শ্রদ্ধা

আহমদ শরীফের ভাব-বুদ্বু্দে আমরা 

দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলো ছড়ানো বুদ্ধিজীবীদের একজন আহমদ শরীফ। রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তা তাকে কেবল আধুনিক চিন্তাবিদ-আলোচক-সমালোচক ছাড়াও, একজন আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি তার জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরেও বিপুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন। তবে বিশ্বাস-ভিত্তিক পরিচয়ের আগে তার প্রথম পরিচয়- সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক। 

দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলো ছড়ানো বুদ্ধিজীবীদের একজন আহমদ শরীফ। রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তা তাকে কেবল আধুনিক চিন্তাবিদ-আলোচক-সমালোচক ছাড়াও, একজন আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি তার জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরেও বিপুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন। তবে বিশ্বাস-ভিত্তিক পরিচয়ের আগে তার প্রথম পরিচয়- সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক। 

আহমদ শরীফের সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে দর্শন-চিন্তা-তত্ত্ব পাওয়া যায় তার নানা প্রবন্ধে। সেইসব প্রবন্ধে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা-সংকট-জটিলতার আলোচনা-সমালোচনা এবং কিছু ক্ষেত্রে এসবের সমাধান সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন তিনি। এছাড়াও তার ডায়েরি- 'ভাব-বুদ্বুদ' নামে প্রকাশিত হয়। যাতে প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন নানা দর্শন-নিদর্শন। 

ডায়েরিতে মনোমুগ্ধকর একটি উক্তি পেলাম: '...Greatmen think alike' কথাটি ভুল, বরং Greatmen's thinking is always different and new কথাটাই সর্বাংশে সত্য, সাধারণ মানুষই প্রজন্মক্রমে চিন্তা-চেতনায় প্রথা-পদ্ধতি নীতি-রীতি-নিয়মে গড্ডল স্বভাবেরই হয়। মনীষীরা নতুন ও বহুবিচিত্র চিন্তায় কর্মে আবিষ্কারে উদ্ভাবনে মানুষের মানস ও ব্যবহারিক জীবন ঋদ্ধ করেছে- বিজ্ঞানে, দর্শনে সাহিত্যে।"

মানুষের মধ্যে নতুন ও বহুমাত্রিক চিন্তা-চেতনা-দর্শন-তত্ত্ব উদ্ভাবনের থেকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত দর্শনের চর্চা বেশি করতে দেখা যায়। তারা সকলেই মোটামুটি একই মতাদর্শ-চিন্তাধারার মানুষ হয়। প্রচলিত চিন্তার সেইসব মানুষকেই আহমদ শরীফ সাধারণ মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, গ্রেটম্যান হিসেবে নয়। তারা ঠিক-বেঠিক ভুল-সঠিক নৈতিক-অনৈতিক এবং সকল সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় সংকটের সমাধান খুঁজে বেড়ায় তাদের অনুসৃত মতবাদ বা চিন্তাধারায়। কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য যে সমাজ পরিবর্তনশীল। এক-কালের কোনো প্রতিষ্ঠিত মতবাদ, চিন্তা, দর্শন বা তত্ত্ব এ-কালের জন্য সত্য নাও হতে পারে। নতুন সময়ে, নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হবে নতুন চিন্তা, নতুন দর্শন। এমন পরিস্থিতিতে যিনি হবেন নতুন চিন্তা-দর্শনের সূচনাকারী, অগ্রণী ও দীক্ষক, তিনিই আহমদ শরীফের মতে গ্রেটম্যান।

এটাও সত্যি যে প্রতিষ্ঠিত চিন্তা-দর্শন-তত্ত্বের সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন না করলে নতুন চিন্তা, দর্শন ও তত্ত্ব উদ্ভাবন অনেকটাই অসম্ভব। তাই সকল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে সকলকে নিরুৎসাহিত নয়, বরং উৎসাহিত করা প্রয়োজন। প্রচলিত মতাদর্শ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনের পর যদি কেউ নতুন চিন্তার উদ্ভব করেন, মানুষকে নতুন দর্শনে আলোকিত করেন এবং নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি সেই নতুন চিন্তা-দর্শন-তত্ত্ব যদি আহমদ শরীফের দর্শনের বিপরীতার্থক-ও হয়, তবুও সেই নতুন দর্শন নিয়ে তার কোনো আপত্তি থাকতো বলে আমার মনে হয় না। বরং তিনি সেই নতুন চিন্তা-কে সাধুবাদ জানাতেন এবং তার উদ্ভাবক-কে জানাতেন শুভকামনা। 

ভাব-বুদ্বুদে আরেকটা উক্তি প্রাসঙ্গিক: "My mission in life is to appeal to the people around me to be rational, because humanity lies out of rationality."। আহমদ শরীফ বরাবরই যুক্তিবাদী ছিলেন এবং তার নানা প্রবন্ধে যুক্তিবাদ ফুটে উঠেছে। এইখানে পাঠকদের যুক্তিবাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ, নতুন চিন্তা-দর্শন-তত্ত্ব নিয়ে আহমদ শরীফের তখনই কোনো আপত্তি থাকবে না, যদি সেই চিন্তা-দর্শন-তত্ত্ব হয় যুক্তিসঙ্গত বা যৌক্তিক।

যুক্তিসম্মত বা যৌক্তিক চিন্তা-দর্শন-তত্ত্ব কখনোই মানুষের মনে-মননে-মগজে সৃষ্টি বা উদ্ভব হয় না - সেটা বলা ভুল হবে। উদ্ভব হচ্ছে ঠিকই, নানা সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক কারণে উদ্ভাবক তা প্রকাশ করার অনুপ্রেরণা পান না। তাদের জন্য আহমদ শরীফ তার ডায়েরিতে রেখে গেছেন এক অনুপ্রেরণা ও একটি উপদেশ: "নতুন চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে যারা নতুন চিন্তাপ্রসূত নতুন কথা বলে তারা নিন্দিত, লাঞ্ছিত কিংবা নিহত হয়। সমকালে তাদের সমর্থক মেলে না। কিন্তু যতই দিন যায়, মৃত্যুর পরে গভীর রাতের জ্যোৎস্নার মতো তাদের বাণীর ও ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব ও ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। তাই নতুন চেতনা চিন্তা প্রকাশে বিরত থাকতে নেই।"

এ কথা সত্যি সামাজিক রাজনৈতিক কারণে ও রাষ্ট্রীয় কিছু অযৌক্তিক আইনে নতুন কোনো চিন্তা-দর্শন-তত্ত্ব প্রকাশে উদ্ভাবক বাধাগ্রস্ত হয়। মানুষের জীবনে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা ও তা নিয়ে সচেতন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। কেউ যদি কোনো নতুন চিন্তা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের সমাজের অতি রক্ষণশীল জনগণ তাকে হেয়, নিন্দা ও লাঞ্ছিত করবে। হেনস্তার শিকার কেবল সেই ব্যক্তি নয়, হতে হবে তার পরিবার-পরিজন-আপনজন সকলকে।

তাই বোধহয় ভাব-বুদ্বুদের– "যা ভাবি, যা বুঝি এবং যা জানি তা-ই লিখি - ডরাই না।"- বাক্যটির সাথে প্রথম পাঠেই একমত হতে পারছিলাম না। কোনো ব্যক্তি যদি স্বার্থহীন হয়েও থাকে, পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন আপনজন ও কাছের মানুষদের স্বার্থটা উপেক্ষা করা কি এতই সহজ? সামাজিক সকল নিন্দা-লাঞ্ছনা নিজের সঙ্গে পোহাতে হয় অতি আপনজনদেরও। নিজের নিরাপত্তার গুরুত্ব না দিলেও, আপনজনদের নিরাপত্তা কি এত সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায়? যখন একজন উদ্ভাবক এই সকল প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, তখন একটি নতুন চিন্তা-দর্শন-তত্ত্ব প্রকাশের থেকে নিজের এবং আপনজনদের নিরাপত্তার স্বার্থটাই বড় হয়ে দাড়ায়। তবুও একজন উদ্ভাবকের প্রকাশের ইচ্ছার মৃত্যু হয় না, সৃষ্টি হয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।

মনের এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অন্ধকারে আহমদ শরীফ পাঠকদের সামনে একটি প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন ডায়েরিতে: 'আমাদের কর্তব্য কি? ২১শে ফেব্রুয়ারি গৌরবের রোমন্থন, না সমকালীন সংকটে-সমস্যায় ২১শের সংগ্রামের অনুসরণ?' ১৯৫২ সালের ভাষা নিয়ে বাঙালিদের সংগ্রামটা ছিল আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে তার নিয়ন্ত্রণকারী বা নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টাকারীদের থেকে মুক্তির লড়াই। 

বাংলায় স্বাধীনভাবে কথোপকথন, আলাপচারিতা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকর্ম এবং মত প্রকাশের চর্চা নিশ্চিত করতে জীবনও দিয়েছেন অনেক ভাষাসৈনিক। ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া এ যুগে একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সংগ্রামের মূল কারণ মনে রেখেছে কয়জন? একালে মত প্রকাশ বা লেখার স্বাধীনতা নিয়ে যে রাষ্ট্রীয় বাধা-বিপত্তি দেখা যায়, সেই সংকটে-সমস্যায় একুশের সংগ্রামের অনুসরণ করছে কেউ? যদি কেউ-ই অনুসরণ না করে, তাহলে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া একুশের রোমন্থন ছাড়া কিছুই না। 

একুশের গতানুগতিক রোমন্থন আসলে শহীদ ভাষাসৈনিকদের তাদের প্রাপ্য সম্মানের সিকিভাগও দেয় না। তখন সকল নতুন চিন্তা-দর্শন-তত্ত্বের উদ্ভাবকদের কর্তব্য হয়ে দাড়ায়, একুশের সংগ্রামের অনুসরণ করে, ভাষার স্বাধীন ব্যবহারের মাধ্যমে তার নিয়ন্ত্রণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, স্বাধীন ভাষার ব্যবহারে নিজের নতুন চিন্তা-দর্শন-তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত করা।

আমাদের কর্তব্য কী?- এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে-খুঁজতে একসময় মননে-মগজে যেন এক আলোকপাত ঘটে, সত্যের জয় দেখার তীব্র ইচ্ছা জাগে, নতুন চিন্তা-দর্শন-তত্ত্বের জন্য মনে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয় এবং একুশের সংগ্রামের অনুসারী হয়ে আবার ভাষার মুক্তি দেখতে ইচ্ছা করে। তখন স্বার্থহীনভাবে নতুন চিন্তা-দর্শন-তত্ত্বের প্রকাশের জন্য মনে এক অদম্য সাহস জন্ম নেয়, বাক্যটি একাকীই অন্তরে সাড়া দেয়- ডরাই না।

আহমদ শরীফ এভাবেই প্রজন্ম-ক্রমে দর্শন ও তত্ত্বের উদ্ভাবকদের অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন। মানুষকে- বিশেষ করে পাঠকদের- তিনি যুক্তিবাদী করে তুলতে চেয়েছিলেন। কালানুক্রমে তার চিন্তা ও দর্শন অনুপ্রাণিত করবে অসংখ্য মানুষকে, তৈরি করবে বহুবিচিত্র বহুমাত্রিক চিন্তক ও দার্শনিক, এ দেশ আবার দেখবে বহু কালজয়ী বুদ্ধিজীবী।

আহমদ শরীফের দর্শন-নিদর্শন যুগে-যুগে জাগ্রত হবে এবং তার দর্শন মানুষকে করবে আরও যুক্তিবাদী। 'প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয়, কিন্তু মানুষ হওয়ার জন্যে মন ও মনন-দুই-ই দরকার'- তার এই বাক্যে উদ্বুদ্ধ হবে বহু নতুন চিন্তার উদ্ভাবক, প্রকাশ করবেন তাদের দর্শন। চিন্তা ও লেখার স্বাধীনতা দেখবে নতুন রূপে, ভাষার ব্যবহার হবে মুক্ত এবং আহমদ শরীফের প্রেরণায় সূচনা হবে আধুনিক ও চিন্তাশীল জ্যোতির্ময়কালের।

Comments