কেন কবির মন ভালো থাকে না

যখন কবির দরবারে হাজির হই ঘড়ির কাঁটা মধ্যাহ্নে। কবি থাকেন রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় একটি হোটেলে। সেখানেই দীর্ঘদিনের আবাসন-ঘর-সংসার একাকী জীবন এবং কবিতাযাপন।
দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে কবি হেলাল হাফিজকে জন্মদিনে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। ছবি: ইমরান মাহফুজ

কবির মন ভালো নেই। অথচ সকাল পেরিয়ে দুপুর। বিকেল বলছে আসি আসি। বৃষ্টি হয়নি একটু। গত দুদিন, কিংবা ক'দিন ধরেই বেহায়া স্বভাব পেয়েছে বৃষ্টিকে। কোনো নোটিশ ছাড়াই, মুখ কালো করে হাজির হচ্ছে। সেই তুলনায় আজ শনিবারের দিনটা কতই না ভালো! আলো ঝলমলে এক রোদেলা দিন। তবুও মন ভালো নেই কবি হেলাল হাফিজের।

আজ কবির ৭৬তম জন্মদিন। ফুরফুরে থাকার কথা মন ও মেজাজ। লেখার কথা আরও কিছু অমর পঙক্তির। যেমন লিখেছিলেন একদা, এক. 'নিউট্রন বোমা বোঝো,/ মানুষ বোঝো না', দুই. 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।' তিন. আর কে দেবে আমি ছাড়া/ আসল শোভন কষ্ট,/ কার পুড়েছে জন্ম তেকে কপাল এমন/আমার মত ক'জনের আর/ সব হয়েছে নষ্ট,/ আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট। তিন. লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম/ ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়/ আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই/ দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।/কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।' মানবতাবোধ, দেশপ্রেম, প্রণয় ও প্রীতির জয়গাঁথা কবি হেলাল হাফিজের মতো উদ্দাত্ত কণ্ঠে কে আর বলতে পেরেছেন? মিছিলে যাবার জন্য, যুদ্ধে যাবার জন্য বুক চিতিয়ে এমনতর আহবান আর কোন কবির কণ্ঠে কি আমরা শুনেছি? কবির আহবান বইয়ের পাতা থেকে দেয়ালের বাণী হয়ে আমাদের হৃদয়েও জায়গা করে নিয়েছে। এক জীবনে একজন কবির জন্য এর চেয়ে আর কী পাওয়ার থাকতে পারে? তবুও কেন কবির মন ভালো নেই?

যখন কবির দরবারে হাজির হই ঘড়ির কাঁটা মধ্যাহ্নে। কবি থাকেন রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় একটি হোটেলে। সেখানেই দীর্ঘদিনের আবাসন-ঘর-সংসার-একাকী জীবন এবং কবিতাযাপন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটক 'রক্তকরবী'তে বলেছেন, 'মধ্যাহ্নসূর্যের কোনো সঙ্গী থাকে না'। এমনকি ছায়াও প্রায় লয়প্রাপ্ত হয়, যুৎ করতে পারে না মোটেই। কিন্তু আলো ছড়ায়, তীব্রভাবে। সে আলোয় আগুন হয়ে ওঠে চারপাশ। যে আগুনে পরশমণির দেখা মেলে। হোটেলের টিভিরুমে কবিকে দেখে যেমন মধ্যাহ্ন সূর্যের কথা মনে হয়, সঙ্গী নেই যার। আগুনের পরশমণির কথা মনে পড়ে, যে পরশমণির বাস হেলাল হাফিজের কবিতায়, 'যে জলে আগুন জ্বলে' আর 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' কাব্যগ্রন্থের মায়াবী জগতে।

লিফট থেকে নেমেই আমাদের চোখ পড়ে কবির প্রতি। টিভি রুমে বসে আছেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান খেলা চলছে। কবির চোখ কখনো টিভির পর্দায়, কখনো মোবাইলের স্ক্রিনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২৬৫ জন কবিকে ট্যাগ করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তখনো কেউ ফুল কিংবা কেক নিয়ে এসেছেন কি না পরিষ্কার নয়। আঁচ করা কেবল সব ভালবাসা, শ্রদ্ধা, প্রীতি, মুগ্ধতা সবই আটকে আছে ভার্চুয়ালি, বাস্তবের জগতে নয়। অথচ শাহবাগ থেকে প্রেসক্লাব, বাংলা একাডেমি কতদূর? কতদূর আমাদের বই পাড়া, বাংলাবাজার, বাংলামোটর, কাঁটাবন আর আজিজ মার্কেট। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কবির জন্মদিনেও কি একটু খবর নেওয়ার, একটা গোলাপ কিংবা একটা রজনীগন্ধার শুভেচ্ছা জানানোর সময় হয় না? নাকি আমরা সেই সংস্কৃতির চর্চা এখনও করে উঠতে পারলাম না। এক পা এগিয়ে কথা বলছে না, দেখা দিচ্ছে না। অধরা আকাশের মতো নগরের সম্পর্ক। কেমন হতো যদি টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠতো এরকম একটি বাক্য, কবি হেলাল হাফিজের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। কেবল মৃত্যুতে শোক জানানোর রেওয়াজেই কি আটকে থাকব আমরা?

জন্মদিনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি'। কখন এমন কথা বলেন একজন মানুষ, ভেবেছেন? কবির জন্মদিন, অথচ পরে আছেন কালো টি শার্ট আর সাদা লুঙ্গি। খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি, শেভ করেননি কমপক্ষে দুদিন। আমরা ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে কবিকে ফুল ও কেক দিয়ে শুভেচ্ছা জানাই। কুশল বিনিময় হয়। আলাপে কবি খুশি হন—আনন্দের আভাস মেলে চোখেমুখে। ফুল নেন প্রসন্নচিত্তে, মৃদু হাসির আবেশ ছড়িয়ে। কিন্তু সেসবের কোনটাই স্থায়ী হয় না কয়েক মিনিটের জন্যও। কবিকে উদাস মনে হয়। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না জানি, কিন্তু তারও অধিক খারাপ কি কবির মন? যে মনে রয়েছে মানুষের প্রতি পক্ষপাত, দেশের প্রতি ভালবাসা আর কবিতার প্রতি উৎসর্গকৃত এক জীবন। যে মন সব হারিয়ে-সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে কবিতাকেই দিয়েছে বুকের জমিন আর হৃদয়ের সকল উষ্ণতা। সেই মন ভালো নেই। স্বল্পকথাপ্রিয় কবি কারণও বলতে চান না। লাজুক হাসিতে আড়াল করতে চান মন খারাপের অনুষঙ্গ।

কথা প্রসঙ্গে আর আলাপের আলপথ ধরে কবি বলেন। রাজনীতিতে তিনি কোনদিনই আগ্রহী বা সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু কবি হিসেবে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। রাজনীতি ছিল পরিষ্কার বোঝা পড়ো। আমরা বুঝে উঠি কবির মন খারাপের কারণ। কবির মন খারাপ এই দেশ নিয়ে-এই রাষ্ট্র নিয়ে, বাংলাদেশ নামক দেশটির আগামীর দিনগুলো কেমন যাবে, কীভাবে যাবে, সেই ভাবনায়।

কবির একার জীবন দেখে যে কারও মনে হতে পারে, এখানে সমষ্টির দায় নেই, প্রাত্যহিক জটিলতা এখানে উদিত হয় না কখনোই। ব্যাপারটা তেমন নয়, বরং সমগ্রর কষ্ট-বেদনা-অপ্রাপ্তি-বঞ্চনা আর রাষ্ট্রের অনাচার কবিকে আহত করে, নীরব কষ্টে নীলকণ্ঠ করে। এই শহরে বৃষ্টি নামলেই ঘরে ফেরা হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। আধা ঘণ্টার রাস্তা পেরোতে লাগে আড়াই ঘণ্টা। ডেঙ্গুতে চব্বিশ ঘণ্টায় মারা যায় নয় জন। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, রিজার্ভ কমছে। এসব মন্দ খবর কবিকে আহত করে। সকলের দুঃখ-কষ্ট ভর করে কবির মনে। তখন তিনি আর একা থাকেন না, এক-এর মাঝেই ধারণ করেন সবাইকে, গোটা বাংলাদেশকে। এ কারণে বাংলাদেশ খেলায় জিতলে যেমন আনন্দ পান, হারলে তেমনি কষ্টরা এসে ম্রিয়মাণ করে। এই দেশের ভালো-মন্দ সবকিছু এখন উনার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে গ্লুকোমায় চোখে দেখতে সমস্যা হলেও টিভি পর্দায় খেলাটা দেখেন, কষ্ট হলেও এই আনন্দটুকু হারাতে চান না। আবার পত্রিকায় পাতায় চোখও বুলান। জানতে চান কেমন আছে দেশটা, কেমন আছি আমরা?

আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর কবিকে করেছে বেদনাহত। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন নরওয়ের লেখক ইয়ন ফসে। সে খবরও রাখেন তিনি। বোঝা যায়, সব ব্যাপারেই কবি অনুসন্ধানী কিন্তু নীরব পাঠক। সুক্ষ্মদর্শী চেতনা, পাঠাভ্যাস আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুঁ মারার কল্যাণে কবি সব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। যা কবির মনকে আদ্র করে, উদ্বিগ্ন রাখে সারাক্ষণ। এই অক্টোবর নিয়ে তিনি শঙ্কিত। কী হবে, কী হতে যাচ্ছে দ্বিদলীয় রাজনীতির টানাপোড়েনে। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। কিন্তু পান না। যেটুকু পান তাতে নতুন প্রশ্ন এসে হাজির হয়। পরিস্থিতি কি আরও উত্তপ্ত হবে? দেশ কি আরও সংঘাতের দিকে যাচ্ছে? রিজার্ভ পরিস্থিতির কী আরও অবনতি ঘটবে? তা হলে কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে এই দেশের সামনের দিনগুলোতে? এই সব প্রশ্নের উত্তর তালাশ করে ফিরছে কবি হেলাল হাফিজের মন।

এ কারণে জন্মদিনেও কবির মন ভালো নেই। যে কবির ঘর নেই, বাড়ি নেই, নেই বারাম খানা। সেই কবি এই সময়ের বাংলাদেশে একজনই। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। তিনি দেশের চিন্তায়, দেশের সংকটে বিপর্যস্ত, ভুলে গেছেন জন্মদিনের আনন্দের কথা, উদযাপনের নিরন্তর অভ্যাস। কারণ তিনি জানেন, ঘর-বাড়ি-বারামখানা মুখ্য নয়, মুখ্য হলো দেশ, কবির জন্য দেশই মুখ্য, আর সব গৌণ। এ কারণে দেশের সংকটে, অমানবিকতায়, অনৈতিকতায়, অন্যায্যতায় তিনি উদ্বেলিত হন, জন্মদিনকেও গৌণ জ্ঞান করেন। কারণ, কবি হেলাল হাফিজের প্রত্যয় ও প্রতীতি হলো, 'কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Govt to form commissions to reform 6 key sectors: Yunus

The commissions are expected to start their functions from October 1 and they are expected to complete their work within the next three months, said Chief Adviser Prof Muhammad Yunus in his televised address to the nation

2h ago