নীরদচন্দ্র চৌধুরী : তিনি আমাদেরই লোক

নীরদচন্দ্র চৌধুরী কি আমাদের লোক? দুঁদে এক প্রাবন্ধিক-আত্মজীবনী রচয়িতা-গবেষক হিসেব বিশ্বজোড়া খ্যাতি যার। বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে তো বটেই ইংরেজিতে লেখার সুবাদে ইংরেজি ভাষার মানুষের কাছেও ছিলেন বিশেষভাবে পরিচিত ও আদৃত একজন লেখক। তিনি জন্মেছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে। তাহলে কেনইবা আমরা নতুন করে বলছি, ‘তিনি আমাদেরই লোক’। বলছি, এই কারণে যে, তিনি নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী বলে পরিচয় দিয়েছেন।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী কি আমাদের লোক? দুঁদে এক প্রাবন্ধিক-আত্মজীবনী রচয়িতা-গবেষক হিসেব বিশ্বজোড়া খ্যাতি যার। বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে তো বটেই ইংরেজিতে লেখার সুবাদে ইংরেজি ভাষার মানুষের কাছেও ছিলেন বিশেষভাবে পরিচিত ও আদৃত একজন লেখক। তিনি জন্মেছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে। তাহলে কেনইবা আমরা নতুন করে বলছি, 'তিনি আমাদেরই লোক'। বলছি, এই কারণে যে, তিনি নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী বলে পরিচয় দিয়েছেন।

এ সম্পর্কিত এক লেখায় নীরদবাবু বলেছেন, '১। আমি সাম্রাজ্যবাদী, প্রথমত, মানুষ বলিয়া; কেঁচো নই বলিয়া। দেহে মানুষের মতো হইলেও অনেক মানবসন্তানই যে চরিত্রধর্মে কেঁচো হয়, তাহা সর্ববিদিত।

২। আমি সাম্রাজ্যবাদী, দ্বিতীয়ত, সভ্য মানুষ বলিয়া, অসভ্য পদদলিত, দাসজাতীয় মানুষ নই বলিয়া। বিবেকানন্দ এক শ্রেণীর ভারতীয়ের সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন যে, তাহারা 'বহু শতাব্দী যাবৎ স্বজাতি বিজাতি স্বধর্ম্মী বিধর্ম্মী পদভরে নিপীড়িত-প্রাণ, দাসসুলভ পরিশ্রম-অসহিষ্ণু, দাসবৎ উদ্যমহীন, দাসোচিত ঈর্ষাপরায়ণ, স্বজনোন্নতি-অসহিষ্ণু হতাশবৎ, শ্রদ্ধাহীন, বিশ্বাসহীন, শৃগালবৎ, নীচ-চাতুরি-প্রতারণা-সহায়, স্বার্থপরতার আধার, বলবানের পদলেহক, অপেক্ষাকৃত দুর্বলের যম-স্বরূপ, বলহীন, আশাহীন…' আমি এই জাতীয় ভারতীয় বা বাঙালি নই, সেই জন্যই সাম্রাজ্যবাদী।

৩। আমি সাম্রাজ্যবাদী, তৃতীয়ত, সত্যকার হিন্দু বলিয়া, মলিন প্যান্ট-পরিহিত আধা ট্যাসফিরিঙ্গি, অথচ গনৎকারের উপাসক হিন্দু নই বলিয়া।'

শুধু কি সাম্রাজ্যবাদী পরিচয়? নীরদবাবু সম্পর্কে একটা গল্পও প্রচলিত আছে, যার সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা দুরূহ। নীরদভক্ত ও সমালোচকদের কাছে মিথ-এ রূপ নেয়া গল্পটা এরকম। নীরদচন্দ্র তখনও কিশোরগঞ্জ ছাড়েননি। বয়স পনেরোর কাছাকাছি। ওই বয়সে মনে হয়েছিল, কিশোরগঞ্জে থাকার জন্য উনার জন্ম হয়নি। কিশোরগঞ্জ একটা মহকুমা শহর, এখানে কি থাকা যায়? এতো বড় ভারতের অনেক কিছু জানার রয়েছে। আকাঙ্ক্ষা পূরণে চলে গেলেন কলকাতায়। পার করলেন অনেকটা সময়। কলকাতাকে ভরকেন্দ্রে রেখে দিল্লি যাপনও করলেন চাকরিসূত্রে। একটা সময় মনের ভেতর দেখা দিল কৈশোরের সেই খচখচানি, কলকাতা কিংবা দিল্লিতে থাকার জন্য উনার জন্ম হয় নাই। এখনও জানার বাকি বৃহৎ বিশ্বের জ্ঞানকাণ্ডের বিশাল ভাণ্ডার। চলে গেলেন ব্রিটেন। আবাসিত হলেন অক্সফোর্ডে। সেখানকার যাপিত জীবন, জ্ঞানচর্চা, আদব কায়দা কেতা দুরস্ততা, রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হলেন। চিন্তায় ততদিনে এই বোঝাবুঝি স্পষ্ট হয়েছে যে, এখানে বাস করা যায়। আমৃত্যু থিতু হলেন সেখানেই।

নীরদবাবু কিশোরগঞ্জ ছেড়েছেন সেই ১৩ বছর বয়সে ১৯১০ সালে। যার মধ্যে দিয়ে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কে পড়েছে মস্তোবড় এক দাঁড়ি। ৭৩ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে ছেড়েছেন কলকাতা, ভারত। তারপর বেঁচেছেন আরও ৩২ বছর, মারা যান ১৯৯৯ সালে ১০২ বছর বয়সে। নীরদবাবু চিন্তায়, লেখালেখিতে, বক্তৃতায় আলাপে সালাপে ছিলেন প্রচণ্ড রকমের স্পষ্টবাদী, খাপখোলা এক তলোয়ার। সত্যতো বটেই, যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত বলে মনে করা কোনোকিছু প্রকাশে সেন্সরশিপের কোনো বালাই ছিল না। একারণে উনার কোনো কোনো লেখায় ব্যক্তি ও সমষ্টি আহত হয়েছেন। যুক্তিকে আমলে না নিয়ে, প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত না বুঝে দাঁড় করা হয়েছে বৈরী ব্যাখ্যা। কিন্তু  সত্যিই সদর্থক অর্থে যদি বিশ্লেষণ করা হয় উনার লেখালেখি ও গবেষণা, তাহলে মতদ্বৈততা হয়তো দেখা দিতে পার, কিন্তু উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এখানেই নীরদবাবুর স্বার্থকতা।

নীরদবাবু নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী বললেও, আমরা মনে করি, উনি আমাদেরই লোক। দীর্ঘ জীবনের লেখালেখিতে তিনি আমাদের জন্য এমন সত্য উন্মোচন করেছেন। আবিস্কার করেছেন অনির্ণেয় এমনসব সম্পদ যা এ জাতিকে ধন্য ও গৌরবান্বিত হওয়ার পাথেয় যুগিয়েছে। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জাতিগত ভিত্তি ও শক্তি-সাহস এবং সৌন্দর্য নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছেন, যার জন্য এ জাতি ঋণ স্বীকার ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তে বলতে বাধ্য, 'তিনি আমাদেরই লোক'।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'পরিচয়' কবিতায় লিখেছেন, 'মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/ আমি তোমাদেরই লোক,/ আর কিছু নয়,/ এই হোক শেষ পরিচয়।' নীরদবাবু নিজেকে যতই সাম্রাজ্যবাদী বলে পরিচয় দিক না কেন, উনার অন্তরাত্মায় যে রবীন্দ্রনাথের 'পরিচয়' কবিতার এই পংক্তি ক'টি অনুরণিত হতো-তা স্পষ্ট হয় 'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' প্রবন্ধ পাঠে।

'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' প্রবন্ধের বয়স প্রায় ৬০ বছর। পাঁচ পর্বে এটি কলকাতার শতবর্ষী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় যথাক্রমে ১১ভাদ্র ১৩৭৩, ২৮ আগস্ট ১৯৬৬; ১৩ ভাদ্র ১৩৭৩, ৩০ আগস্ট ১৯৬৬; ১৫ ভাদ্র ১৩৭৩, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬; ১৮ ভাদ্র ১৩৭৩, ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬; এবং ২০ ভাদ্র ১৩৭৩, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ প্রকাশিত হয়।

বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬তে, শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করার বছরে, যা বাঙালির কাছে মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

পূর্ববঙ্গের সমস্যা' দীর্ঘ একটা প্রবন্ধ, যা প্রকাশিত হয় পাঁচ পর্বে। এগুলো হলো:

এক. প্রকৃতির বিধান; দুই. জাতিত্ব, জীবনযাত্রা, ইতিহাস; তিন. ''দুই বাংলার ঐক্যসাধন আজ বাঙালির হাতে নাই-'' ক. প্রবল বিদ্রোহ, খ. দুইটি গুরুতর প্রশ্ন, গ. হিন্দু-মুসলমান বিরোধ; চার. দুই বাংলার তুলনা; পাঁচ. পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মিলন হবে কি, ক. প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্য ও উহার সম্ভাবনা।

নীরদবাবু মনে করেন, অবিভক্ত বঙ্গ, অবিভক্ত বাংলা বললে যে একত্রিত বাংলাকে বোঝানো হয় সেটা প্রাচীন কাল থেকে ব্রিটিশশাসিত বাংলার সময়কালেও পূর্ববঙ্গের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য সকল সময় ছিল। তিনি সেই স্বাতন্ত্র্যর পেছনে প্রকৃতির বিধানকেও খুঁজে ফিরেছেন। লিখেছেন, 'বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান হইতেই বাংলার রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে। সুতরাং উহার প্রভাবের কথাই সর্বাগ্রে বিবেচনা করা উচিৎ। আমি যাহাকে 'প্রাকৃতিক বাংলা' বলিয়াছি উহা ভূগোলের বাংলা, রাজনীতির নয়।' পূর্ববঙ্গের গাছপালা, নদনদী, পাহাড়, বঙ্গোপসাগরের অবস্থান, তার পূবের ও পশ্চিমের বাস্তবতা এবং উত্তর  ও দক্ষিণের প্রকৃতিপ্রদত্ত বৈশিষ্ট্যাবলীকেও তিনি আলোচনায় হাজির করেছেন  এবং সেসবের কারণে পূর্ববঙ্গের বাসিন্দাদের মানস গড়নের বিশিষ্টতাকে চিহ্নিত করেছেন।

এ খণ্ডের আলোচনার একেবারে শেষাশেষি এসে তিনি যে বয়ান হাজির করেছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। তিনি বলেছেন, ''বাংলার সমাজ ও সভ্যতা হিন্দু সভ্যতারই একটা স্থানীয় রূপ, সুতরাং আদিবাস ও আদি জীবনের সহিত যোগ রাখিতে হইলে তাহাকে আরযাবর্তেও যাইতে হইত- বিশেষ করে ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের। ইহা ছাড়া মুসলমানী আমলে যাইত বৈষয়িক উন্নতির আশায়। কিন্তু দিল্লিতে 'রাজাই করিতে গিয়া' অনেককে খিলাপও করিতে হইত 'দুধে-ভাতে ভাল ছিল, হেন বুদ্ধি কে বা দিল … ইত্যাদি।''

নীরদচন্দ্র যে বলেছেন, 'বাংলার সমাজ ও সভ্যতা হিন্দু সভ্যতারই একটা স্থানীয় রূপ', সেটা সর্বাংশে সত্য নয় এবং বিষয়টা এতোটা সরলরৈখিক ও নয়। ইতিহাসের সত্যও উনার এই দাবিকে সমর্থন করে না। বাংলার সমাজ ও সভ্যতা কোনো একক সভ্যতার স্থানীয় রূপ নয়। বরং একাধিক সভ্যতা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে বাংলা তার নিজস্ব সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখানেই বঙ্গের অন্যান্য জনপদ থেকে পূর্ববঙ্গ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিশেষ এক জনপদ।

প্রবেন্ধর দ্বিতীয় খণ্ডের শিরোনাম 'জাতিত্ব, জীবনযাত্রা, ইতিহাস'। নীরদবাবু এখানে পূর্ববঙ্গের মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ধরার চেষ্টা করেছেন, যার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছে তার জীবনযাত্রা ও ইতিহাসের সম্যক পরিচয়। তিনি মনে করেন ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে ভারতের বাইরে থেকে যে অভিগমন ঘটেছে সেখানে অনেকখানি পৃথক বাস্তবতা রয়েছে পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে। উত্তরাপথ দিয়ে অভিগমন যেমন ঘটেছে, পাশাপাশি পূর্ববঙ্গে পূর্ব থেকেও অভিবাসীরা এসেছে। ফলে, এই জনপদ ভারতবর্ষের অন্যান্য জনপদের মতো নয়। চেহারাতেও সেই ছাপ প্রবলভাবে রয়ে গেছে। এমনকি পূর্ববঙ্গের মানুষের ঘর গেরস্থালিও উত্তরাপথ থেকে আলাদা। তিনি লিখেছেন, 'যদি কেহ পশ্চিম এশিয়ার পুরাতত্ত্ব পড়িয়া থাকেন, তিনি স্বীকার করবেন এই সব জিনিস সেই অঞ্চলের নূতন প্রস্তরযুগ বা প্রথম তাম্রযুগের দান। এগুলির উৎপত্তি কৃষির উৎপত্তির সঙ্গে হইয়াছিল।

প্যালেস্টাইন, মেসোপটেমিয়া বা পারস্যে যে-সব প্রাচীন গ্রামের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়াছে, সেগুলি ঠিক হিন্দুস্থান ও পাঞ্জাবের গ্রামের মতো। পূর্ববঙ্গের গ্রামের গড়নে ও চেহারায় অন্যরকম অন্যরকম বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে ধরা দেয়। উহাতে বাড়ি ও বাস্তভিটা ছাড়াছাড়া, প্রতিটি বাড়ি দরমার বেড়া বা টাট্টি দিয়ে ঘেরা। কিশোরগঞ্জ শহরে ও পৈতৃক গ্রাম বনগ্রামে আমাদের বাড়িও ঠিক এই ধরনের ছিল। এই সব বাড়ির চারিদিকে বাঁশের ঝাড় থাকিত। দূর হইতে গ্রামগুলিকে জঙ্গল বলিয়াই মনে হইত, গ্রাম বর্ধিষ্ণু ও ভদ্রগৃহস্থবহুল না হইলে গাছপালার ভিতর দিয়া চাল বা ছাত দেখাই যাইত না। এই সব বাড়ি ও গ্রাম আসিয়াছিল বিষুবরেখায় নিকটবর্তী বৃষ্টিবহুল অঞ্চল, অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হইতে।'

নীরদবাবু বিশদ যুক্তি হাজির করেছেন তার এই সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণের পক্ষে। ঘরবাড়ি, সমাজের গড়নের মতো তার দেহের গড়নেও রয়েছে পার্থক্য। তিনি মনে করেন, 'এই পার্থক্য বাংলার ইতিহাসের প্রারম্ভ হইতে চলিয়া আসিয়াছে। উহার ব্যতিক্রম কখনও হয় নাই, ভবিষ্যতেও হইবে না'। এখানে এসে নীরদবাবু ইতিহাসের এমন এক সত্যকে আবিস্কার করেছেন, যা পূর্ববঙ্গবাসী যে কোনো বাঙালির জন্যই শ্লাঘার। গভীর এষণার আলোকে এই অন্বেষণ বাঙালিকে মাথা তুলে দাঁড়াবার লক্ষ্যে অতীতের আলোয় ভবিষ্যতকে নির্মাণের দিশা যোগায়। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের নানাদিকে স্পষ্ট ও উগ্র স্বাতন্ত্র্য রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে আত্মপ্রকাশ করিবে না, ইহা মনে করাই অসঙ্গত। প্রকৃতপক্ষে সত্যকার বাঙালিত্ব প্রকট হইবার বহু আগেই রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য দেখা দিয়াছিল। যেদিন মাৎস্যন্যায় হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য বাংলার লোক গোপালকে সিংহাসনে বসাইয়াছিল, সেই দিন হইতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের আরম্ভ। তখনও বাংলা ভাষা জন্মায় নাই, বাংলার বিশিষ্ট সংস্কৃতিও বিকশিত হয় নাই। তবু উত্তরাপথের সহিত যুক্ত থাকিতে পারে নাই।'

এক্ষণে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। যে প্রসঙ্গ হাজির করেছেন নীরদবাবুও। ভারতের একদা নাম ছিল আরযাবর্ত। অর্থাৎ আর্যদের আবাস বা বাসস্থান। কিন্তু পূর্ববঙ্গ কখনোই পুরোপুরি আরযদের আবাসস্থান হয়ে ওঠে নাই। তিনি মনে করেন, 'উত্তরাপথের সমাজ ছিল মোটের উপর বিশুদ্ধ আর্য। কিন্তু বাংলার সমাজ তিন স্তরের- বিশুদ্ধ আরয, বর্ণসঙ্কর ও বিশুদ্ধ অনার্য।' আর্যাবর্ত এক সময় হয়ে ওঠে হিন্দুস্থান, সেটা তো মুসলমানদের কারণে। যে জনপদে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বসবাস, সেটা তো পূর্ববঙ্গই। আরবে যখন ইসলামের আবির্ভাব ও বিকাশ হচ্ছে ঠিক তখনই ভারতবর্ষে ইসলামেরও যাত্রা ঘটে।

যে জনপদে ইসলাম আরবের মতোই একইসঙ্গে বিকশিত হতে থাকে সেটা পূর্ববঙ্গ। এবং তা সম্ভব হয়েছে কেবল পূর্ববঙ্গের স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যের কারণেই। নীরদ বাবু অবশ্য এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে না বললেও আরব বণিকদের সূত্রে ইসলামের যাত্রা শুরুর ইতিহাসকে মান্যতা দিয়েছেন। আমরা মনে করি, পূর্ববঙ্গের স্বাতন্ত্র্যতার পেছনে এসব বিষয়ও আরও বেশি করে তালাশ করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রকূট রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকেই এখানে একাধিক মসজিদ নির্মিত হয়েছে বলে সাধনকমল চৌধুরী 'বাংলায় বৌদ্ধধর্ম ও বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ক্রমবিবর্তন' বইয়ে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের লালমনিরহাটে হিজরী ৬৯ সাল মোতাবেক সালে ৬৪৮ সালের মসজিদ আবিস্কৃত হয়েছে। বাংলায় রাষ্ট্রের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, এরকম গড়পড়তা একটা কথা এখানে প্রতিষ্ঠিত। ব্রজদুলাল চট্রোপাধ্যায় এসম্পর্কিত গবেষণায় ষ্পষ্ট করে বলেছেন, 'বাংলায় সংহত রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল।'

নীরদচন্দ্রও এই প্রবন্ধে মুসলমান শাসনের প্রসঙ্গ টেনে আগ্রহোদ্দীপক এক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। এবং তার মধ্যেও পূর্ববঙ্গের স্বাতন্ত্রিক সত্ত্বার দীর্ঘ এক ইতিহাস আবিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, 'এই স্বাতন্ত্র্যের ইতিহাসের একটা মোটা হিসাব লওয়া যাক। ১২০৬ সালে ভারতবর্ষে স্বাধীন মুসলমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন হইতে ১৯৪৭ সন পরযন্ত ৭৪১ বৎসর। ইহার মধ্যে বাঙালি স্বাধীন বা কারযত স্বতন্ত্র ছিল ৪২৬ বৎসর, আর ৩১৫ বৎসর ছিল উত্তর ভারতের সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধীন, তা সে দিল্লিতেই হউক বা আগ্রাতেই হউক। রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে অপ্রতিহত ও অনিবর্তিত না হইলে কেহই বাংলাদেশকে উত্তরাপথের সহিত যুক্ত রাখিতে পারে নাই। এই অত্যন্ত স্থুল ব্যাপারটা কাহারও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। ইতিহাসের সাক্ষ্য জ্বাজল্যমান।' 

'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' প্রবন্ধের তিন নাম্বার খণ্ডের বিষয়, 'দুই বাংলার ঐক্যসাধন আজ বাঙালির হাতে নেই', এর আবার রয়েছে তিনটি অংশ- প্রবল বিদ্রোহ, দুইটি গুরুতর প্রশ্ন ও হিন্দু-মুসলমান বিরোধ।

প্রবন্ধটি ১৯৬৬ সালে লিখিত। তখন ভারত বিভক্তি ও দেশভাগের বয়স দুই দশকও হয়নি। ফলে, প্রকাশ্যে না হলেও এক ধরনের গুঞ্জরণ নিভৃতে কিংবা কিছু মানুষের মধ্যে ছিল যে, পাল্টে যেতে পারে ৪৭ এর প্রেক্ষাপট। কিন্তু পূর্ববঙ্গের বাস্তবতায় সেটা অনুচ্চারিত রয়ে গেছে। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙালির টানাপোড়েন নানান ঘটনায় উচ্চকিত হয়ে স্বাধীকার আন্দোলনের দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। এবং বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ততদিনে ছয় দফা দাবির পক্ষেও সরব হয়ে উঠেছেন। ছয় দফা দাবি জানানো হয় ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬। 'পূবর্বঙ্গের সমস্যা' প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে একই বছরের আগস্টের শেষে ও সেপ্টেম্বরের প্রারম্ভে। ইতোমধ্যে এই প্রবন্ধের বয়স ৬০ ছুঁইছুঁই।

এইসময়ে অনেক প্রশ্নের ফায়সালা হয়েছে বিশেষ করে প্রবন্ধটির তৃতীয় খণ্ডের আলোচ্য বিষয়। এর বাইরে এখানে যে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হলে বুঝতে সুবিধা হবে নীরদ বাবুর পূর্ববঙ্গের সমস্যা বিচারের পদ্ধতি ও এষণার সিদ্ধান্তসমূহ, সেসবে আলোকপাত করা যেতে পারে। তিনি বলেন, 'বিংশ শতাব্দীতে তিনবার বাংলার রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন হইয়াছে, অর্থাৎ ইহার ফলে আমার জীবনে আজ পর্যন্ত আমি চারিটি বাংলা দেখিয়াছি, হয়তো কিছুদিন বাঁচিয়া থাকিলে আরও দেখিতে পারি।' একটা প্রবন্ধের শক্তি কোথায় নিহিত এবং প্রবন্ধ কীভাবে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও তার আত্ম অন্বেষায় কামিয়াবি করে তুলতে পারে নীরদ বাবু আলোচ্য প্রবন্ধে তার প্রমাণ রেখেছেন। বাস্তবিকই এই প্রবন্ধ প্রকাশের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় আরও একটি বাংলা দেখার সুযোগ তিনি পান। পূর্ববঙ্গ এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভূত হয়।

চতুর্থ খণ্ডের বিষয় দুই বাংলার তুলনা। দুই বাংলা অর্থাৎ পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা, যার সেই সময়ের সাংবিধানিক নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ।  পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ব বাংলা হয়ে এখন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ বর্তমানে স্বাধীন সার্বভৌম এক রাষ্ট্র। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি রাজ্য। নীরদবাবু যখন এই প্রবন্ধ লেখেন তখন দুই বাংলায় অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান একটা প্রদেশ বা রাজ্য হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভারতের অনেকগুলো রাজ্যের মধ্যে একটি। তুলনাটা হয়েছিল সেই বিবেচনায়। ফলে, এই খণ্ডের আলোচনা বর্তমানের সময়ে দাঁড়িয়ে যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা, সেসব আলোচনার অনেককিছুই এখন বাস্তবে পরিগণিত হয়েছে এবং কতিপয় বিষয় হাজির হয়েছে মীমাংসিত এক সত্যরূপে।

কিছু কিছু বিষয় অবশ্য অতীতের আলোয় বর্তমানকে নির্মাণের প্রশ্নে পাঠ করা যেতেই পারে। নীরদবাবু যেমনটা বলেছেন, 'পশ্চিম পাকিস্তান ইসলামী পশ্চিম এশিয়ার পূর্বতন অংশ মাত্র। সুতরাং, পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান, আরব অথবা পারসীকের চেয়ে কম বিদেশী নয়। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের সহিত উত্তরাপথের পার্থক্য বিহার হইতে পাঞ্জাব পরযন্ত সমান নয়, ক্রম প্রকাশমান। অর্থাৎ পূর্বে অল্প পার্থক্য, ক্রমে ক্রমে বাড়িতে বাড়িতে পশ্চিমে গিয়া অতি স্পষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পার্থক্যটা এইভাবে ক্রমিক হওয়াতে অনুভূত হইবামাত্র ধাক্কার মতো লাগে না। পূর্ববঙ্গের ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের মধ্যে এই ধরনের 'শক্-অ্যাব্সবার' বা বাফার নাই। এই দুইয়ের বৈষম্য মোটেই ক্রমবর্ধমান নয়, প্রথমেই একেবারে গুরুতর ধাক্কা, অর্থাৎ মোটরের বা ট্রেনের 'কলিশ্যনে'র মতো লাগে। উহা একেবারে প্রথম হইতেই সংঘর্ষ হইয়া দাঁড়ায়।'

পূর্ববঙ্গের সমস্যা প্রবন্ধের খণ্ড পাঁচে-র বিষয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মিল হবে কি এবং প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্য ও উহার সম্ভাবনা। এটিও চার নাম্বার খণ্ডের মতো একেবারে ওই সময়ের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে উত্থাপিত প্রশ্নবিশেষ। সময় নিরপেক্ষ কোনো বিষয় না হওয়ায় তার ফায়সালাও কাছাকাছি সময়েই হয়ে গেছে।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী সোয়াশত বর্ষ পূর্ণ হবে এ বছর, জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৭ সনের ২৩ নভেম্বর। বাঙালি মনীষায় তিনি শ্রদ্ধা জাগানিয়া এক প্রতিভা। উনার পূর্ববঙ্গের সমস্যা বিচার নানানকারণেই বাংলাদেশের জন্য ফিরে দেখা জরুরি। বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষায় এই প্রবন্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। উনার বয়ান-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

নীরদবাবুর ইতিহাস নির্মাণ ও গতি সঞ্চরণের শক্তি দিশা দেয় বাংলাদেশকে তার সত্তার অন্বেষায়। যেমনটা বলেছেন তিনি, ''হিন্দুস্থান ও পাঞ্জাবের সঙ্গে তুলনা করিলে দেখা যাইবে যে, সে দেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে বাংলাদেশের, বিশেষত পূর্ববঙ্গের জীবনযাত্রার মূলগত প্রভেদ আছে। সে-প্রভেদ এত বড় ও এত প্রাচীন যে, দুই পক্ষের মিলন বা সমন্বয়ের কোনও প্রশ্নই উঠিতে পারে না। প্রকৃতি ব্যঙ্গ করিয়া বলিবে, 'পৃথক করেছি যারে আমার বলে, তোমরা ফিরাবে তারে কিসের ছলে?''

তার মানে স্বাধীন বাংলাদেশ তার প্রকৃতির চাওয়া। বাংলার জল হাওয়া কারও অধীনতা মানে না, মানুষও মানবে না, এটাই স্বাভাবিক-সংগত ও প্রকৃতিরও সত্য। যে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭১ সালে। আমাদের স্বাধীনতার অনবারয বাস্তবতা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জনেরও পাঁচ বছর আগে এরকম সুলুকসন্ধানী কথা নীরদচন্দ্র চৌধুরী ছাড়া আর কেউ উচ্চারণ করেছেন কী? নিশ্চয় না।

'পরিচয়' কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে,/ বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে।/ তোমরা শুধায়েছিল মোরে ডাকি/ পরিচয় কোনো আছে নাকি,/ যাবে কোন্খানে।/ আমি শুধু বলেছি, কে জানে।/ নদীতে লাগিল দোলা, বাঁধনে পড়িল টান,/ একা বসে গাহিলাম যৌবনের গান।/ সেই গান শুনি/ কুসুমিত তরুতলে তরুণতরুণী/ তুলিল অশোক,/ মোর হাতে দিয়ে তারা কহিল, ''এ আমাদেরই লোক।'' আর কিছু নয়,/ সে মোর প্রথম পরিচয়।'

নীরদচন্দ্র চৌধুরী জন্মেছিলেন পূর্ববঙ্গেই, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে ১৮৯৭ সালের ২৩ নভেম্বর। এ বছর উনার জন্মের সোয়াশত বছর পূর্ণ হচ্ছে। সেই উপলক্ষে আমরা রবীবাবুর 'পরিচয়' কবিতার সেই অশোক ফুলের ডালি নিবেদন করে বলি, নীরদবাবু, আপনি আমাদেরই লোক। আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ারও সাত বছর আগে লিখেছেন, অমোঘ এই সত্য যে, বাঙালি স্বতন্ত্র এক জাতি এই উপমহাদেশে। এবং তার অতীত ইতিহাস বলছে সে সবসময় স্বতন্ত্র থেকেছে এবং স্বাধীন থেকেছে। আপনি উন্মোচন করেছেন অজানা এই সত্য যে, বাঙালি-পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালি জাতিগতভাবে, ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত দিক থেকে, প্রকৃতিসূত্রে, নৃতাত্ত্বিকতায়, সমাজের গড়নে, পৃথক ও স্বতন্ত্র এক জাতি। হাজার হাজার বছর ধরে বাঙালি ভারতবর্ষে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবেই ছিল। যা প্রমাণিত হয়েছে ১৯৭১ এ। এই সত্যের উন্মোচক যিনি, প্রকৃতার্থেই 'তিনি আমাদেরই লোক।'

Comments