হোসেন শাহী আমলের অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা ও মমতাজুর রহমান তরফদার

হোসেন শাহী আমলের যথার্থ ও যুতসই মূল্যায়ন ছাড়া ভারত উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হবে না। মুসলমান রাজা-রাজড়াদের সময়ে ধর্ম নিরপেক্ষতার রাজসিক অবস্থান উপেক্ষিত এবং তা ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ। এ কারণে এই আমল নিয়ে নির্মোহ গবেষণা ও স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ কেবল জরুরি নয়—একটা জাতির আত্ম-আবিষ্কারের জন্য নির্ভরযোগ্য পথ ও পন্থা।

হোসেন শাহী আমলের যথার্থ ও যুতসই মূল্যায়ন ছাড়া ভারত উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হবে না। মুসলমান রাজা-রাজড়াদের সময়ে ধর্ম নিরপেক্ষতার রাজসিক অবস্থান উপেক্ষিত এবং তা ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ। এ কারণে এই আমল নিয়ে নির্মোহ গবেষণা ও স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ কেবল জরুরি নয়—একটা জাতির আত্ম-আবিষ্কারের জন্য নির্ভরযোগ্য পথ ও পন্থা।

মমতাজুর রহমান তরফদার এই কাজে আমাদের কাছে ইতিহাসের সত্য উন্মোচন ও আবিষ্কারের দূত এবং প্রজ্ঞার বাতিঘর। একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের কাজের সঙ্গে মানবতাবাদ, দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি হলে কাজের উচ্চতা এবং মান কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়—তার অনুপম উদাহরণ তিনি। বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার প্রারম্ভিক লগ্নের ঠিকুজি জানতে এবং অতীতের আলোয় বর্তমানকে নির্মাণের লক্ষ্যে বারবার ফিরে আসতে হবে হোসেন শাহী আমলের কাছে; সেই সূত্রে মমতাজুর রহমান তরফদারের সন্নিকটে। 

বাঙালির ইতিহাস চর্চায় যারা রেখেছেন গৌরবদীপ্ত অবদান, সেই সব ঐতিহাসিক—যদুনাথ সরকার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আবু মহামেদ হবীবুল্লাহদের কাতারে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন যুগন্ধর সব গবেষণাকর্মে। দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ-পাঠ-মূল্যায়নের পাশাপাশি তিনি এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণ-প্রতিতুলনা উপস্থাপন, বিশ্ববীক্ষা ভাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিষ্ঠা-শ্রম ও বৌদ্ধিকতায় এষণাকে উন্নীত করেছেন ইতিহাস ও কালের মহামূল্যবান দলিলরূপে। এখানেই মমতাজুর রহমান তরফদারের অনন্যতা। 

ঐতিহাসিক পরম্পরা, ইতিহাসের বাঁকবদল ও সাহিত্যের বিবিধ বিষয় নিয়ে তার কাজসমূহ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। বাঙালি জাতির হাজার বছরের যাত্রার প্রবাহ বুঝতে এবং বাঙালি মুসলমানের স্বরূপ খুঁজে পেতে তিনি আলো জ্বালিয়েছেন এমন সব জায়গায়, যা আমাদের ফেলে আসা অতীত হলেও বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর যথার্থ পাঠ ও সঠিক মূল্যায়ন ব্যতিরেকে আমাদের বর্তমান শক্ত অবস্থানের ওপর দাঁড়াতে পারে না, যৌক্তিক কাঠোমোও গড়ে ওঠে না। উপর্যুক্ত বয়ানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনে তার শ্রেষ্ঠ কাজ হলো, 'হোসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮ একটি সামাজিক রাজনৈতিক পর্যেষণা'।

হোসেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলাউদ্দীন হোসেনশাহ। আরও ৩ জন—নাসির উদ্দীন নসরত শাহ, আলাউদ্দীন ফিরূজ শাহ, গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ মিলে মোট ৪৪ বছর রাজত্বকাল জারি রাখেন। এই রাজবংশের শাসনকালেই চৈতন্যের বেড়ে ওঠা-উত্থান-ধর্ম প্রবর্তন ও নবজাগরণের ঘটনা। তিনি জন্মেছিলেন শাসনকাল শুরুর মাত্র আট বছর আগে ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। মারা যান ১৫৩৪ সালের ১৫ জুন। তখনো হোসেন শাহী রাজবংশের পতন হতে আরও ৪ বছর বাকি। মমতাজুর রহমান তরফদারের গবেষণা থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারি, প্রায় ৫০ বছরের হোসেন শাহী আমলের পুরোটা সময়ে এই উপমহাদেশে বাংলা অঞ্চলের কোথাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।

অথচ বর্তমান সময়ে ত্রিধাবিভক্ত ভারতবর্ষের সবেচেয়ে বড় দেশটির ক্ষমতা প্রধানরা সাম্প্রদায়িকতার যেকোনো প্রশ্নে মুসলমানদের প্রতি কেবল অঙ্গুলি নির্দেশ ও বাক্যবাণ বর্ষণই করেন না, বর্তমানের ওপর দায় ও দোষ চাপানোর পাশাপাশি অতীতকেও কলঙ্কিত করে ইচ্ছেমতো কালিমা দেন। বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটেছে, তা এই উপমহাদেশে হাজার বছর ধরে চলে আসা ধর্ম নিরপেক্ষ চেতনাকে লুণ্ঠিত ও কলঙ্কিত করেছে। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার যে স্বর ও সুর তার সঙ্গেও এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভারতবর্ষ ইহুদি-খ্রিস্টান-পারসি-মুসলিম সকলকেই আশ্রয় দিয়েছে এবং সহবস্থানে রেখেছে আস্থা ও বিশ্বাস। বিবেকানন্দের সেই ভারতের ঐতিহ্য ও  আদর্শ কী হারিয়ে যাবে? এই উপমহাদেশ কেবলই কি সংখ্যাগরিষ্ঠের ও শাসকবর্গের বাসস্থানে পরিগণিত হবে? নানা ধর্ম, নানা মতের বৈচিত্র্যে ভরা বিচিত্র সৌন্দর্য, সম্পদ ও ঐশ্বর্যের যে ভারতবর্ষ—তা কী কেবলই কথার কথা হয়ে থাকবে?

ভারতের বর্তমান শাসকবর্গ অন্য মতের ওপর শ্রদ্ধাশীল তো নয়ই, বরং জ্ঞানবাপী মসজিদ ও তাজমহলের মতো বিশ্বনন্দিত স্থাপনা এবং ইমারতের দিকেও শ্যেনদৃষ্টি জারি রেখেছে। তারা কেবল মুসলিম শাসনামলে নির্মিত ও ইসলামের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থাপনার প্রতিই খড়গহস্ত হচ্ছে না, মুসলমান নামীয় রাস্তা-প্রতিষ্ঠান-স্থান-জনপদের নাম বদলানোর পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক থেকেও সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে মুসলমান রাজা-বাদশাহ ও প্রজাদের ইতিবাচক ঘটনাসমূহ। এসব যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক-অশোভন ও লজ্জাকর, তা তারা বুঝতেও অপারগ। এসবের ফায়সালা করতে হলে আমাদেরকে মমতাজুর রহমান তরফদারের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের কাছে ফিরে আসতে হবে। কেননা তাদের যথাযথ জবাব দেয়ার যুৎসই ও যথার্থ উপাদান এবং  প্রসঙ্গসমূহের সমুচিত জবাব রয়েছে তার গবেষণাকর্মে।

মনে রাখা প্রয়োজন, হোসেন শাহী আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম রাজত্ব শুরু হওয়ার সময়টি এমন একটি কালকে ধারণ করে যার ওপর ভিত্তি করে বেগবান হয় মুঘল-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসনামল। আর তার আগে রয়েছে ২০০ বছরের মুসলিম শাসন। ফলে, এই রাজবংশ উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে। তাদের যেমন ছিল ঐতিহ্যগত পরম্পরা এবং অতীতের দায়-দায়িত্ব, তেমনি সুন্দর আগামী নির্মাণের ঐতিহাসিক বাস্তবতা। যা সম্ভব ছিল কেবল সুন্দর বর্তমান গড়ার মধ্যে দিয়ে। হোসেন শাহী আমলের শাসকেরা বাংলা অঞ্চলে সেদিনের সুন্দর বর্তমান নির্মাণ করেছিলেন। মমতাজুর রহমান তরফদার আমাদের সেই সুন্দরের সন্ধান দিয়ে বাঙালি মুসলমানের অতীতকে যেমন গৌরবমণ্ডিত করেছেন, তেমনি বর্তমানকেও করেছেন সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষ গড়ার বীজমন্ত্র।

হোসেন শাহী আমল নিয়ে মমতাজুর রহমান তরফদার ১০টি অধ্যায়ে ইতিহাসের ধূসর পর্বে নোঙর ফেলে তুলে এনেছেন সেই সময়ের শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক জীবন, ধর্মীয় জীবন, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মীয় রীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা, চারুকলা ও স্থাপত্য, জীবনচর্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ভেতর-বাহির। এসবের মধ্যে দিয়ে আমরা একটা রাজবংশের ব্যাপারে যদি আক্ষরিক অর্থেই কোনো উপসংহার টানি, তাহলে দেখব, শাসকেরা রাজার ধর্ম পালন করলেও জনজীবনে ঐক্য-সংহতি-সমুন্নত জীবনচর্যা ও সমন্বয়ী ধর্ম প্রতিপালনের ওপরেই সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন এবং সেই লক্ষ্যেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

মমতাজুর রহমান তরফদার মনে করেন, 'হোসেন শাহী শাসনামল হচ্ছে বাংলার ইতিহাসের গঠনমূলক পর্ব'। তার এই মতামতকে আমরা মান্যতা দেই এবং যথার্থ জ্ঞান করি। আমরা মনে করি, 'গঠনমূলক পর্ব' বলেই একসময়ের অখণ্ড ভারতের বিভক্ত ৩ দেশ—বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাসের আলোয় বর্তমানকে নিরূপণ-মূল্যায়ন ও বিনির্মাণ করতে হলে হোসেন শাহী আমলের সারাৎসারের যথার্থ বোঝাপড়া জরুরি।

পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই সাম্প্রদায়িক এক দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন। সে লক্ষ্যে এগিয়ে, প্রথম সংবিধানে সেটা প্রতিষ্ঠাও করা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে ধরে রাখা যায়নি। সংবিধানে প্রথমে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' সংযোজিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে ইসলামকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি। ভারত সাংবিধানিকভাবে এখনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে রয়েছে। কিন্তু তাদের শাসকবর্গের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে তার নজির পাওয়া দুষ্কর। এ অবস্থায় হোসেন শাহী শাসনামলকে গভীরভাবে পাঠ করা জরুরি। এই শাসনামলের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় জীবনাভিজ্ঞতা থেকে  অনেককিছু নেওয়ার আছে উপমহাদেশের ৩ দেশের।

অবশ্য ভারতের ক্ষেত্রে মনে হয় একটু বেশিই নেওয়ার রয়েছে। কারণ, সেখানকার শাসকবর্গ যেভাবে মুসলমান সময়কালকে কালিমা দিচ্ছেন, তাতে যদি ঐতিহাসিক সত্যকে সারবান জ্ঞান করা না হয়, তাহলে তা আখেরে কারুর জন্যই ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। মুসলিম শাসকরা যদি সকলেই মন্দ ও হিন্দু বিদ্বেষী হতো, তাহলে ভারতবর্ষে হিন্দুদের অস্তিত্ব অনেক আগেই লোপ পেত।

ভারতে এখনো হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সেটা বিপুল পরিমাণে। মুসলিম রাজাদের সময়েও তারা একই বাস্তবতায় সর্বৈবভাবেই বিরাজমান ছিল। অথচ আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে ভারতের এখনকারা শাসকবর্গ। আকবর থেকে টিপু সুলতান সকলেই তাদের কাছে কেবল মন্দ শাসকই নয়, বরং হিন্দু নিধনকারী হিসেবেও চিহ্নিত। অথচ এইসব অভিযোগ ও অভিযুক্তির কোনো দলিল-দস্তাবেজ এবং ঐতিহাসিক সত্যতা নেই।

আওরঙ্গজেব যে খলনায়ক নন, তা অড্রে ট্রুসকের মতো ইতিহাসবিদ যেমন ইতিহাসের নানা দলিলপত্র ঘেঁটে প্রমাণ করেছেন, যদুনাথ সরকারের লেখায় উঠে এসেছে। এমনকি আওরঙ্গজেবকে এখন শিবাজীর প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু তার জীবনী ও চিঠিপত্রের কোথাও এ বিষয়ে বিন্দুবৎ বিষোদ্গারের কোনো উচ্চারণ নেই। এমনকি গোবিন্দ পানসারের বহুল পঠিত ও বিক্রিত বই 'কে ছিলেন শিবাজি'তেও এ সম্পর্কিত কোনো কথা পাওয়া যায় না। আবার 'আওরঙ্গজেবের পত্রাবলী'র মধ্যে কোনো প্রকার হিন্দু বিদ্বেষের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না।

মুসলমান শাসনামলে যদি সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হতো এবং কোনোপ্রকার সহিংসতার ঘটনা ঘটতো তাহলে হোসেন শাহী রাজবংশের সময়ে চৈতন্যের নবজাগরণ আন্দোলন আকাশচুম্বী সাফল্য পেত না। বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশও ঘটত না। চৈতন্যের জন্মের ৫০০ বছর পূর্তিতে 'চৈতন্যদেব: ইতিহাস ও অবদান' নামে দুই বাংলার ২৩ জন পণ্ডিতের লেখা নিয়ে ঢাউস আকারের যে বই বেরিয়েছে, তার কোথাও চৈতন্য তার জ্ঞানচর্চা ও ধর্ম প্রচারে হোসেন শাহী শাসক-প্রশাসক-অনুচর-সমর্থকদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি সে সময় বাংলা অঞ্চলে সতীদাহ প্রথার প্রচলন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের তুলনায় ছিল না বললেই চলে। মমতাজুর রহমান তরফদার জানাচ্ছেন, 'সমকালীন কিছু সাহিত্যে সতীদাহ প্রথার উল্লেখ থাকলেও এদেশে এটা সর্বজনীনভাবে পালিত হতো বলে মনে হয় না। শ্রীচৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্র মৃত্যুবরণ করার পর তার স্ত্রীর সহমরণ ঘটেনি। আবার মাঝে-মধ্যে সমকালীন রচনাবলীতে বিধবা শ্রেণীর অস্তিত্বের উল্লেখ থেকে ধারণা করা যায় যে, নিয়মিতভাবে বা একইরূপে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল না।'

বাঙালি মুসলমানের শেকড় সন্ধানে হোসেন শাহী আমল বিবিধ কারণে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ একাধিক এবং সবগুলোই বিশেষভাবে বিশ্লেষণ ও গবেষণার দাবি রাখে।

ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার নজির নতুন কিছু নয়—এ কথা তাৎক্ষণিকতার বিচারে সত্য মনে হলেও সর্বাংশে সত্য নয়। বিশেষ করে উপমহাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাস-সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিবিধি ও প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি রাখলে বিষয়টা পরিষ্কাররূপে ধরা দেয়। তেমনি চাপা পড়ে যাওয়া অনেক সত্যের সুলুকসন্ধানও ঘটে এর মাধ্যমে। এ কারণে হোসেন শাহী আমল পাঠ ও পর্যবেক্ষণ জরুরি। এক্ষেত্রে মমতাজুর রহমান তরফদারের গবেষণা মস্ত বড় এক দাওয়াই।

হোসেন শাহী আমলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার যে উদারনৈতিক অবস্থান; তাও বিশেষভাবে আগ্রহোদ্দীপক। এসময় বেশ কয়েকজন মুসলিম সাহিত্যিকের আগমন ঘটে। তখন হিন্দু ও মুসলিম সাহিত্যিকরা যেমন নিজ নিজ ধর্মের কাহিনী-চরিত্র ও পার্শ্বচরিত্র নিয়ে লিখছেন, আবার অন্য ধর্মের বিষয় ও চরিত্রও তাদের লেখার বিষয় হয়েছে উঠেছে। সম্প্রীতির পরিবেশ ও প্রতিবেশ না থাকলে যে এভাবে লেখা ও ভাবা যায় না, তা বলাই বাহুল্য। মমতাজুর রহমান তরফদারের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি, হোসেন শাহী আমলের শাসকবর্গ দেশের সীমানা সম্প্রসারণে যুদ্ধংদেহী হলেও, সমাজের ভেতরে কোনো প্রকার উগ্রতা কিংবা যুদ্ধংদেহী আচরণ করতেন না। এই রাজবংশের শাসনকালেই চট্টগ্রাম বাংলা অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হয়।

মমতাজুর রহমান তরফদারের 'হোসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮ একটি সামাজিক রাজনৈতিক পর্যেষণা' গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল, যেখানে একজন ঐতিহাসিক গবেষণার সকল উপাদানকে যথার্থ অর্থেই কাজে লাগিয়েছেন। দলিলপত্রতো ঘেঁটেছেনই, ইতিহাসের স্বরূপ সন্ধানে সে সময়ের শিলালিপি ও মুদ্রার আশ্রয়ও নিয়েছেন।

একজন গবেষককে কতটা নিষ্ঠার স্বাক্ষর রাখতে হয় এষণাকর্মে তার মহত্তম উদাহরণ তিনি। জন্মেছিলেন ১৯২৮ সালের পয়লা আগস্ট, মারা যান ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর সমান বাঁচেননি বৌদ্ধিক এই ব্যক্তিত্ব। কিন্তু জীবনকে গবেষণা ও শিক্ষকতার মাধ্যমে এমনভাবে উচ্চকিত করেছেন, যা জয় করেছে ইতিহাস ও কালকে।

বাঙালি মুসলমানকে যেমন তার শেকড় অনুসন্ধান, ইতিহাসের সত্য আবিষ্কার ও উন্মোচনে মমতাজুর রহমান তরফদারের কাছে ফিরে ফিরে আসতে হবে, তেমনি উপমহাদেশের বিদ্বজ্জনদেরও অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস অন্বেষণে তার আশ্রয় নিতে হবে।

কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

 

Comments