সাক্ষাৎকার

আমরা বিদেশে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা করি

বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বিশেষত রাজধানী ঢাকাকে তুলে ধরার লক্ষ্যে ঢাকা লিট ফেস্টের যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে। নতুন বছরের ৫ থেকে ৮ জানুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বসবে এর দশম আসর। এ দফায় ঢাকা লিট ফেস্টের আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকার শীর্ষে আছে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক ওরহান পামুক। এ ছাড়া আবদুলরাজাক গুরনাহসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তারা এতে অংশ নেবেন। ৪ দিনব্যাপী এ আয়োজনে কবিতা, কথাসাহিত্য থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ইতিহাস, সমাজ ও রাজনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শনের আলোচনা ছাড়াও থাকবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, শিল্প প্রদর্শনী, সংগীত ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বিশেষত রাজধানী ঢাকাকে তুলে ধরার লক্ষ্যে ঢাকা লিট ফেস্টের যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে। নতুন বছরের ৫ থেকে ৮ জানুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বসবে এর দশম আসর। এ দফায় ঢাকা লিট ফেস্টের আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকার শীর্ষে আছে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক ওরহান পামুক। এ ছাড়া আবদুলরাজাক গুরনাহসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তারা এতে অংশ নেবেন। ৪ দিনব্যাপী এ আয়োজনে কবিতা, কথাসাহিত্য থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ইতিহাস, সমাজ ও রাজনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শনের আলোচনা ছাড়াও থাকবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, শিল্প প্রদর্শনী, সংগীত ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

গত কয়েক বছরে ঢাকা লিট ফেস্ট বাংলাদেশের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক মহলে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। এমন একটি আয়োজনের ১০ বছরের প্রাপ্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা লিট ফেস্টের ৩ পরিচালক সাদাফ সায, আহসান আকবার ও আনিস আহমেদ।

গত ১১ ডিসেম্বর ভিডিও কনফারেন্স সফটওয়্যার জুম-এ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইমরান মাহফুজ। অনুলিখন করেছেন মোহাম্মদ আবু সাঈদ

দেশে ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজনের ফলে গত ১০ বছরে বহির্বিশ্ব আমাদের সাহিত্য নিয়ে কতটা আগ্রহী হয়েছে? তারা কী বাংলাদেশের কোনো কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকের কোনো রচনা অনুবাদ করেছেন? আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলা সাহিত্য নিয়ে লিখেছেন?

আহসান আকবার: অবশ্যই তারা খুবই আগ্রহী জানতে ও বুঝতে। ফেস্টিভ্যালে আসার আগেই তারা জানতে চায় কার কার লেখা পড়া উচিত? কারণ একটি শহরকে সবচেয়ে ভালোভাবে জানা যায় একজন লেখকের লেখার মাধ্যমে। এই আগ্রহটা তাদের সবসময় থাকে। কিন্তু আমাদের প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, আমাদের বেশিরভাগ লেখার‌ই ভালো ইংরেজি অনুবাদ নেই। যেসব ভালো লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, সেগুলো কিন্তু আমরা অতিথিদের পৌঁছে দেই। দ্বিতীয়ত আমন্ত্রিত প্রত্যেকেই কিন্তু যাওয়ার সময় অনেক ব‌ই সংগ্রহ করে নিয়ে যান।

এমন‌ও হয়েছে, এতো বেশি ব‌ই হয়ে গেছে যে, লাগেজ বহন করা কষ্টকর হয়ে গেছে। তখন আমরা তাদের বইগুলো কুরিয়ার করে দিয়েছি। তৃতীয়ত, একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য পত্রিকায় ২০১৫ সালের একটা সংখ্যায় বাংলাদেশের লেখা ও লেখক সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়। সেখানে আমরা কাজ করেছি। একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশের ১৫ জন লেখকের লেখা অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যাপারে। সেখান থেকে নির্বাচন করে তারা কয়েকজনের লেখা নিয়ে কাজ করেছে।

বাংলাদেশের লেখকদের বহির্বিশ্বে কীভাবে তুলে ধরা যায় আমরা সে ব্যাপারে সবসময় চেষ্টা করি। চতুর্থত, লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ নামে যে সিরিজটা আমরা করেছিলাম, সেখানে কিন্তু বাংলাদেশের অনেক ক্ল্যাসিক লেখার অনুবাদ হয়েছে। শিকাগো প্রেসের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি যে, কীভাবে বহির্বিশ্বে এই অনুবাদগুলোর আরও প্রচার করা যায়। মূল কথা হলো, আমাদের লেখার মান আরও বাড়াতে হবে। এদিক থেকে কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান অনেক এগিয়ে আছে। আমাদের লেখার মানের দিকে আরও মনোযোগী হতে হবে।

বিদেশি অতিথি নির্বাচনে বা আমন্ত্রণে আপনারা কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন— ব্যক্তির জনপ্রিয়তা না লেখালেখি? তাদের অংশগ্রহণে দেশের পাঠকরা কীভাবে উপকৃত হন?

সাদাফ সায: গুরুত্বটা আসলে সবকিছুর মিশেলে হয়। যেমন- আইকনিক ফিগার, ছোটবেলা থেকেই যার লেখা পড়ে আসছি, যাদের নাম আমরা সবাই জানি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পুরস্কার পেয়েছেন- এরকম। আরেকটা দিক হলো, যারা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন বা করছেন তাদের আমরা গুরুত্ব দেই। যেমন- এবার আমরা সারা গিলবার্টকে নিয়ে আসছি, যিনি অক্সফোর্ডে করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারক টিমের প্রধান ছিলেন। উনি ওনার গল্পটা বলবেন।

অর্থাৎ এমন একজন যিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, যার কাজ আমাদের জীবনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছে। আবার এমন অনেক অতিথি থাকেন যারা তেমন পরিচিত নন আমাদের কাছে। দর্শকরা তাদের বক্তব্য শোনেন, তাদের বক্তব্য থেকে অনুপ্রাণিত এবং পরিচিত হওয়ার পর তাদের সব ব‌ই পড়া শুরু করেন।

আনিস আহমেদ: আমাদের আগ্রহের প্রথম এবং প্রধান জায়গা হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের প্রায় সকল অঙ্গনের যোগসূত্র আছে। আমরা দেখি, সাহিত্যের জায়গা থেকে কারা আইকনিক, বর্তমানে কারা ইন্টারেস্টিং কাজ করছেন, যাদের সঙ্গে পরিচিত হলে আমাদের পাঠকরা লাভবান হবেন। হয়তো তাদের এখনো আমরা অতোটা জানি না, পড়িনি। কিন্তু সুযোগ পেলে তাদের বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হবে। এমন চিন্তা থেকেই লেখক নির্বাচন করি। সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, পপকালচার, নিউ মিডিয়া- এসব বিষয়ও আমরা চিন্তা করি।

যেমন- এবার ওটিটি নিয়ে আমাদের একটি প্যানেল থাকছে। এর আগে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুক সাহিত্য) নিয়ে কাজ করেছি। যখন যা কিছু নতুন আসছে, এসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে তাকে আরও গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে বিবেচনা করা, বুঝতে চেষ্টা করার কাজটা আমরা করি। পাঠকের আগ্রহ‌ও থাকে লক্ষ্য করার মতো। সেখানে আবার অধিকারের ইস্যু আসে। সেটা লিঙ্গ অধিকার হতে পারে, রাজনৈতিক অধিকার হতে পারে, ব্যক্তি স্বাধীনতা তো আছেই। আমরা কিন্তু সকল ইস্যু মাথায় রেখে সবধরনের চিন্তা থেকেই অনুষ্ঠানটা সাজাই।

কোন বিষয়ে বিদেশ থেকে কারা প্রাসঙ্গিক, আবার বাংলাদেশে কারা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবেন সেটাও বিবেচনা করা হয়। প্রসঙ্গত বলি, যিনি পশ্চিম থেকে আসছেন তার কিন্তু পশ্চিমা চিন্তায় একটা সীমাবদ্ধতা থেকে যায়, গ্লোবাল চিন্তার প্রসঙ্গে একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু যখন তিনি এতদূর থেকে ঢাকায় আসছেন, তখনই কিন্তু তার চিন্তায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তারপর যখন বাঙালি, এশিয়ান বা অপরিচিত পশ্চিমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন, জানেন, বোঝেন তখন কিন্তু তিনি ভাবতে থাকেন যে, তার ধারণার বাইরেও একটা জগত আছে, তাদের নিয়েও কথা বলতে হবে।

ফলে যারাই এখানে আসেন তারা কিন্তু এভাবে শেখেন, অনুপ্রাণিত হন। অনেকে আমাদের ফিডব্যাক দিয়েছেন। আমরা যেমন তাদের পেয়ে আনন্দিত হ‌ই, শিখি, জানি, ঠিক তেমনি তাদের‌ও নতুন অভিজ্ঞতা হয়, নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখেন।

আহসান আকবার: আমরা চেষ্টা করি দেশের বাইরে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে। আমাদের একটা নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বাংলাদেশ খুব নেগেটিভ প্রেস পায়, খালি খারাপটা উঠে আসে, ভালোটা উঠে আসে না তেমন। আমরা দেখি কারা কোন পজিশনে আছেন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে। তাদের সঙ্গে আমরা সারাবছর যুক্ত থাকি, তাদেরকে বলি যে, দেখো, বাংলাদেশে কিন্তু এইরকম কাজ হচ্ছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, অনেক পুরোনো লেখকদের নতুন ব‌ই বের হয়। যেমন- পঙ্কজ মিসরা, ২৫ বছর পর তার ব‌ই বের হচ্ছে এবার। আমরা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তিনি আগে এসেছিলেন নন ফিকশন লেখক হিসেবে; এবার আসছেন ফিকশন লেখক হিসেবে।

আপনারা বাক স্বাধীনতা নিয়ে আলাপ করেছেন গতবার। এমন মৌলিক বা স্পর্শকাতর বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনায় রাষ্ট্রের যেসব প্রতিনিধি আপনাদের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদের কোনো দিকনির্দেশনা থাকে?

আনিস আহমেদ: অবশ্যই না। আজ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় বা রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা কোনো ব্যক্তি কর্তৃক এমন কোনো আদেশ, উপদেশ পাইনি যে- এটা বলা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এটা বলতে হবে ইত্যাদি। ভবিষ্যতে পেলেও আমরা তা গ্রহণ করবো না। আমরা আমাদের এডিটোরিয়াল প্যানেলের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।

ভবিষ্যতে যদি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেতে হলে এরকম কোনো শর্ত থাকে তাহলে আমরা সহযোগিতা না নিয়ে সীমিত পরিসরেই, ব্যক্তিগত আয়োজন করবো। প্রসঙ্গত বলি, ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর অনেক বড় আঘাত এসেছিল ১৪-১৫ সালের দিকে, যখন লেখকরা আক্রান্ত হচ্ছিলেন। ১৫ সালে শেষ ৩০ দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ১৯ জন লেখক আমাদের অনুষ্ঠান থেকে নাম প্রত্যাহার করেছিলেন। তখন আমরা বলেছিলাম যে, আমরা নিরাপত্তা দিতে পারলেও এইরকম পরিবেশে তোমরা কমফোর্ট ফিল না করলে এটা তোমাদের সিদ্ধান্ত, আমরা কিছু মনে করব না।

শুনেছি লিট ফেস্টে আপনারা প্রবেশ মূল্য রাখবেন এবার। এটা কতটা কার্যকরী হবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়?

আনিস আহমেদ: এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় একটা মূল্য থাকা চাই। আন্তর্জাতিক যেকোনো লেখককে সাধারণত বিনামূল্যে দেখা যায় না। আর যিনি আমাদের অনুষ্ঠানকে গুরুত্ব দিবেন, তিনি ফি মেনেই আসবেন। তাছাড়া সব কিছুর খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কিছু বিবেচনায় প্রবেশ মূল্য রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু কত রাখবো তা এখনো নির্ধারণ হয়নি।

Comments