একুশের একাত্তর

২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করেন এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা

পাবনায় ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার ও সক্রিয় প্রভাব বিস্তারে স্থানীয় এডওয়ার্ড কলেজ এবং জেলা স্কুলের রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রগতিশীল জনগণ অবদান রেখেছিলেন।
পাবনার ভাষা আন্দোলন
পাবনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে ২১ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১ জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের সপ্তদশ পর্বে থাকছে পাবনার ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)

ভাষা আন্দোলনের স্রোত ছড়িয়ে পড়েছিল পাবনাতেও। পাবনা বরাবরই ছিল রাজনীতি সচেতন শহর। একই সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির শহরও।

পাবনায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বেই। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবে তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সদস্যদের বিরোধিতা ও খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মতো গর্জে উঠেছিল পাবনার ছাত্রসমাজও। সেসময় ছাত্ররা পথে নেমে বিক্ষোভ করে।

ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ পাবনায় বিক্ষুব্ধ জনতা গঠন করে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এর আহ্বায়ক করা হয় জেলা মুসলিম লীগের (উদারপন্থি) সম্পাদক দেওয়ান লুৎফর রহমানকে। যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় মাহবুবুর রহমান ও আমিনুল ইসলাম বাদশাকে।

পাবনায় ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার ও সক্রিয় প্রভাব বিস্তারে স্থানীয় এডওয়ার্ড কলেজ এবং জেলা স্কুলের রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রগতিশীল জনগণ অবদান রেখেছিলেন।

আন্দোলনকে সফল করতে ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠক হয়। সেখানে আন্দোলন বিষয়ে নানান সিদ্ধান্ত এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলন সফল করতে শহরের দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়। চালানো হয় প্রচারণা।

পাবনা শহরে শ্রমিকদের মধ্যে ইশতেহার বিলি করা হয়।

আন্দোলন থামাতে পাবনার জেলা প্রশাসক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার বাসভবনে আলোচনায় বসেন। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন। আলোচনায় কোন অগ্রগতি না হওয়ায় প্রশাসন শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। একই সঙ্গে প্রশাসনের সহায়তায় মুসলিম লীগ কট্টরপন্থি সদস্যরা হরতালবিরোধী ও বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

২৯ ফেব্রুয়ারি পাবনায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয়। সেদিন সকালে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে আদালত পাড়ার দিকে এগোতে থাকেন। সাধারণ জনতাও মিছিলে অংশ নেন। একপর্যায়ে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয় এবং বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।

পুলিশি বাধা উপেক্ষা করেই নানান দিক থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল এগিয়ে যায়। সবার কণ্ঠে স্লোগান ছিল, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না', 'পুলিশি জুলুম বন্ধ করো' ইত্যাদি।

১৭ ফেব্রুয়ারি এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেদিন দুপুর ৩টায় সমাবেশে বক্তৃতা দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সমাবেশে মওলানা ভাসানী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হতে ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান।

আন্দোলনের নেতাকর্মীরা বন্দিদের মুক্তির দাবিতে জেলা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও করেন। এর ধারাবাহিকতায় ১-৩ মার্চ পর্যন্ত পাবনায় হরতাল ঘোষণা করা হয়।

১ মার্চ পুলিশ ছাত্রনেতা মাহবুবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করলে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।

২ মার্চ সন্ধ্যায় এডওয়ার্ড কলেজের টাউন হোস্টেলে বৈঠক হয়। গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতির কারণে সভা ভণ্ডুল হয়ে যায়।

৩ মার্চ এডওয়ার্ড কলেজ হোস্টেলে আরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে পাবনায় বেশ জোরেশোরেই ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো পালিত হয়। সেসময় সেখানকার বেশিরভাগ দোকানপাট ছিল বন্ধ।

কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী পাবনায় ১১ মার্চকে আন্দোলনের মূল হিসেবে ধার্য করে আন্দোলন সফল করার জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। পাবনা তখন কার্যত অচল ছিল। আন্দোলন দমন করতে ১০ মার্চ পুলিশ আমজাদ হোসেন, রওশন জান চৌধুরী, প্রদীপ রায়সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।

প্রশাসনের দমননীতি উপেক্ষা করে ছাত্ররা আন্দোলন চলমান রাখেন। সেসময় পাবনায় এসেছিলেন আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মতিন ও মোহাম্মদ সুলতান।

১১ মার্চ পাবনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল হয়। সেদিন এডওয়ার্ড কলেজসহ শহরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাজারো ছাত্র মিছিলে যোগ দেয়। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় পাবনা শহর। মিছিল শেষে এডওয়ার্ড কলেজে ছাত্রসভায় যোগ দেয় সর্বস্তরের জনতা। সভায় বক্তব্য দেন আবদুল মতিনসহ পাবনার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।

ঢাকায় আন্দোলন একপর্যায়ে স্তিমিত হলেও পাবনায় আন্দোলন চলমান থাকে। ঢাকার 'শান্তিচুক্তি'র প্রভাব পাবনায় পড়েনি। পাবনায় ভাষা আন্দোলন চলেছে ১৯৪৯ সালেও। সেসময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রসাদ রায় ও লিলি চক্রবর্তী।

১৯৫০ সালে পাবনায় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শিখা সংঘ গঠিত হয়। সংগঠনটি পাবনায় ভাষা আন্দোলনকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯৫১ সালের শেষের দিকে এডওয়ার্ড কলেজের বার্ষিক মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। সেসময় তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা অযৌক্তিক বলে অভিহিত করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পিছনে যুক্তি তুলে ধরেন।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনেরও মতো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও জেগে উঠেছিল পাবনা। এবারও পাবনায় আন্দোলন গড়ে তোলার মূল সূতিকাগার ছিল এডওয়ার্ড কলেজ।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' ঘোষণা দিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পাবনার ছাত্র-জনতা। ছাত্রনেতা আবদুল মমিন তালুকদারকে আহ্বায়ক করে পাবনায় গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এর মাধ্যমে পাবনায় বেশকিছু কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ঘোষিত কর্মসূচিও সেসময় পাবনায় পালিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি মূল আন্দোলনের দিনকে সামনে রেখে আন্দোলন সফল করতে পাবনায় নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়।

১৭ ফেব্রুয়ারি এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেদিন দুপুর ৩টায় সমাবেশে বক্তৃতা দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সমাবেশে মওলানা ভাসানী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হতে ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান।

ভাষা আন্দোলনের মূল কর্মসূচির দিন ২১ ফেব্রুয়ারিকে সফল করতে পাবনায় পোস্টার লাগানোর পাশাপাশি চোঙা ফুঁকে প্রচারণা চালানো হয়।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে এডওয়ার্ড কলেজের টাউন হোস্টেলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জরুরি বৈঠক হয়। আন্দোলন দমন করতে জেলা প্রশাসক পাবনা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে।

১৪৪ ধারা জারির সংবাদ জানতে পেরে পরিষদের ৪ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এডওয়ার্ড কলেজের আমতলা থেকে মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে সমাবেশের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।

২০ ফেব্রুয়ারির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই এডওয়ার্ড কলেজের আমতলায় শত শত শিক্ষার্থী জড়ো হতে শুরু করেন। এরপর আবদুল মমিন তালুকদারের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করেন। তাদের মিছিলের ছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান। মিছিলটি পাবনা শহর প্রদক্ষিণ করে।

সেদিন বিকেলে এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মির্জা শওকত হোসেন। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন নঈমুল ইসলাম, রণেশ মৈত্র, আবদুল মতীন প্রমুখ।

পুলিশ মিছিলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্ররা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। একপর্যায়ে পুলিশের তীব্র বাধার মুখে মিছিল বিভক্ত হলেও ছাত্ররা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে কালেক্টরেট ভবনের দিকে যাত্রা করে। একপর্যায়ে বাণী সিনেমা হলের দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ মিছিলে আবারও বাধা দেয়। সেসময় কয়েকজন আন্দোলনকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা শহরের ছাত্র-জনতার কর্মসূচী তুলে ধরা হয়েছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পাবনা, ২২শে ফেব্রুয়ারী। গতকল্য পূর্বাহ্ণ ১১ ঘটিকায় পাবনায় প্রায় তিন হাজার ছাত্র ধর্মঘট করিয়া 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'ছাত্র বন্দীদের মুক্তি চাই' প্রভৃতি ধ্বনিসহ সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করেন। অপরাহ্ণে কলেজ প্রাঙ্গণে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় মির্জা শওকত হোসেন সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণের এবং আরবী হরফে বাংলা ভাষা প্রচলনের অদ্ভুত প্রস্তাব প্রত্যাহারের এবং অবিলম্বে ছাত্রদের মুক্তি দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।'

ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার সংবাদ পাবনায় এসে পৌঁছায় ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। সেসময় পাবনায় তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করে। রাস্তায় নেমে আসে ছাত্র ও সর্বস্তরের জনতা।

২২ ফেব্রুয়ারি এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে জনসভা হয়। বাংলার পক্ষে ও ছাত্রহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।

শহরের পাশাপাশি আন্দোলন পাবনার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে ছিল চাটমোহর।

২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে স্কুলমাঠে সমবেত হয়ে সংক্ষিপ্ত সভা করে। সভা শেষে তারা মিছিল বের করে। মিছিল থেকে চাটমোহর থানার পুলিশ কয়েকজন ছাত্রকে আটক করে।

২১ ফেব্রুয়ারির আগেই চাটমোহরে গৌরচন্দ্র সরকারকে সভাপতি ও আবুল হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠন করা হয়েছিল ১১ সদস্যের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পূর্ববর্তী ঘোষণা অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি চাটমোহরে হরতাল হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ চাটমোহরে এসে পৌঁছামাত্র রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের কদমতলা মাঠে জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন আবুল হোসেন, হাবিবুর রহমান, আবদুল লতিফ সরকার, মমতাজ খতিব, ওমর আলী প্রমুখ।

জরুরি বৈঠক শেষে সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিল বের হয়। পরে চাটমোহরের বালুচর খেলার মাঠে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ময়েন উদ্দিন মোল্লা। সভায় বক্তারা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাবি আদায়ের শপথ নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে স্কুলমাঠে সমবেত হয়ে সংক্ষিপ্ত সভা করে। সভা শেষে তারা মিছিল বের করে। মিছিল থেকে চাটমোহর থানার পুলিশ কয়েকজন ছাত্রকে আটক করে।

পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি এই ২ স্কুলে আরেকটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্কুলশিক্ষক নারায়ণচন্দ্র চৌধুরী। সভা শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি চাটমোহর থানা মোড়ে এসে শেষ হয়। সেদিন ছাত্রনেতা আবুল হোসেন ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

২৭ ফেব্রুয়ারি চাটমোহরের মথুরাপুর থেকে আবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পাবনার ভাষা আন্দোলন বেগবান ছিল ঈশ্বরদীতেও। ঈশ্বরদীর এসএম হাইস্কুল, গার্লস হাইস্কুল, পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ ও দাশুড়িয়ার এমএম হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ মিছিল ও সভার পুরোভাগে ছিল।

ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রহত্যার সংবাদ ঈশ্বরদীতে এসে পৌঁছালে সেখানে ছাত্রনেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এসময় ছাত্রনেতারা দ্রুত সাঁড়া মাড়োয়ারী স্কুলে যান। সেসময় স্কুলের ছাত্রদের একত্রিত করে খবিরের চায়ের দোকানের মোড়ে বটতলায় প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশের বক্তব্য রাখেন দশম শ্রেণির ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন ও বীরেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ। সভাশেষে প্রতিবাদী মিছিল বের করা হয়।

মিছিলটি যখন স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন ছাত্রীরাও মিছিলে যোগ দেয়। তারপর মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ঈশ্বরদী ডাক বাংলো মাঠের সমাবেশে যোগ দেয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়েও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার ছিল পাবনার সর্বস্তরের জনতা। ১৯৫৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাবনার জিন্নাহ পার্কে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে পাবনায় এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন, আবদুল কাইয়ুম, সর্দার আবদূর রবসহ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

নুরুল আমীনের পাবনায় আসার প্রতিবাদে এডওয়ার্ড কলেজের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে।

১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে এডওয়ার্ড কলেজের টাউন হোস্টেলের ছাত্ররা শক্ত কাগজে নুরুল আমীন লিখে কুকুরের গলায় ঝুলিয়ে দেয়। ভয়ে কুকুরগুলো ছোটাছুটি করলে ছাত্ররা শহরবাসীকে জানায় খুনি নুরুল আমীন 'কুকুররূপে' পাবনায় এসেছেন। সেসময় নুরুল আমীন পাবনা সার্কিট হাউসে অবস্থান করছিলেন।

একপর্যায়ে এডওয়ার্ড কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে নুরুল আমীনসহ তার সহচরেরা পাবনা ছাড়তে বাধ্য হন।

১৯৫৪ সালে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদ ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে কলেজের পুরনো ভবনের সামনে শহীদ মিনার নির্মাণ করেন।

তথ্যসূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক

ভাষা আন্দোলন কোষ/ এম আবদুল আলীম

১৩ ও ১৫ মার্চ ১৯৪৮ এবং ২৬, ২৯ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ ১৯৫২, দৈনিক আজাদ

[email protected]

Comments