো দেশে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা।

খ. বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীদের মধ্যে আলো বিস্তারের তীব্র বাসনা। এই কাজেই সরকারের সঙ্গে বিরোধ বাধে তার। এই বিরোধের মুখেই এই অজেয় পুরুষ সেদিন স্বেচ্ছায় চাকরি ত্যাগ করেছিলেন।

জনশিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় সরকারের ঔদাসীন্যে। তিনি বুঝতে পারেননি এটিই শাসকের স্বার্থ। জনগণকে নিরক্ষর রাখতে পারলেই শাসকদের ফায়দা। তিনি খোদ বাঙালিদের মধ্যেও বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রতি ঔদাসীন্য দেখেছেন। মধ্যবিত্তের স্বার্থও তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। অর্থাৎ পড়াশোনার বাজারমূল্য তিনি নিরূপণ করতে যাননি; তিনি চেয়েছিলেন জনমানুষকে শিক্ষিত করে স্বসমাজের প্রকৃত মুক্তি এবং জাগরণ। সাধারণ মানুষ বাংলামাধ্যমে পড়াশোনা শিখে চাকরি পাবে না। চাকরি পাবে ইংরেজিওয়ালারা। ১৯৩৮ সালের পর থেকে ইংরেজি শিক্ষা এবং চাকরি একইসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। চাকরিই যেন মধ্যবিত্তের নবধর্ম। এই প্রবণতা সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বিস্তৃত।

উত্তর ঔপনিবেশিক মানদণ্ডে বিচার করলেও, আমদের অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না যে- বিদ্যাসাগরের শিক্ষাদর্শনই ছিল প্রকৃত জাতিগত মুক্তি-প্রেরণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যা ভারতীয় সমাজকে স্বকীয় শক্তিতে উজ্জীবিত এবং বলীয়ান করে তুলত। আরেকটি ঘটনার কথা আমরা সকলেই জানি- একবার রিপন কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগরের অফিসে এসেছিলেন। বিদ্যাসাগরের মুখোমুখি বসলেন তিনি। নেটিভদের প্রতি তাচ্ছিল্য ছিল ওদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। বসেই তিনি টেবিলের ওপর পা দুটো উঠিয়ে দিয়ে বিদ্যাসাগরের ঠিক মুখের সামনে দোলাচ্ছেন। বিদ্যাসাগর মুহূর্তটিকে হজম করলেন। পরের সপ্তাহে তিনি রিপন কলেজে গিয়ে ঐ ইংরেজ অধ্যক্ষের অফিসে প্রবেশ করে- মুখোমসুখি বসে পা দুটো তার মুখের কাছে তুলে চটি জুতো দুলিয়ে নির্বাক প্রতিশোধ নিয়ে ফিরে এলেন। উনি আমাদের বিদ্যাসাগর। অসীম তেজ, অসীম করুণা ছিল তার অন্তরজুড়ে। মাইকেল মধুসূদনকে দুই-তিনবার ফ্রান্সে অর্থ পাঠিয়ে ঋণমুক্ত করেছিলেন। বিধবাদের নিজের বাড়িতে রেখে ভরণ-পোষণ দিয়ে লালন-পালন করতেন। পড়াশোনা করাতেন। নিজের পুত্রকে বিধবা বিবাহ করিয়ে প্রমাণ করলেন- তিনি লেবাসধারী সংস্কারক নন। ওই সময়ে নিজের টাকায় পাত্রের জন্য অর্থমূল্য ঘোষণা করে বিধবাদের বিয়ের আয়োজন করা সহজ কথা নয়। এসব কাজ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিকেও তিনি অগ্রাহ্য করেছেন।

সময় কত গড়িয়েছে! কিন্তু আমাদের অনুমান একবিংশ শতাব্দীর আজকের বাঙালি সমাজে একজন বিদ্যাসাগর এলে এই অসীম চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো করতে পারতেন না; কাজ সম্পন্নের আগেই কট্টরপন্থিদের হাতে নিহত হতেন। বাংলা গদ্যকে সুসজ্জিত ও ছন্দময় করলেন তিনি। তিনিই তো আমাদের বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্রের বিচিত্র টেক্সট বুক রচনারও প্রথম কারিগর তিনি। অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমেও পাঠ্যক্রম তৈরির প্রয়াস ছিল তার। 'বেতালপঞ্চবিংশতি', 'অভিজ্ঞান শকুন্তলা', 'ভ্রান্তিবিলাস' তার সার্থক অনুদিত গ্রন্থ। বন্ধুর মেয়ে প্রভাবতীকে নিজকন্যা জেনে লালন করতেন বিদ্যাসাগর। প্রভাবতীর অকাল প্রয়াণে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' গ্রন্থে বিদ্যাসাগরের অন্তরের করুণার ফল্গুধারা বয়ে গেছে। তার 'বর্ণপরিচয়' আজও আমাদের পাথেয়। তার রচিত 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' পঙ্ক্তির ধ্বনিমাধুর্য ও অনুপ্রাসে আন্দোলিত বালক রবীন্দ্রনাথ তীব্রভাবে আলোড়িত এবং প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার 'জীবনচরিত', 'বোধোদয়', 'বাঙ্গালার ইতিহাস' প্রভৃতি গ্রন্থ আজও সেই সময়ের প্রাগ্রসর চিন্তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিধবা বিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ রোধেও তিনি লিখেছেন। 'বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব', 'বহুবিবাহ রদ হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষক ভাবনা', 'অতি অল্প হইল', 'আবার অতি অল্প হইল'- প্রভৃতি রচনা সমাজ-সংস্কারে অনন্য ভূমিকা রেখেছে।

মানুষের জন্য পুরো জীবন ব্যয় করলেন বিদ্যাসাগর। চাকরির উপার্জন, পুস্তক রচনা করে বিক্রিত অর্থ সমস্ত কিছু ব্যয় করলেন মানুষের জন্য। এই নিমকহারাম বাঙালি কতটুকু মূল্যায়ন করতে পেরেছে বিদ্যাসাগরকে! আদৌ পারেনি। তাই তো জীবনের শেষবেলায় বাঙালি মানুষের ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন বোধকরি। নয়তো তীব্র অভিমানে সাঁওতাল পল্লিতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গিয়েও কি মানুষের কাছ থেকে বিমুখ হতে পেরেছিলেন বিদ্যাসাগর! পারেননি। অভাবক্লিষ্ট দরিদ্র সাঁওতালদের ভূট্টা কিনে খাওয়াতেন তিনি! তার মতো মনুষ্যত্ববোধে জাগ্রত একক বাঙালি প্রাণ আর দেখি না। আহা বিদ্যাসাগর ! এমন মহীরূহ- মহৎ মানবাত্মা হয়েও তুমি আজও উপেক্ষিতই রইলে।

Comments