নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদের স্বদেশ-সন্দর্শন

মমতাজউদদীন আহমদের পরিচয় বহুমাত্রিক। ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচার সরকারবিরোধী সংগ্রামে সতত ভূমিকা রাখা মমতাজউদদীন আহমদ পেশায় ছিলেন অধ্যাপক, নাট্যকার ও অভিনেতা। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকায় চুয়ান্ন থেকে আটান্নতে অন্তত চারবার কারাবরণ করতে হয়েছিলো তাকে। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন প্রচণ্ড আবেগী ও সংবেদনশীল। যে-কারণে তার সৃষ্টিকর্ম স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং শোষণহীন সুখি ও সমৃদ্ধ স্বদেশ-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুগ্রথিত। তার অভিনয় কুশলতা ও সংলাপ পরিবেশনের ধরনটিও ছিলো স্বতন্ত্র। চরম দুঃখবোধ আর অস্বস্তি থেকে তিনি যে মুক্তি পাননি, অনন্ত দুঃখের পর আগত শান্তি যে সামান্য ও ক্ষণিক, তার চোখে-মুখে-কণ্ঠে থাকতো তারই রেশ-শ্লেষ-ক্লেশ।

মমতাজউদদীন আহমদের পরিচয় বহুমাত্রিক। ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচার সরকারবিরোধী সংগ্রামে সতত ভূমিকা রাখা মমতাজউদদীন আহমদ পেশায় ছিলেন অধ্যাপক, নাট্যকার ও অভিনেতা। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকায় চুয়ান্ন থেকে আটান্নতে অন্তত চারবার কারাবরণ করতে হয়েছিলো তাকে। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন প্রচণ্ড আবেগী ও সংবেদনশীল। যে-কারণে তার সৃষ্টিকর্ম স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং শোষণহীন সুখি ও সমৃদ্ধ স্বদেশ-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুগ্রথিত। তার অভিনয় কুশলতা ও সংলাপ পরিবেশনের ধরনটিও ছিলো স্বতন্ত্র। চরম দুঃখবোধ আর অস্বস্তি থেকে তিনি যে মুক্তি পাননি, অনন্ত দুঃখের পর আগত শান্তি যে সামান্য ও ক্ষণিক, তার চোখে-মুখে-কণ্ঠে থাকতো তারই রেশ-শ্লেষ-ক্লেশ।

বাঁচার জন্য জীবন বোনা শিল্পী মমতাজউদদীন আহমদ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে রচিত তার মৌলিক মঞ্চনাটকগুলো হলো বিবাহ, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, বর্ণচোরা, এই সেই কণ্ঠস্বর, কী চাহ শঙ্খচিল ও সাতঘাটের কানাকড়ি । রাজা অনুস্বরের পালা তার একমাত্র লোকনাট্য। তার নাটকগুলোয় স্পষ্টত লক্ষণীয়: ক. ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। খ. প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিবোধ এবং হারানোর বেদনা। গ. বিদীর্ণ বাস্তবতা, বিবেকের দংশন ও অসীম সাহস। ঘ. আর্থরাজনৈতিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও শপথ। ঙ. সংঘবদ্ধ গার্হস্থ্যজীবন ও সমাজসচেতনতা। এবং চ. সংবেদনশীল নাট্যকারের আবেগী উপস্থাপন।

মমতাজউদদীন আহমদের প্রথম নাটক বিবাহ ভাষা-আন্দোলনকে উপজীব্য করে রচিত। আর, শেষ নাটক সাতঘাটের কানাকড়ি রচিত হয়েছে একনায়ক স্বৈরসরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। মধ্যবর্তী নাটকগুলোর নামকরণ শুনেই বোধগম্য হয় নাটকের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য-কথা কী হতে পারে। বাংলা ভাষা না থাকলে স্বাধীনতার অর্থ কী, এ কেমন স্বাধীনতা, কেমন স্বদেশ? পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিবাহের পূর্বমুহূর্তে জামাই হারানো সখিনার বাবার এই প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চারিত হয়েছে ভিন্নভাবে। তার কী চাহ শঙ্খচিল নাটকে বীরাঙ্গনা রৌশনারাকে বলতে শুনি, কী পেয়েছি আমি? স্বাধীনতা? কার স্বাধীনতা? কেমন স্বাধীনতা? মায়ের কোলে বাচ্চা নাই, মানুষের চোখে নিদ নাই, নদীর বুকে পানি নাই। এ কেমন স্বাধীনতা? আর, সাতঘাটের কানাকড়ি নাটকে তারুণ্যদীপ্ত যুবকদের কণ্ঠে যুক্ত হয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্রে আরও কিছু মৌলিক প্রশ্ন, মুনীর চৌধুরীকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হলো না কেন? কিংবা, জহির রায়হানের হত্যার তদন্ত হলো না কেন? অথবা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা ঘুরে বেড়ায় কেন? নাট্যকারের এসব প্রশ্ন থেকে তার সমকালীন স্বদেশ-দর্শনের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে দাসু-বাসু-নালু-হাসু-কালু-মানু-জয়দের অসহায় মায়ের সংলাপে :

তাহলে আমার ছেলেরা যুদ্ধ করল কেন? তাহলে আমার স্বামী জীবন দিল কেন? তাহলে আমি ইজ্জত লুটিয়ে ঘরে ফিরলাম কেন? কেনরে দাসু? আমি কী তোদের মা, নাকি আমি একটা বাজারের মেয়েরে দাসু? আমাকে লয়ে একি তামাশা?

এই মা নিঃসন্দেহে স্বদেশমাতা। ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশ। মমতাজউদদীনের নাটক কিংবা তাঁর নাটকের সংলাপ ও কথাগুলোকে বিবেচনায় রেখেই যদি এই চেতনার চিত্র আঁকি সেখানে থাকবে শোষণ ও বঞ্চনাহীন এবং স্বৈরশাসন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা আর ধর্মান্ধতাবিরোধী মুক্তিকামী ও মেধাবী মানুষের ন্যায়সঙ্গত বিজয়ের স্বপ্ন। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে কী হলো, কী পেলাম, কী দেখলাম, কী দেখছি, কী হয়েছে, কী হচ্ছে, কী হয়! নাট্যকারের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর ক্ষোভ, যন্ত্রণা, অসহায়ত্ব, ক্রন্দন আর শপথ পাঠক ও দর্শককে আঘাত করে এবং ভাবায়।

মমতাজউদদীনের সর্বাধিক মঞ্চস্থ ও আলোচিত নাটক সাতঘাটের কানাকড়ি। অগণতান্ত্রিক একনায়ক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সমকালীন রাষ্ট্রীয় সংকট ও আগ্রাসনের মুখোশ উন্মোচন এবং একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আপোষহীন শপথ পাঠ ও নতুন যুদ্ধের আহ্বানের এক দুঃসাহসিক নাট্যরূপ এটি। যেখানে দাসুর কণ্ঠে নাট্যকার উচ্চারণ করেন :

অনিয়মের পাহাড় জমে উঠেছে, যার যা খুশি তাই হয়েছে। একটা সামাজিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এভাবে দেশ চলবে না, এভাবে একটি জাতি বেঁচে থাকবে না, এভাবে আমাদের স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

প্রতীকী-অর্থে এ নাটকে অদৃশ্য আলীজাঁ হচ্ছে পরাক্রমশালী একনায়ক স্বৈরশাসক। মা হলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। দাসু-বাসু-নালু-হাসু-কালু-মানু ও জয় হলো অনিবার্য অপমৃত্যুতে ধাবিত নিরুপায় জনগণ। আমানুল্লাহ হলো রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী ধুরন্ধর ব্যক্তি। ভেঁপুচান্দ হলো নীতি-নৈতিকতা ও জ্ঞানবর্জিত মতলববাজ শিক্ষাবিদ। পীর হলো ভণ্ড ও প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী। চাকতি ও খাণ্ডা হলো উচ্চাভিলাষী অসাধু আমলা। চানাবি ও আঁখি হলো উচ্চাভিলাষী সুযোগসন্ধানী অমানুষ। আর পুলিশ হলো হুকুমের দাস বা গোলাম। একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা চরিত্র এরা। এখান থেকেই উপলব্ধি করা যায় রাষ্ট্রের সংকট ও মানুষের জীবনধারা।

ক্রম-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান মমতাজউদদীন আহমদ নাটকটির নামকরণ করেছেন সাতঘাটের কানাকড়ি। যার ব্যাকরণিক অর্থ অকিঞ্চিৎ বা অকিঞ্চিৎকর অর্জন, যৎসামান্য প্রাপ্তি, তুচ্ছ বা নগণ্য সংগ্রহ, খুব সামান্য কিছু পাওয়া। শব্দযুগলের প্রতীকী অর্থ অনুসন্ধান করলে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক সাতটি বাঁক-তরঙ্গ। যথা : চল্লিশ (লাহোর প্রস্তাব), সাতচল্লিশ (দেশবিভাগ), বাহান্ন (ভাষা-আন্দোলন), ছেষট্টি (ছয়দফা), ঊনসত্তর (গণঅভ্যুত্থান), একাত্তর (মুক্তিযুদ্ধ) এবং বাহাত্তর (সংবিধান)। কিন্তু, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও যে স্বাধীনতার অর্জন সামান্য, স্বাধীনতার সুফল নগণ্য, মুক্তির স্বাদ তুচ্ছ— তা নাট্যকারের জীবনবোধ ও স্বদেশচেতনায় হয়েছে অভিব্যঞ্জিত।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, এজন্য কি শুধু এরশাদ সরকারই দায়ী? এরশাদ সরকারের সময়কাল ও দুঃশাসনের মধ্যেই কি নাটকটি সীমাবদ্ধ? তাহলে বাংলাদেশের সাফল্য ও ব্যর্থতা কি শুধু এরশাদ সরকারের ওপর বর্তায় না? তাহলে নাটকটির চিরত্ব কোথায়? ব্যক্তি আক্রমণ কিংবা বিশেষ কারও প্রতি প্রতিবাদ তো শিল্প-সাহিত্যের ধর্ম নয়। বস্তুত, এই সাতঘাটের কানাকড়ির নেপথ্যে রয়েছে রাজনীতির নামে দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রবিরোধী অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সামরিক শাসনব্যবস্থা; আর নেতৃত্বের নামে ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ ও একনায়ক হয়ে ওঠার নিকৃষ্ট মনোবাঞ্ছা। জেনারেল আইয়ুব খান থেকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কিংবা পরবর্তী যে-কোনো সরকার, কোথায় এর ব্যত্যয়?

মমতাজউদদীন আহমদের নাটক গণমানুষের নাটক। তার নাটক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিবাদী হওয়ার প্রেরণা দেয়। যে ঐক্য ও প্রতিবাদে পুরোটা পর্ব জুড়ে থাকে সাধারণ মানুষের প্রতি সুগভীর মমত্ববোধ ও স্বদেশভাবনা। স্বদেশের প্রতি অঙ্গীকার ও সর্বসাধারণের অধিকার নিশ্চিতকরণের মধ্যে যে রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি, মমতাজউদদীনের নাটক তারই বার্তা বহন করে। যেকোনো সময়ের যেকোনো পরাক্রমশালী একনায়ক স্বৈরশাসক, রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী ধুরন্ধর ব্যক্তি, মতলববাজ শিক্ষাবিদ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী, অসাধু আমলা, সুযোগসন্ধানী অমানুষ আর হুকুমের দাস পুলিশ যে গণমানুষের মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথে বাধা, মমতাজউদদীনের নাটক সেই চৈতন্য সঞ্চার ও প্রগতিশীল বুদ্ধিচর্চা নির্দেশ করে।

Comments