রাষ্ট্র বদল হয়েছে, ঔপনিবেশিকতা বদল হয় নাই

এখন সংস্কৃতির কথা বলি। আমাদের বাবারা ধুতি পরতেন। ধুতি পরেই অফিসে যেতেন, সেটাই ছিল কালচার। যখন ৪৬ সালে পাকিস্তান আন্দোলন হচ্ছে, দাঙ্গা হচ্ছে, তখন কলকাতায় বাবার কাছে গিয়ে দেখি তিনি এক ধরনের কাপড় পরছেন—প্যান্ট-পাজামা। এটা পাজামার মতোই কিন্তু দুদিকে পকেট আছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৭তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৩ জুন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। ওই বক্তৃতায় উঠে আসে তার মা-বাবার স্মৃতি, শৈশব কৈশোরের দিনগুলোর বর্ণনা, শিক্ষা ও সাহিত্য জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। সবমিলিয়ে তার এই বক্তৃতা যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

এই শিক্ষাবিদের দেওয়া আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো ৭ পর্বে প্রকাশিত হচ্ছে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন ইমরান মাহফুজ, খালিদ সাইফুল্লাহ ও মোহাম্মদ আবু সাঈদ। আজ এর পঞ্চম পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে।

এখন সংস্কৃতির কথা বলি। আমাদের বাবারা ধুতি পরতেন। ধুতি পরেই অফিসে যেতেন, সেটাই ছিল কালচার। যখন ৪৬ সালে পাকিস্তান আন্দোলন হচ্ছে, দাঙ্গা হচ্ছে, তখন কলকাতায় বাবার কাছে গিয়ে দেখি তিনি এক ধরনের কাপড় পরছেন—প্যান্ট-পাজামা। এটা পাজামার মতোই কিন্তু দুদিকে পকেট আছে।

এটা কেন? এটা এজন্য যে, আমি হিন্দু না মুসলমান এটা বুঝতে পারবে না। হিন্দু পাড়ায় গেলে মনে করবে হিন্দু, আর মুসলিম পাড়ায় গেলে মনে করবে মুসলমান।

তখন আমি ভাবলাম, বেশ নতুন একটা ব্যাপার তো হচ্ছে। আমার বাবা আমার কাছে সবসময় ইংরেজিতে চিঠি লিখতেন। আমার মনে হয় তিনি ভয় পেতেন, যে বাংলায় লিখলে অনেক বেশি আবেগী হতে হবে, খোলামেলা হতে হবে।

সেদিন আমি একটা প্রবন্ধ পড়ছিলাম একজনের, তিনি বলছেন যে, আমরা তো সব নাম বদল করেছি, ইকবাল হলের নাম বদল করেছি, জিন্নাহ হলের নাম বদল করেছি, কিন্তু কার্জন হলের নাম তো বদল করি নাই। এইটা আমাকে ধাক্কা দিলো। তাই তো! আমরাই তো সেই ঔপনিবেশিকতাকে রক্ষা করছি।

রাষ্ট্র বদল হয়েছে কিন্তু ঔপনিবেশিকতার বদল হয় নাই। পাকিস্তানের সময়ে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলায় একটা উপনিবেশ করতে চেয়েছে, আর আজকে বাংলাদেশ আলাদা একটা উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। এটা যে পশ্চিমাদের উপনিবেশ তা না, বাঙালি ধনীদের উপনিবেশ, যারা বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে তাদের উপনিবেশে।

বাংলাদেশ নিয়ে আমার আরেকটা অভিজ্ঞতা আছে। পাকিস্তানি হানাদাররা চলে যাবার সময় ব্যাংকের ভল্টে আগুন দিয়েছে, নোটে আগুন দিয়েছে, কিছু নোট পুড়েছে আর কিছু পোড়েনি এমতাবস্থায় একজন তরুণ সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। সে দেখেছে এবং আগুন নিভিয়ে সব টাকা একত্রিত করেছে। কিন্তু, সে নিবে কি করে? তার কাছে তো বস্তা নেই। সে তার লুঙ্গি খুলে লুঙ্গিতে টাকা বেঁধে উলঙ্গ অবস্থায় মাথায় টাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছে—এটা ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা। আমার মনে হয়, সেটা ভবিষ্যত বাংলাদেশের একটি রূপ।

আমরা এতো সংগ্রাম করেছি, আন্দোলন করেছি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেই তো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, সমাজতান্ত্রিকরা দেশের অভ্যন্তরে কাজ করেছেন আর জাতীয়তাবাদীরা নেতৃত্বে ছিলেন। কিন্তু, সমাজতান্ত্রিকরা নেতৃত্ব দিতে পারেননি, আর পারেননি বলেই সেদিন সেই তরুণ লুঙ্গি খুলে উলঙ্গ অবস্থায় মাথায় টাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছিল।

রাষ্ট্র অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সমাজ বড় আমাদের জন্য, রাষ্ট্র বিদেশি, বিদেশিরাই রাষ্ট্র গড়েছে। কিন্তু, রাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে তো সমাজ চলবে না, রাষ্ট্র তো কর্তৃত্ব করছে।

আমার লেখায় জাতীয়তাবাদ আসে, রাজনীতি আসে, শ্রেণি আসে—এটা আমি বিলেতে গিয়ে শিখেছি। আমি বারবার শ্রেণি সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসি এবং আমি জানি যে, জাতি সমস্যার সমাধান না করলে শ্রেণি সমস্যার সমাধান হবে না। জাতি সমস্যার এক ধরনের সমাধান আমরা একাত্তরে করেছি কিন্তু শ্রেণি সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। এজন্য আমাদের সংগ্রাম এখনো চলছে।

আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। আমরা কিন্তু কখনো ভাবিনি, কল্পনার মধ্যেই ছিল না যে, এমন একটা গণহত্যা হবে। আমরা মিছিল করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য শিক্ষকরা মিছিল করছে, জোহার মৃত্যুর পরে আমরা শোকসভা করছি, কিন্তু আমরা ভাবিনি যে, এমন একটা গণহত্যা হবে।

আমরা একটা লেখক সংগ্রাম শিবির করেছিলাম এবং বাংলা একাডেমিতে ২৩ মার্চ একটা সেমিনার আয়োজন করলাম, বিষয়—ভবিষ্যতের বাংলা। বাংলা স্বাধীন হবে, তার মুক্তি হবে এবং মুক্তির পর তার রূপ কী হবে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম। সে সময় সভাপতিত্ব করেছিলেন আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ্, প্রবন্ধ করেছেন আহমদ শরীফ, মমতাজুর রহমান তরফদার, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বশির আল হেলাল এবং আমি।

এখন আর কেউ জীবিত নেই, শুধু আমি আছি। আমি সেদিন যে কথাটা বলেছিলাম আমার মনে আছে, ভবিষ্যতের বাংলা হবে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা। আমার সেই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলার বক্তব্যটা পূর্বদেশ নামক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

পরে পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ আছে এমন একজন আমাকে জানিয়েছিল যে, পাকিস্তানি গোয়েন্দারা আমরা যা কিছু বলছি লিখছি সবকিছু তাদের নলেজের মধ্যে আছে। তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ২৫ শে মার্চ, আমরা প্রতিদিন ক্লাবে যাই আসলে কী হচ্ছে সেটা জানার জন্য।

২৫ মার্চের ৮টার খবরে শুনলাম যে, আওয়ামী লীগ ২৭ তারিখ হরতাল ডেকেছে। একটা ছেলে দৌড়ে এসে বলল, আর্মিরা আসছে আপনারা সবাই চলে যান। আমরা বাসায় চলে এলাম বিষন্ন মনে। তারপর রাত্রিবেলা শুরু হল সেই ঐতিহাসিক ভয়াবহ কাণ্ড। আমরা থাকতাম জগন্নাথ হলের দেয়ালের এপাশে, ওইপাশে তো ভয়ঙ্কর কাণ্ড চলছে।

আমরা সকালে খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কয়েকটা ছেলে বেঁচে এসেছে, সলিমুল্লাহ হল থেকে, জগন্নাথ হলের দেয়াল টপকে; তারা ভয়ঙ্কর সব বর্ণনা দিল এবং আমরা তাদেরকে বাসায় রাখলাম। আমরা থাকতাম পশ্চিম দিকে এবং পূর্ব দিকে থাকতেন আমাদের আরেক সহকর্মী। তিনি কাঁদতে কাঁদতে আমাদের কাছে এসেছিলেন এবং বললেন, 'এটা আমি কী দেখলাম?' বললাম, 'কী দেখলেন?' তিনি জগন্নাথ হলের ওই দৃশ্যটা দেখেছিলেন।

লোকগুলোকে দিয়ে লাশ টেনে আনছে এবং লাশ টেনে আনার পর প্রত্যেকটা লোককে দাঁড় করিয়ে একজন একজন করে গুলি করে মারছে। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো ছিল এইরকম। আমি এবং আমার স্ত্রী ঘর থেকে দুই সন্তানসহ বেরিয়ে পড়লাম, আমাদের গন্তব্য এক আত্মীয়ের বাসায় ধানমন্ডিতে। কিন্তু আমরা জানি না কীভাবে যাব।

আমরা যাচ্ছি, রক্ত দেখছি, লাশ দেখছি। আমার আত্মীয় বুঝেছিলেন যে আমরা বিপদে আছি, তো তিনি তার গাড়ি নিয়ে আমাদের কাছে আসলেন এবং আমরা তার গাড়িতে করেই চলে গেলাম।

একটা নাটকীয় ঘটনার কথা বলি। আমরা তো আটকা পড়ে গেছিলাম এইখানে। আগস্ট মাসের শেষে। মনিরুজ্জামান মিয়া আর আমি মাঠে বসে গল্প করছিলাম যে, কী করা যায়?

আমরা ঠিক করলাম যে আমরা হবিবুল্লাহ্‌ স্যারের বাসায় যাই। হবিবুল্লাহ্‌ স্যারের বাসায় গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, স্যার আপনি কী করবেন? তিনি বললেন যে, আমি আর ইন্ডিয়ায় যাব না—কারণ ইন্ডিয়া সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। তিনি আগে কলকাতায় ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছিলেন। বর্ধমানে তার বাড়ি, পঞ্চাশ সালের দাঙ্গায় বিতাড়িত হয়ে চলে আসছিলেন। তার ছেলে অক্সফোর্ডে পড়ে, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে অক্সফোর্ডে চলে যাবেন। তিনি বললেন, যদি আপনারা কলকাতায় যেতে চান তাহলে আমার বন্ধু মাসুদ আছে, তাকে চিঠি লিখবেন তাহলে আপনারা সহজেই যেতে পারবেন।

তখন একটা টেলিফোন আসে, হবিবুল্লাহ্‌ সাহেব টেলিফোন রিসিভ করে কথা-টথা বলে আমাদের কাছে আসলেন এবং বললেন যে, খবর আছে। অ্যাক্টিং ভাইস চ্যান্সেলর এফ এম আব্দুল হক আমাদের ছয়জনকে ডেকেছেন।

তখন একজন পিয়ন অনেকগুলো চিঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যার যার বাসায় ডেলিভারি করবে বলে। মুনীর চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিল এবং তখন মুনীর চৌধুরী ফোন করেছিলেন হবিবুল্লাহ্ সাহেবকে। চিঠিতে লেখা আছে যে, ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে কাল সকাল ১০টায় দেখা করতে হবে। বাংলা বিভাগের মুনীর চৌধুরী, এনামুল হক, মনিরুজ্জামান; ইংরেজি বিভাগের আমি আর হবিবুল্লাহ্ সাহেব শিক্ষক সমিতির সভাপতি।

তখন আমরা যত শিক্ষিত ছিলাম, সকলের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছিল আমাদেরকে মারা হবে বলে। কিন্তু, পহেলা সেপ্টেম্বর যখন টিক্কা খান ঢাকা ছাড়ছেন তখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বলেছিলেন যে, এখানে শান্তির একটা পরিস্থিতি দেখাতে হবে। সেজন্য তাদেরকে সতর্ক করলেই চলবে।

Comments