পর্যালোচনা

বঙ্গবন্ধুর তিনটি বইয়ের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আমাদের কম বেশি ধারণা রয়েছে। কিন্তু ২০১২ সালে অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের পর থেকেই লেখক বঙ্গবন্ধুর পরিচয় সামনে আসে। ২০১৭ সালে কারাগারের রোজনামচা, ২০২০ সালে প্রকাশিত হয় আমার দেখা নয়াচীন। 

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আমাদের কম বেশি ধারণা রয়েছে। কিন্তু ২০১২ সালে অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের পর থেকেই লেখক বঙ্গবন্ধুর পরিচয় সামনে আসে। ২০১৭ সালে কারাগারের রোজনামচা, ২০২০ সালে প্রকাশিত হয় আমার দেখা নয়াচীন। 

বইগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু এগুলো রচনা করেছেন কারাগারে বসে। তার রাজনৈতিক জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে জেলখানায়। পাকিস্তান আমলে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাগারে ছিলেন। বন্দী জীবনে তিনি লিখেছেন ইতিহাসের অমূল্য এই স্মৃতিচারণ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর আবার বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়। এই দফার তিনি ২০৬ দিন কারাগারে ছিলেন। সে সময় তিনি নোটখাতায় লিখেন নয়া চীনের ভ্রমণ কাহিনী। ১৯৫২ সালে চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়ে সদ্য বিপ্লবোত্তর  গণচীনের শাসনব্যবস্থা ও জীবনচিত্রের পর্যবেক্ষণের বিবরণ এই ভ্রমণকাহিনী। 

ছয় দফা উত্থাপনের পর ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধু আবার গ্রেপ্তার হন। একটানা ১০২১ দিন কারাগারে থাকার পর উনসত্তরের উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে ২২শে ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। এই দীর্ঘ বন্দী জীবনে তিনি রচনা করেছেন আমাদের ইতিহাসের দুটি আকর গ্রন্থ অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারে রোজনামচা।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন, কলকাতার দাঙ্গা,  দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিধৃত হয়েছে। কারাগারের রোজনামচা ৬ দফা কেন্দ্রিক আন্দোলন, ৬ দফার গুরুত্ব, বঙ্গবন্ধুর বিবিধ ভাবনা ও কারাগারের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র।

এই তিনটি বইয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বিশেষ সাহিত্য পুরস্কার' দিয়েছে ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার-এফওএসডব্লিউএএল। পুরস্কারের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, রাজনৈতিক ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বই তিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি এ এমন এক মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের বয়ান, যে মানুষটি ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছেন, তার দেশের মানুষকে পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তির বন্দরে। একজন রাজনৈতিক নেতা যিনি ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেছিলেন এবং তাঁর জনগণকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর রচিত ট্রিলজি হচ্ছে রাজনৈতিক দলিল এবং ভালবাসা ও সহানুভূতির সাথে লিখিত একটি মানবিক সনদ। একইসাথে আমরা যারা ইতিহাসের ছাত্র তাদের কাছে গ্রন্থ তিনটি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের অনন্য দলিল। 

সেখানে আরও বলা হয়, "স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের মানুষের কাছে 'বঙ্গবন্ধু', আর বিশ্বে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্দোলনে তিনি এক প্রবাদতুল্য নাম। মহাত্মা গান্ধী আর মার্টিন লুথার কিংয়ের মত তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে অন্ধকারের শক্তি, কিন্তু ইতিহাস থেকে তাকে মুছে ফেলার শক্তি কারও নেই।"  

বইগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তাকে যেমন সমগ্র রূপে দেখতে পাই তেমনি পাই বিশেষ রুপে। তার লেখকসত্তার পরিচয় বিস্ময়কর। লেখক বঙ্গবন্ধু কতটা শক্তিশালী পাঠক মাত্রই সেটা উপলব্ধি করতে পারে বই তিনটির পাতায় পাতায়। লেখক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর এই স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিভাষ্যগুলোকে আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে স্মৃতিভাষ্যের অনুবাদগুলো বিদেশী পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে। বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তার বড় বৈশিষ্ট্য তার পরিমিত বয়ান। যেখানে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন আমাদের যাপিত জীবনের বিবরণ। বক্তব্যের মতোই সাবলীল তার ভাষা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতে 'লিখতে যে পারি না' বলে লেখা শুরু করেছেন, এর ভেতরে তার অতিশয় বিনয়ী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী মূলত রাজনৈতিক সাহিত্য। কিন্তু কথা সাহিত্যের বিচারে এটি বাঙালির জ্ঞান-ইতিহাসের নতুন পাঠ। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে এমন গভীরতা-সম্পন্ন ঘটনাবলীর বিবরণ ইতিহাসে তুলনাহীন। আবার যে ইতিহাসের নির্মাতা লেখক নিজেই। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনাপ্রবাহ জানার সবচেয়ে আকরগ্রন্থ এটি। এটি শুধু বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক সংগ্রামের বিবরণ নয়। এদেশের সমাজজীবনেরও আলেখ্য। এটি অসমাপ্ত হলেও আবেদন অপরিসীম। বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর সংগ্রামের সাবলীল আত্মকথন এটি। ইতিহাসের তথ্যসমৃদ্ধ বই আত্মজীবনী নিছক স্মৃতিকথার সীমানা পেরিয়ে রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনন্য অনুপম ভাষ্য হয়ে উঠেছে। 

কারাগারের রোজনামচা অনেকটা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতোই। দুটির পার্থক্য হলো প্রথমটি সন তারিখের ধারাবাহিকতায় জীবন-কাহিনী বর্ণনা দ্বিতীয়টি বন্দি মুজিবের স্মৃতিচারণ। যেখানে সময় ও পরিস্থিতির বৈচিত্র্যে ব্যাপ্ত লেখকসত্তা। 'তখন সমস্ত পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান তো একটা বড় কারাগার'। (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১১৭)। সেই কারাগারের বন্দী প্রকোষ্ঠে মুজিব লিখেছিলেন ছয় দফার সময়কার বন্দী জীবনের বিবরণ। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বসে ইতিহাসের যে বিবরণ রোজনামচায় তুলে ধরেছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। বিশেষ করে ৭ জুনের আগের ও পরের কয়েকদিনের সরকারি নির্যাতনের, গ্রেপ্তারের যে বিবরণ তিনি কারাগারে থেকে দিয়েছেন তা ইতিহাসের উৎস হিসেবে অমূল্য। কারাগারে বসে আত্মপ্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, দাবি যখন হয়ে পড়ে জনগণের জন্য, তখন জনগণই এটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। জনগণের চাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও দাবানো যায়নি। 
ছয় দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়। চলে এলেন একেবারে সম্মুখে। রওনক জাহান লিখছেন, 'শেখ মুজিব তখন সবকিছু তার কাধে তুলে নিলেন। ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং একজন অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ৭০ এই চার বছরে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। ছয় দফা আন্দোলন তাকে সাহায্য করলো বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন প্রতীক হয়ে উঠতে'।

কারাগারে বসেই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বাঙালি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উঠতি ব্যবসায়ী, ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ বুদ্ধিজীবী সকলের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়। রোজনামচার পরতে পরতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর সেই আত্মবিশ্বাস।  
কারাগারের রোজনামচার ভূমিকার সমাপ্তিতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'এ ডায়েরি পড়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার উৎস খুঁজে পাবেন'। শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণের বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়। সাধারণের নেতায় পরিণত হওয়াটি বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল। ফলে জনগণের বিশ্বাস জন্মেছিল বঙ্গবন্ধু পারবেন। তার বহিঃপ্রকাশ পরবর্তীতে দেখা যায় সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে কিংবা ৭ মার্চে। সর্বোপরি জনগণের এই বিশ্বাস একাত্তরের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল। যেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমাদের সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের যে সময় চীন ভ্রমণ করেন সে সময়ে নয়াচীনের বয়স মাত্র ৩ বছর। বঙ্গবন্ধুর বয়স মাত্র ৩২ বছর। সমাজতাত্ত্বিক বিপ্লব শেষ করে একটি নতুন কাঠামোর দেশ শুরু করেছেন মাও সে তুং। এটাকে বঙ্গবন্ধু বলছেন নয়াচীন, এই ভ্রমণে বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে চীনকে দেখেছেন। পরিবর্তনশীলতার চেহারাটা মনে রেখেছেন এবং দু বছর পর যখন জেলে গেছেন তখন স্মৃতি  থেকে তিনি লিখেছেন আমার দেখা নয়াচীন।
একমাত্র জাতীয়তাবাদী নেতার দৃষ্টিতে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত একটি কমিউনিস্ট সরকার কেমন তার একটা দুর্বার বিবরণ পাওয়া যায় এই বইয়ে। ভ্রমনকাহিনীতে লেখক তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প ও রাজনীতি। আমরা যে চীনকে চিনি কিংবা জানি বঙ্গবন্ধু তার বিকল্প বয়ান এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।

বঙ্গবন্ধুর এই তিনটি বই একদিকে লেখক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে এগুলো ইতিহাসের নির্মোহ দলিল। সার্ক সাহিত্য পুরস্কার তার লেখক সত্তার স্বীকৃতি। যেটি বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তার আন্তর্জাতিক প্রসারে ভূমিকা রাখবে। তিনটি বই সুখপাঠ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ। সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের দলিল। একজন রাজনীতিবিদ ও ঘটনার মূল চরিত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বয়ানে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিবরণ পাওয়া যায়। এ গ্রন্থ আমাদের বাংলা গদ্যের এমন এক সরল মাটিঘেঁষা রুপের সন্ধান দেয়, যা একান্তই পূর্ববঙ্গের কথ্যভঙ্গির বিশেষ প্রকাশ বলে আমরা ধরে নিতে পারি। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু চোখ রেখেছেন জগতের নানা দিকে। খুঁটিনাটি নানা বৃত্তান্ত এবং নিজের অনুভবের সারাৎসারে তাঁর প্রতিটি বই হয়ে উঠেছে অনন্য। সেলিনা হোসেন লিখেছেন, 'এ বইগুলোতে কেবল একজন রাজনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, লেখকের দায়বোধও ফুটে উঠেছে। ফলে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শিল্পের সুষমা- এটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বইয়ের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা'।
 

Comments