অমর একুশে বইমেলা: বাঙালি মনন ও উৎকর্ষের স্মারক 

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা থাকলেও রুচি, উৎকর্ষ আর পরিশীলনের দিক থেকে বইমেলা এক অনন্য ব্যাপার। বইমেলা হয়ে উঠেছে বাঙালি মনন ও উৎকর্ষের স্মারক। সামষ্টিক সৃজনের উর্বর জমিন। বইমেলার কথা ভাবলেই প্রাণে খুশির দোলা লাগে, উৎফুল্ল হয়ে উঠে মন। বইমেলা আনন্দ, মিলন আর ভাব আদান-প্রদানের এক গতিশীল স্টেশন। 

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা থাকলেও রুচি, উৎকর্ষ আর পরিশীলনের দিক থেকে বইমেলা এক অনন্য ব্যাপার। বইমেলা হয়ে উঠেছে বাঙালি মনন ও উৎকর্ষের স্মারক। সামষ্টিক সৃজনের উর্বর জমিন। বইমেলার কথা ভাবলেই প্রাণে খুশির দোলা লাগে, উৎফুল্ল হয়ে উঠে মন। বইমেলা আনন্দ, মিলন আর ভাব আদান-প্রদানের এক গতিশীল স্টেশন। 

কত সাজে, কত বিন্যাসে কত বই আসে বইমেলায়। এ জ্ঞানগোলা বাঙালির মননের খনি। মেলায় আসা বইয়ের বিস্তুতি ও বিষয় পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। ১৯৭২ সালে ৩২টি বই দিয়ে শুরুর সেই যাত্রাপত্র আজ কতো ব্যাপক ভাবা যায়? বইমেলার আকারগত বিশালত্ব সাক্ষ্য দিচ্ছে জ্ঞান চর্চায় জাতি বেশ এগিয়েছে। আমাদের অগ্রগতি কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন বয়ানে ধরা যাবে না। মেধা ও মননের চর্চায় ষাটের দশকের এক ক্ষুদ্র প্রয়াস কীভাবে মহীরুহে পরিণত হলো সেই বিষয়টা তলিয়ে দেখা দরকার। 

গত ১৮ মার্চ ২০২২ দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত অমর একুশে বইমেলায় এক হাজার ৬৯টি কবিতার বই, ৫০১টি উপন্যাস এবং ৪৬৭টি গল্পের বই প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা কর্তৃক ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বইমেলা কর্তৃপক্ষ (বাংলা একাডেমি) ২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলার জন্য সবমিলিয়ে ৫৭৩টি প্রতিষ্ঠান এবং সর্বমোট ৭০৪টি (প্যাভিলিয়ন বাদে) স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতিবছর এর ব্যাপ্তি বাড়ছে, বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা, পাঠক ও ক্রেতা।

বইমেলা বাঙালির ভিন্ন উচ্চতার এক বাকস্ফূর্তি। এ স্ফূর্তির থরে থরে সাজানো চিন্তা-চৈতন্য, মনীষা ও সমীক্ষার অনুরণন। একটি জাতির সামষ্টিক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশের এত বড় প্ল্যাটফর্ম দুনিয়ায় খুব বেশি নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক বা কলকাতার বইমেলার বিবেচনায় অমর একুশে বইমেলা দাঁড়িয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে। 

এ বইমেলা হলো ত্রিমাত্রিক শক্তির নিগুঢ় মিলন। প্রথমত, ভাষা চেতনা। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। এ  মাসে বাঙালি রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলে বইমেলা। বইমেলা যেমন একুশের চেতনাকে জাগিয়ে তুলে, আবার একুশের চেতনা জাগিয়ে তুলে বইমেলাকে। একুশের সঙ্গে বইমেলার এ সম্পর্ক দারুণ মিথোজীবিক। এ মিথোজীবিক সম্পর্ক একুশের চেতনার প্রায়োগিক ভিত্তি তৈরি করেছে। একুশকে ঘিরে বইমেলাকেন্দ্রিক এ উৎসবের মধ্য দিয়ে একুশের চেতনা ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বইমেলার মূল আধেয়গত বিষয় হলো-অমর একুশের চেতনা। এই বইমেলা সে মসৃণপথ তৈরি করছে নিপুণভাবে। 

সময়ের পরিক্রমায় বইমেলার পরিসর বেড়েছ। ২০১৪ সাল থেকে এর  বড় একটি অংশকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ফলে ঐতিহ্যের শিকড় আরও বিস্তৃত হয়েছে। যে মেলা একুশের মহান ঐতিহ্যকে ধারণ করে এতো বিশাল আকার ধারণ করেছে, তা এখন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্থান সোহাওয়ার্দী উদ্যানের পাদপীঠে স্থান পেয়েছে। যেখান থেকে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। এখানেই রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং শিখা চিরন্তন। আরও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ও স্বাধীনতা-জাদুঘর।

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক গবেষক শামসুজ্জামান খান বইমেলার ইতিহাস ও নতুন আঙ্গিকে বইমেলা শিরোনামে ২০১৪ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন-এখানে বইমেলার স্থান সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের বাঙালির জাতিসত্তার উদ্বোধনের স্মৃতিবাহী একুশের ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা যুক্ত হয়ে মেলাটি এখন নতুন আঙ্গিক, পরিসর ও মাত্রিকতায় স্থিত হলো। 

দ্বিতীয়ত. একুশে বইমেলার বুকস্টলগুলোর ডিজাইন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যেখানে বাঙালির নিজস্ব ডিজাইন শৈলীর এক মহামিলন ঘটে। স্টলের আকার, কালার কোড, উপকরণের ব্যবহার, অক্ষরবিন্যাস ও কাঠামো সবমিলিয়ে মেলার আঙ্গিক হয়ে ওঠে বাঙালিয়ানার এক মহাছবি। এ মহাছবির মূল আখ্যান আপন করার শক্তি। বইমেলার সার্বিক বিন্যাস দর্শনার্থীদের এ অনুভব দেয় যে আহ্! এই তো আমার প্রাণসংলগ্ন ব্যাপার। এ মেলা বিচ্ছুতির স্মারক নয় বরং সংযোগের উপলক্ষ। 

অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ ''বইমেলা বইয়ের মেলা নয় সমাজের জানালা (২০১৭)'' শিরোনামে ২০১৭ সালে চারুপাতায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন-দীর্ঘ দিন ধরেই এই বইমেলা ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বলেই জনমানসে প্রতিভাত হয়েছে।... বইমেলাকে একুশের মর্মবস্তুর সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন, সেই মর্মবস্তু হচ্ছে বাধাবিঘ্ন অস্বীকার করে নিজের কথা বলা, নতুন কথা বলা; যা সহজে উচ্চারিত নয় তাকে বাক্সময় করে তোলা। একুশের গ্রন্থ মেলার এই দিকটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটি চিন্তার ক্ষেত্রে বৈচিত্রের, বিভিন্নতার উপস্থিতির স্বীকৃতি।

বই কেনার উপলক্ষে ছাড়াও কেউ যদি  বইমেলায় যান তবুও তাকে যথেষ্ট ভালো লাগবে এবং তা লাগবে মূলত দুটো কারণে- এক. নতুনত্বের সুঘ্রাণ-সবকিছুর ভেতর নতুনত্ব, বই, ডিজাইন, নানা বয়সী মানুষ, গল্পগুজব, চলাফেরা, দেখা-সাক্ষাৎ। এ বইমেলা হয়ে উঠে নিজেকে সজিব করে নেওয়ার দারুণ পরিক্ষেত্র। বইমেলা থেকে কেও খালি হাতে ফিরে না। ফিরে নতুন বই নিয়ে, নয়তো এক প্রীতিঅনুভব নিয়ে। একই সঙ্গে অনেকে ভেতর সৃজনের বেদনা তৈরি করে বইমেলা। পছন্দের সব বই তো আর কেনা সম্ভব হয়, ফলে কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে অনেকে ফিরতে হয়, এ অতৃপ্তিকেও এক ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। মানুষের চিন্তার ধরন ও বিষয় বিচিত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা মেলে বইমেলায়।

তৃতীয়ত. পরিচিতির ভুবন বিস্তৃতি। বইমেলায় প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয়। বইমেলা কেবল বইমেলা নয় কথামেলাও বটে। যোগাযোগের টু-স্টেপস, থ্রি-স্টেপস তত্ত্বের চমৎকার প্রয়োগগত ক্ষেত্র হলো বইমেলা। একজন থেকে অনেকের সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক বুননের সুযোগ করে দেয় এ বইমেলা। সামাজিক যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কের এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় বইমেলা। সামাজিক পুঁজিতে ভরা এক সমৃদ্ধ ব্যাংক হলো বইমেলা। যেমন-লিটলম্যাগ চত্বরে একজনের সঙ্গে পরিচয় গড়িয়ে পড়ে দশজনে। সামাজিক সম্পর্ক সমৃদ্ধকরণে বইমেলার জুড়ি মেলা নেই। 

অন্যদিকে বইমেলাকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পে এক অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। বলা যায় এ মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অনেক প্রকাশনা শিল্পে অর্থ লগ্নি করছেন। অমর একুশে বইমেলা এক মাস ধরে চলে। সময় বিবেচনায় সম্ভবত এটিই পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী বইমেলা। এই মেলায় মানুষের আগ্রহ এতই বেশি যে শুধু শুধু ঢাকাবাসী নয়, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও মফস্বল এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও জ্ঞান পিপাসুরা এতে অংশ নেন।
অমর একুশে বইমেলা দেখিয়ে দেয় বাঙালির চিন্তার সক্ষমতা। সৃষ্টিশীলতা ও মননের বিবেচনায় বইমেলা সমাজের খোলাজানালা। অধ্যাপক আলী রীয়াজ তাঁর উল্লিখিত নিবন্ধে বলছেন- বই মেলায় গেলে পাশাপাশি সাজানো বইয়ের দিকে তাকালে বইমেলার আরেকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ার কথা, তা হল সহিষ্ণুতা। একই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, প্রতিদ্বন্দ্বী বক্তব্যের বইয়েরা নির্বিবাদে সহাবস্থান করে, যেমন সমাজে থাকার কথা, রাষ্ট্রে থাকার কথা। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ১৯৭২ সালে যে মেলার সূচনা হয়েছিলো, গত কয়েক দশক ধরে যা অব্যাহত থেকেছে তার মর্মবস্তু যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের সহাবস্থান। 

কিন্তু সেই পথ আজ কণ্টকমুক্ত না। নানা অজুহাতে বইমেলা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত করছে। যেমন এবারের বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর তিনটি বই নিয়ে বাংলা একাডেমি 'রাজনৈতিক অশ্লীলতা''র অভিযোগ এনে আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়নি। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি রোদেলা প্রকাশনীর প্রকাশিত একটি বই 'আপত্তিকর' বলে বিবেচনা করে স্টল বন্ধ করে দিয়েছিল। ২০১৬ সালের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলটি বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ, ঐ প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই জব্দ করে এবং আটক করে প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। এসব তৎপরতার ভেতর কোনো শুভ ইঙ্গিত নেয়। 

একটি আধুনিক সমাজে পাঠক হলো সার্বভৌম সত্তা। কোনো বই তারা গ্রহণ করবে আর কোনটি প্রত্যাখ্যান করকে তা তাদের এখতিয়ারের বিষয়। ভিন্নমত, ভিন্নযুক্তি, ভিন্ন ভাষা অপরাধ নয়। বরং অভিব্যক্তি প্রকাশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল মানদণ্ডে ভিন্ন মত গ্রহণযোগ্য বিষয়। সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা রুদ্ধ হলে সেই সমাজ অন্ধকার নেমে আসতে বাধ্য। 

যে অগ্রসর সমাজে একই বিষয় নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় এবং তা অগ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো ধরনের সৃজনশীলতা ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব অর্জন, এর চর্চা ব্যক্তির অধিকার, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল মানদণ্ডে সুরক্ষিত। 

বাংলা একাডেমি তার বুকে যে স্লোগানটি ধারণ করে রয়েছে-''বাঙালির জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক'' তাকে সত্যি সত্যি আমলে নিতে হবে। চিন্তা ও মতের ভিন্নতা চর্চায় বাংলা একাডেমি হোক সহায়ক, নিয়ন্ত্রক নয়। অমর একুশে বইমেলা হোক স্বমত, ভিন্ন মত, চিন্তা-সৃজনের উজ্জ্বল পরিক্ষেত্র। আর এটি নিশ্চিত করা গেলে অমর একুশের বইমেলার মর্মবাণীকে সমুন্নত থাকবে।
 

Comments