চিত্রকল্পের কবি জীবনানন্দ দাশ

কবি জীবনানন্দ দাশ ও তার ধূসর পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, 'আমাদের কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ সবচেয়ে কম 'আধ্যাত্মিক', সবচেয়ে বেশি 'শারীরিক'; তার রচনা সবচেয়ে কম বুদ্ধিগত, সবচেয়ে বেশি ইন্দ্রিয়নির্ভর।' এরও প্রায় এক বছর পূর্বে ১৯৩৫ সালের ৩ অক্টোবর বুদ্ধদেব বসুকে লেখা একটি পত্রে জীবনানন্দের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে। তিনি জীবনানন্দের কবিতায় 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ' অনুভব করেছেন। প্রথমত রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিতীয়ত বুদ্ধদেবের এই মন্তব্য ইন্দ্রিয়বেদ্য চিত্রকল্পের কবি জীবনানন্দ দাশকে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কবিতা পাঠে ইন্দ্রিয়বেদ্য চিত্রকল্পের যে বিচিত্র ও বহুলব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, তা বাংলা কবিতায় একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। নজরুলের কবিতায় সাত ধরনের ইন্দ্রিয়বেদ্য চিত্রকল্পের ব্যবহার রয়েছে। যথা: দৃশ্যরূপময়, ধ্বনিরূপময়, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ময়, স্বাদেন্দ্রিয়ময়, স্পর্শেন্দ্রিয়ময়, শারীরিক গতিরূপময় এবং জৈবিক চিত্রকল্প। জীবনানন্দের কবিতায় এসবের বাহিরেও আর এক ধরনের ইন্দ্রিয়বেদ্য চিত্রকল্পের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার আমাদেরকে আকৃষ্ট করে। তা হলো রূপান্তরযোগ্য ইন্দ্রিয়-বিপর্যয়ধর্মী চিত্রকল্প। এক ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতাকে অন্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করানোর নূতনত্ব ও দক্ষতায় তিনি তুলনারহিত। উদাহরণ :

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
[বনলতা সেন, বনলতা সেন]

যেখানে সংবেদনশীল কবির সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়চেতনা হয়েছে সপ্রকাশিত। শিশিরের শব্দের মতন হয়েছে সন্ধ্যা। শিশিরের স্পর্শযোগ্য নরম-কোমল-মৃদুতা বিশেষভাবে আরোপ ও স্থানান্তর হয়েছে দর্শনগ্রাহ্য সন্ধ্যার স্বতন্ত্র সত্তায়। চিত্রকল্পটিতে শিশিরের শব্দের সঙ্গে রৌদ্রের গন্ধ একীভূত হয়ে সৃষ্টি করেছে উদ্ভাসনের ক্রিয়া। শিশিরের শব্দের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে রৌদ্রের গন্ধের। সোনলি ডানার চিল তার ডানা রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে; যা সম্পূর্ণ কবিকল্পনাজাত এবং ইন্দ্রিয়সংবেদ্য। অনুরূপ :

বরফ কুঁচির মতন
সেই জলমেয়েদের স্তন!
মুখ বুক ভিজে,
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল!
[পরস্পর, ধূসর পাণ্ডুলিপি]

এখানে বরফের কুঁচির সঙ্গে উপমিত হয়েছে জলমেয়েদের স্তন; যা শৈত্য স্পর্শানুভূতির পাশাপাশি নির্দেশ করেছে শীতল জল বা স্তন্যের তৃষ্ণাকে। এতে 'মুখ বুক ভিজে' শব্দবন্ধে ব্যঞ্জনাদীপ্ত হয়েছে রসনার পরিতৃপ্তি। স্পর্শযোগ্য শৈত্য রূপান্তরিত হয়েছে আস্বাদনের রূপকল্পে।

জীবনানন্দ দাশের ছয় শতাধিক কবিতায় দুশোরও বেশি বার ইন্দ্রিয়বেদ্য চিত্রকল্পের উদাহরণ মেলবে। তার চিত্রকল্প প্রধানত দৃষ্টিনির্ভর। দৃশ্যরূপময় চিত্রকল্পের পর তাঁর কবিতায় সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ময় চিত্রকল্প। তারপরও তিনি ঘ্রাণের কবি, ঘ্রাণচেতনার কবি। ইন্দ্রিয়ের বিশেষত্বকে বিচ্ছুরিত ও গুরুত্বারোপ করলে তাই দাঁড়ায়। তাঁর দৃশ্যরূপময় চিত্রকল্পের একটি অনন্য উদাহরণ হতে পারে :

সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম থেকে উঠে
দেখিবে জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে!
[অনেক আকাশ, ধূসর পাণ্ডুলিপি]

যেখানে অন্ধকারজাত আড়াল ভেঙে পাখির ডিমের মতো ফুটে ওঠা অর্থবহ আলোকপূর্ণ জীবনের বার্তা চিত্ররূপময় হয়েছে। সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম সৃষ্টি করেছে অপূর্ব ব্যঞ্জনা। অন্ধকার হয়ে উঠেছে সৃষ্টির উৎস ও জীবনের সম্ভাবনাময় অনুজ্ঞাপক। অনুরূপ :

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
[বনলতা সেন, বনলতা সেন]

যেখানে নিরাপদ আশ্রয়বিশেষ পাখির নীড়ের সঙ্গে তুলনীয় হয়েছে প্রেয়সীর গভীর কালো চোখ। চিত্রকল্পটিতে পাখির নীড়ের মতো চোখের সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রেয়সীর আধো-কথন মিলেমিশে তৈরি করেছে এক গাঢ় ও মিশ্র ইন্দ্রিয়ানুভূতি।

জীবনানন্দের ধ্বনিরূপময় চিত্রকল্পের একটি উদাহরণ :
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
[অন্ধকার, বনলতা সেন]

যেখানে কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে সৃষ্ট উৎসবের তি‌র্যক রূপ কাব্যরূপময় হয়েছে। অনভিপ্রেত বিকট ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে সংবেদনশীল কবির সমস্ত হৃদয়ের যন্ত্রণানুভূতি। চিত্রকল্পটিতে অভিব্যঞ্জিত হয়েছে সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত হবার বিপরীতে অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকার আকাঙ্ক্ষা।

জীবনানন্দের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ময় চিত্রকল্পের উদাহরণ :

চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু'বেলা
নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ— মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;
[মৃত্যুর আগে, ধূসর পাণ্ডুলিপি]

যেখানে চালের ধূসর গন্ধ ও ঘুমের ঘ্রাণ সৃষ্টি করেছে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ময় অভিব্যঞ্জনা। কবি এখানে গন্ধ বা ঘ্রাণের সঙ্গে দৃশ্য ও স্পর্শের সংমিশ্রণে তৈরি করেছেন এক মিশ্র ইন্দ্রিয়-সংবেদ। আবার :

'পরণ-কথা'র গন্ধ লেখে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কলমীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীড়ে—
[৩ সংখ্যক কবিতা, রূপসী বাংলা]

এখানে পুকুরের নীড়ে জন্ম নেয়া সবুজ-সতেজ কলমীদামের নির্যাস নিয়ে বেড়ে ওঠা রূপসীর নরম শরীরে কবি অনুভব করেছেন স্মৃতিময় 'পরণ-কথা'র গন্ধ। রূপকথার মাদকতা ইন্দ্রিয়ঘন ও ব্যঞ্জনাদীপ্ত হয়েছে ঘ্রাণের আশ্রয়ে।

'আমারও ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো/ গেলাসে গেলাসে পান করি,' [ঘাস, বনলতা সেন], 'তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে/ কবেকার সমুদ্রের নুন;' [সবিতা, বনলতা সেন], 'তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ— ধূসর চিবুক, বাম হাত/ চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে,' [৪২ সংখ্যক কবিতা, রূপসী বাংলা], 'তরঙ্গের 'পরে ঘন তরঙ্গের মধু আর দুধ,/ মেঘের গোলাপি মুখ— রৌদ্রের বুদবুদ;' [সমুদ্রচিল, অন্যান্য কবিতা] এমন অনেক উদাহরণে উঠে এসেছে জীবনানন্দের স্বাদেন্দ্রিয়ময় চিত্রকল্প ও তার স্বাদচেতনা।

জীবনানন্দে স্পর্শেন্দ্রিয়ময় চিত্রকল্পের ব্যবহার যথেষ্ট। যে-কারণে শ্যামল কুমার ঘোষ বলেন, রবীন্দ্রনাথকে যদি শ্রুতিচেতনার কবি বলি, জীবনানন্দকে বলতে হয় স্পৃশ্যতার কবি। এ-শ্রেণির অন্যতম উদাহরণ হতে পারে :

হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক ক্ষেত ছাড়ি
অন্য ক্ষেতে
চলিবে কি ভেসে
এ সবুজ দেশে
আর এক বার!
[পিপাসার গান, ধূসর পাণ্ডুলিপি]

অথবা,

চিলের ডানার থেকে ঠিকরিয়ে রোদ
চুমোর মতন চুপে মানুষের চোখে এসে পড়ে;
[অন্য এক প্রেমিককে, অন্যান্য কবিতা]

জীবনানন্দে শারীরিক গতিরূপময় চিত্রকল্প সংখ্যায় অপ্রতুল এবং তা বিশিষ্টতায় মৃদু গতিসম্পন্ন। তিনি স্বভাবে বিনম্র এবং সুরে-স্বরে অনুচ্চ প্রকৃতির হওয়ায় তাঁর চিত্রকল্পে অনুভূত হয়ে থাকে হৃৎস্পন্দন কিংবা রক্তপ্রবাহের অনুত্তেজিত গতি। যেমন :

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি;
[বনলতা সেন, বনলতা সেন]

অথবা, 'আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে/ আমার জানালার ভিতর দিয়ে শাঁই শাঁই করে,/ সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো!' [হাওয়ার রাত, বনলতা সেন]

ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি, ব্যথা, নিদ্রা ইত্যাদি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে গড়ে ওঠা জৈবিক চিত্রকল্প জীবনানন্দে অনপেক্ষণীয় প্রসঙ্গ। সহজ উদাহরণ :

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
[বনলতা সেন, বনলতা সেন]

অথবা,

নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝ'রে—
ক্লান্ত হয়ে— শিশিরের মতো শব্দ ক'রে।
[নির্জন স্বাক্ষর, ধূসর পাণ্ডুলিপি]

যেখানে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ব্যর্থপ্রেমিকের জৈবিক ক্লান্তির সংযোজন গাঢ়তর করেছে ইন্দ্রিয় অনুভূতিকে। আর কবি মাত্রই সংবেদনশীল। কিন্তু সব কবিকে ইন্দ্রিয়-সংবেদনশীল কবি বলা যায় না। জীবনানন্দের কবিতায় যেভাবে বিবিধ ইন্দ্রিয়-সংবেদ চিত্রকল্পের বিচিত্র ব্যবহার ঘটেছে, তা তাকে ইন্দ্রিয়বেদ্য চিত্রকল্পের কবি হিসেবে স্বতন্ত্র করে তোলে। তার কবিতা যে চিত্ররূপময়, বোধকরি তার মূলে রয়েছে জীবনানন্দের প্রগাঢ় ইন্দ্রিয়চেতনা।

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

6h ago