কবিগুরুর সাহিত্যে শাহজাদপুরের জীবন-প্রকৃতির প্রতিফলন

শাহজাদপুর
শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি। ছবি: স্টার

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পোস্টমাস্টার'র অন্যতম চরিত্র রতন। সাহিত্যের চরিত্র হলেও গবেষক ড. আব্দুল আলিমের দাবি এটি কাল্পনিক চরিত্র নয়। রতনের অস্তিত্ব বেশ কয়েক বছর আগে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে।

সময়ের পরিক্রমায় রতনের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তবে কবিগুরুর রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখবে—এমনটিই মনে করেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক ড. আব্দুল আলিম।

শুধু 'পোস্টমাস্টার' বা রতনই নয়, শাহজাদপুর ও এর আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের জীবন ও প্রকৃতি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্মে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে বলে জানান তিনি।

কবিগুরু তার পারিবারিক জমিদারির দেখভালের জন্য বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের (তৎকালীন পাবনা) শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর এলাকায় বার বার ভ্রমণ করেছেন। সেসব এলাকায় আছে বিশ্বকবির পদধূলি, গড়ে উঠেছে কাছারিবাড়ি।

শাহজাদপুর
শাহজাদপুরে রবীন্দ্র জাদুঘর। ছবি: স্টার

তবে, কবিগুরুর কাছে শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িটি বেশি প্রিয় ছিল। তিনি এখানে বার বার এসেছেন। এখানকার জনমানুষের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন আত্মার সম্পর্ক, পেয়েছিলেন সাহিত্য রচনার অনুপ্রেরণা।

কবিগুরুর সাহিত্যকর্মে শাহজাদপুরের বিরাট ভূমিকা আছে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে কবিগুরু শাহজাদপুরের গুরুত্ব তুলে ধরে তার ভাতিজি ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'আমি এখানে (শাহজাদপুরে) লেখার এমন অনুপ্রেরণা পাই যা অন্য কোথাও পাই না।'

ড. আব্দুল আলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কবিগুরুর ছিন্নপত্রে শাহজাদপুরের মানুষ ও এ অঞ্চলের প্রকৃতির বিশদ বিবরণ আছে। তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম "সোনার তরী"তে জীবন ও প্রকৃতির যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার প্রায় পুরোটাই শাহজাদপুরে কবিগুরুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে।'

ঐতিহাসিকদের মতে, কবিগুরুর দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪০ সালে নাটোরের রানি ভবানীর কাছ থেকে শাহজাদপুরের জমিদারি কেনেন। পরে উত্তরাধিকার সূত্রে তা কবিগুরুর উপর ন্যস্ত হয়।

কবিগুরু জমিদারি দেখভালের জন্য ১৮৯০ সালে প্রথম শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িতে আসেন।

১৮৯৭ সাল সাল পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকবার জমিদারি দেখভালের জন্য আসলেও শাহজাদপুরের প্রকৃতি ও এ অঞ্চলের জনজীবন তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে।

এখানকার নদী, ফসলের মাঠ, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ইত্যাদি কবিকে সাহিত্যকর্মে উদ্বুদ্ধ করে, যার প্রমাণ তিনি তার সাহিত্যে রেখেছেন। শাহজাদপুরে কবিগুরুর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে 'বিসর্জন', 'সোনার তরী', 'চিত্রা', 'চৈতালি', 'গোলাপগুচ্ছ', 'ছিন্নপত্র', 'পঞ্চভূতের ডায়েরি'সহ বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।

শাহজাদপুর
কবিগুরু ১৬২তম জন্মবার্ষিকীতে বর্ণিল সাজে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি। ছবি: স্টার

লেখক ও গবেষক হাবিবুর রহমান স্বপন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু সাহিত্য কর্মই নয়, বরং এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কবির ছিল নিবিড় যোগাযোগ। কবিগুরু তার জমিদারি এলাকার প্রজাদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের সমস্যাগুলো মন দিয়ে শুনতেন এবং সেসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতেন।

এ অঞ্চলের দুধ-ঘি কবির খুব প্রিয় ছিল বলে তিনি কৃষকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে তার জমিদারি থেকে ১২০০ একর জমি গো-চারণ ভূমির জন্য দান করেন। কবিগুরুর সেই উদ্যোগের কারণেই ঐতিহাসিকভাবে শাহজাদপুর এলাকা দেশের অন্যতম প্রধান দুগ্ধসমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছে বলে জানান স্বপন।

কৃষক ও প্রজাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কবিগুরু এখানে গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেন বলেও জানান তিনি।

শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আবু সাইদ ইনাম তানভিরুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কবিগুরুর স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার ইতোমধ্যে কাছারিবাড়িটিতে রবীন্দ্র জাদুঘর গড়ে তুলেছে।'

কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ প্রায় ৩৩১টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই জাদুঘরে আছে। এছাড়া ২০টি দুর্লভ চিত্রকর্মও এখানে আছে।

প্রতি বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী ২৫ বৈশাখে উৎসবে মাতে কবিগুরুর স্নেহধন্য শাহজাদপুর এলাকার মানুষ। এ বছর কবিগুরুর ১৬২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার থেকে ৩ দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন।

জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট শামসুল হক টুকু প্রধান অতিথি হিসেবে উৎসবের উদ্বোধন করবেন। উৎসবে জাতীয় পর্যায়ের ও স্থানীয় শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনা করবেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

কবিগুরু ১৬২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি।

Comments

The Daily Star  | English

Govt scraps Cyber Security Act

The decision has been taken in a meeting at the Chief Adviser's Office in the capital's Tejgaon area.

6m ago