স্বৈরাচার বিরোধী কবিতায় যে কবি খ্যাতিমান
সকল কবির 'সিগনেচার' কবিতা থাকে না, কারও কারও থাকে। মোহাম্মদ রফিকের ছিল। নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার পাঠকমাত্র মনে পড়ে, 'খোলা কবিতা'র কথা। রবীন্দনাথ ঠাকুরের নাম উচ্চারিত হলে 'সোনার তরী', কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী', জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন', জসীমউদদীন নাম আওড়ালেই 'কবর' যেমন হাজির হয়; মোহাম্মদ রফিক বলা মাত্রই 'খোলাকবিতা' বিদ্যুৎ চমকের মতো তরঙ্গায়িত হয় এবং সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত।
সিগনেচার মানুষের নিজস্ব। কিন্তু 'সিগনেচার' কবিতা কবির নিজস্ব না। কারণ কোন কবিই জানেন না উনার কোন্ কবিতা সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশেষ এক মর্যাদা নিয়ে আবির্ভূত হবে। পাঠক আবিষ্কার করে 'সিগনেচার পোয়েম', উষ্ণীষ দেয় ভালবেসে-হৃদয়ে ধারণ করে। প্রশ্ন হল, এই নির্মাণ বা নির্মিতি কি একজন কবির পরিসরকে সীমিত ও বৃত্তবন্দী করে? মোহাম্মদ রফিকের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তর না। অন্তত উনার ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা বা সংশয়ের অবকাশ নেই।
মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বিষয় বহুমুখী ও বিচিত্রগামী, যা আয়ত্ব করা কেবল একজন শক্তিশালী কবির পক্ষেই সম্ভব। যিনি ইহজাগতিকতায় ছিলেন আশি বছরের মতো, চুরাশির জীবনচক্র পূরণ হয়নি কয়েক বছরের জন্য। জন্মেছিলেন খ্রিস্টাব্দ ১৯৪৩ এর ২৩ অক্টোবর। চিরপ্রয়াণ ঘটে ২০২৩ এর ৬ আগস্ট। এক অর্থে কবি ছিলেন ত্রিকালদর্শী। জন্ম ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অবিভক্ত বঙ্গের পূর্বাংশে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল, বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত দুই শক্তি অক্ষ ও মিত্রের তকমায়। পরাধীন ভারত চূড়ান্তভাবে জেগে উঠেছে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষায়। অবিভক্ত বঙ্গে তখন এসবের পাশাপাশি চলছে দুর্ভিক্ষের মারণথাবা। '৪৩ এর মন্বন্তরে বিপর্যস্ত সাধারণ, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের রীতিমতো মরণদশা। এসব ঘটনা ও পরিস্থিতির মধ্যে স্বাধীনতা এলো, ভারত ভাগ হল আর বঙ্গকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে বাটোয়ারা করে দেয়া হল।
তার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গ যখন সামনে এলো পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, এই স্বাধীনতা তাদের জন্য বিভ্রম বিশেষ। বাঙালি মুসলমান ১৯১১ তে বঙ্গ ভঙ্গ রদে মনে করেছিল তাদের দেশ হাতছাড়া হয়ে গেছে। তারা নিজ ভূমে পরবাসী হয়েছে। এ কারণে ১৯৪৭ এর স্বাধীনতাকে বাঙালি মুসলমান দেখেছিল তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাইলফলক-যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে। কিন্তু ১৯৪৮ থেকেই তাদের ধন্ধ শুরু হল এবং ১৯৫২ তে স্পষ্ট হয়ে গেল যে তারা এক উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে আরেক উপনিবেশের যাঁতাকলে পড়েছে। তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আদতে কোন স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। বাঙালি মুসলমানের ঘরে ফেরাও সম্পন্ন হয়নি। সঙ্গত কারণেই শুরু হল ঘরে ফেরার লড়াই।
দ্বিজাতিতত্ত্বের দোহাই দিয়ে ভারত ভাগ হল। হিন্দু মুসলমানের একত্রিত বসবাস সম্ভব নয় প্রমাণ করতে জন্ম দেয়া হল ভয়াবহ দাঙ্গার। এসবের মধ্যে দিয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম অংশকে ভারতের সঙ্গে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব অংশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা হল। এভাবে দেশভাগের ফলে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটল। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা পূর্ববঙ্গে আর ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ নির্যাতন ও হতাহতের শিকার হল। তার পরও বাঙালি মুসলমানের ঘরে ফেরা সম্পন্ন হল না। এইসব দেখে-শুনে-বুঝে মোহাম্মদ রফিকও শামিল হলেন বাঙালি মুসলমানের ঘরে ফেরার লড়াইয়ে। কবিতাকে করে তুললেন ঘরে ফেরার লড়াইয়ের মন্ত্রবিশেষ।
ষাটের দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার অভিযোগে পাকিস্তানের সামরিক আদালত মোহাম্মদ রফিককে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রথমে ১ নম্বর সেক্টরে এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করেন। ইংরেজি সাহিত্যে বিদ্যায়তনিক পর্ব শেষ করে পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন চাকরি জীবনের প্রায় পুরোভাগ। বাঙালি মুসলমানের কাছে যেটা ছিল স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের লড়াই।
মোহাম্মদ রফিকের কাছে সেটা ছিল নিজের কাছে ফেরা-আপন শেকড়ে ফেরার নিরন্তর কোশেশ। উনার সকল কবিতা, মননশীল লেখালেখি এবং স্মৃতিগদ্যতে তার প্রকাশ ঘটেছে সর্বেবভাবে। 'খোলা কবিতা'র পুরো বিষয়, বক্তব্য, ভাষাভঙ্গি এবং অভিমুখের এষণায় স্পষ্ট হয় কবির শেকড়ে ফেরার আকাঙ্ক্ষাসমূহ। কয়েকটি পঙক্তিতে সেই সাক্ষ্যই উপস্থাপিত হয়েছে শব্দের অনুপম ব্যবহারে, 'লোহার গরাদ ফেটে টগবগ আষাঢ়ী পূর্ণিমা/কলমির ঘ্রাণে মুগ্ধ বিলের ওপরে দৃপ্ত পায়ে/ফাঁসির দড়িতে ঝোলে হাসির জোয়ারে ভাঙা বাঁধ;/কপিলা, কাদায় জলে ঘামে শ্রমে অন্নদা স্বদেশ/# সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;/বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই;/# হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে তৃতীয় বিশ্বে ও গঞ্জে গাঁয়ে/হুট করে নেমে আসে জলপাই লেবাস্য দেবতা;/ পায়ে, কালোবুট; হাতে, রাইফেলের উদ্ধত সঙ্গিন;/# লোলুপ দুর্নীতিবাজ অপদার্থের দারুণ কামড়ে/ অনুর্বর মাঠ-ঘাট, ছিন্ন ভিন্ন সমাজ- কাঠামো, রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুঁজিবাদী কালো থাবা লাল রক্ত ঢালে;/# এইবার ইনশাআল্লাহ সমস্যার যথাযথ/ সমাধান হবে; দীন গরীবের মিলবে বেহেস্ত;/ জলপাই লেবাস্য দেবতা অবিশ্বাস্য বাণী ঝাড়ে; (খোলা কবিতা)
এই কবিতার মূল স্বর স্বৈরাচার বিরোধীতা, সামরিক জান্তার কবি হওয়ার অনৈতিক ও অবৈধ খায়েশের ওপর চপেটাঘাত। কিন্তু যদি আমরা কেবলই এরকম গুটি কয়েক শব্দে এই কবিতার সামগ্রিক আবেদনকে বেঁধে ফেলতে চাই, সেটা যৌক্তিক হবে না। এই কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি স্বৈরাচারের প্রতি যেমন জিঘাংসা ছুঁড়ে দিয়েছেন, তেমনি গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় একজন কবির-বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা কী হওয়া উচিৎ তার ইশতেহারও হাজির করেছেন।
মোহাম্মদ রফিকের কবিতার জগত বৃহৎ ও বহুধাবিস্তৃত। কোনো কোনো কবিতা পাঠের সময় আমাদের মনের আরশিতে অন্য কবি এসে হাজির হয়। এটা কবির দুর্বলতা নয়। বরং শক্তি বলেই প্রতীয়মান হন। যখন কোনো কবি কোনো একক কবির বৃত্তে ঘুরপাক খান তখন সেটা হয়তো দুর্বলতা বলে শনাক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু যখন উনাকে পাঠ করতে গিয়ে এক এক সময় এক এক জন কবিসত্তা কিংবা কোন পঙক্তি নিউরনে তরঙ্গা তুলে, তখন ধরে নিতে হবে এই কবির ভ্রামণিক শক্তি তুলনারহিত। এবং এভাবে ভ্রমণ শেষে তিনি মূলত নিজের স্বর নির্মাণ করতে চেয়েছেন-করেছেন এবং নোঙ্গর রেখেছেন নিজের কাছে ফেরার প্রেম ও প্রতীতিতে।
মোহাম্মদ রফিকের 'খোলা কবিতা' পাঠে কখনো কখনো কি রফিক আজাদের 'ভাত দে হারামজাদা' কবিতা উঁকি দেয় নীরবে-নিঃশব্দে? বিশেষ করে এই দুই পঙক্তির সঙ্গে, 'সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;/বন থেকে দাঁতার শুয়োর রাজাসনে বসবেই;' রফিক আজাদের এইক'টি পঙক্তি, 'আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ/ ভাত দে হারামজাদা,/ তা না হলে মানচিত্র খাবো।' (ভাত দে হারামজাদা)।
আবার মোহাম্মদ রফিকের এই দুটি কবিতা পাঠ করার পর কী মনে হয় আমাদের? উদাহরণ-এক. : 'তথাগত সেই রাতে কী দেখিলে তুমি/ তোমার সন্তান আর দয়িতার মুখে!/ জীবনের সব স্রোত বিষাদ বিরহ/ সেখানে কি মিশেছিল অকরুণ প্রেমে!/ সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল এমনি প্রতারক/ অথবা আকাশ ছিল স্নিগ্ধ মেঘে স্নাত!/# কী দেখেছিলে আকাশে নিঃসঙ্গ প্রান্তরে/ সে রাতে নদীর জল ছড়ায়নি তার/ চলার আবেগে সুরধুনি!/# সব পাখি ফিরে/ গিয়েছিল নীড়ে!# দু-একটি বৃক্ষের/ পাতায় তখন/ ঝরেনি কি বাতাসের প্রেম!/# তবু কী দেখিলে তুমি নীরব নির্জন/ সেইক্ষণে, রাতের দুপুরে? সেদিনও এমনি/ সব কিছু শুনেছিলে; - মৃত্যু জরা প্রেম/ মানুষের ব্যর্থতার হাসি, বাতাসের স্রোতে!' (বৈশাখী পূর্ণিমা- ২)।
উদাহরণ-দুই. : 'আজ রাতে দেখি আমি তন্দ্রায় বিবশ সবে,/ পাখিদের কোলাহল বৃক্ষের মর্মর/কী এক বৈদেহী সুরে/ বিভাসিত চরাচর চাঁদ আর তারার প্রণয়ে/ #সুগত দু-চোখে শুধু/ কেন বার বার এই কান্না ফিরে আসে/ভরে তোলে আমার হৃদয়!/ পাহাড়ের মতো কেন আমাকে ছাপিয়ে ওঠে!/ # ব্যথা নেই জ্বালা নেই কোথায় কান্নার উৎস!' (বৈশাখী পূর্ণিমা)।
এই দুটি কবিতা পাঠের পর অন্য কোন কবি কিংবা কবিতার কথা মনে পড়ে না আমাদের ? জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন' কি হাজির হয় না, নিশ্চয় হয়। জীবনানন্দের এই সব পঙক্তি যেন মোহাম্মদ রফিকের কবিতার হাহাকার আর নৈঃসঙ্গ চেতনার রেশ ধরে করোটিতে নিজেদের উপস্থিতি জারি করে। 'জানি-তবু জানি/ নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;/অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়-/আরও এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে/আমাদের ক্লান্ত করে;/ ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;/লাশকাটা ঘরে/ সেই ক্লান্তি নাই;/ তাই/ লাশকাটা ঘরে/ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের' পরে।' (আট বছর আগের একদিন/জীবনানন্দ দাশ)।
মোহাম্মদ রফিকের প্রিয় কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অথচ উনার কবিতার ভেতর বাইরে এবং শরীরে সমর সেনের উপস্থিতি দুর্লক্ষ্য নয়। মোহাম্মদ রফিক লিখছেন : 'দূরে কোনো উদাসীন মাঠের প্রদেশে/ পরিত্যক্ত দেবালয় বিরহিণী সন্ন্যাসীর মঠ/বার বার হাতছানি দেয়/ ডাক দেয় আমার গভীরে, আলোড়িত হই শুধু! আর কিছু নয়!/আমি কি কখনো যাব অই কালিন্দীর কূলে/ অথবা এসব শুধু রাতের আবেশ!' (বৈশাখী পূর্ণিমা)।
সমর সেন লিখেছেন : 'চোরাবাজারে দিনের পর দিন ঘুরি।/ সকালে কলতলায়/ ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,/খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ শুনি;/মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভাবে কী যে ভাবি- / হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি;/ আর শহরের রাস্তায় কখনো প্রাণপণে দেখি/ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক।/আর মদির মধ্য রাত্রে মাঝে মাঝে বলি/মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,/ পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো/ হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।/ কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে/ সকালে ঘুম ভাঙে/আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে/বণিক-সভ্যতার শূন্য মরুভূমি।' (একটি বেকার প্রেমিক/সমর সেন)।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল, সমর সেনের জন্ম অক্টোবরে মৃত্যু আগস্টে। কী আশ্চর্য মোহাম্মদ রফিকেরও জন্ম-মৃত্যু মাস একই। সমর সেন বেঁচেছিলেন ৭১ বছর। নাতিদীর্ঘ এই জীবনে কাব্য সাধনা করেছেন মাত্র ১২ বছর। গ্রন্থসংখ্যা পাঁচ এক. কয়েকটি কবিতা, দুই. গ্রহণ, তিন. নানা কথা, চার. খোলা চিঠি এবং পাঁচ. তিন পুরুষ।
মোহাম্মদ রফিক 'খোলা কবিতা' লিখেছেন ১৯৮৩ সালে। সমর সেন খোলা চিঠি লিখেছেন ঠিক তার চার দশক আগে ১৯৪৩ এ। তখন বাঙালি খুঁজছিল তার শেকড়ের ঠিকানা, স্বদেশের মানচিত্র আর স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের অধিকার। চার দশক পর খ্রিস্টাব্দ ১৯৮৩ তে বাঙালির স্বাধীনতা মিলেছে, স্বদেশে ফেরাও হয়েছে। কিন্তু নিজের শেকড়ে ফেরার লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি। কারণ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। ন্যায্যতা ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। নিজের কাছে ফিরতে হলে দেশ ও জাতিকে যে নির্মাণ ও নির্মিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তার অনেককিছু তখনও অধরা রয়ে গেছে। একারণে মোহাম্মদ রফিক জারি রেখেছিলেন শেকড়ে ফেরার লড়াই। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন লক্ষ্যভেদী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।
সক্রেটিসের 'নো দাইসেলফ' সম্পর্কে মোহাম্মদ রফিকের নিজস্ব বয়ান রয়েছে, যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে পুঁজিবাদের ধূর্ততা ও কৌশলের নানারূপী ছলাকলা। কেন এই স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসা হল, কারণ এই স্লোগান ব্যক্তিকে ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে। সমষ্টি হয়ে উঠতে বাধা দেয়। অথচ সমষ্টি হয়ে ওঠা ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। আর সমষ্টি হয়ে উঠতে হলে আমাদেরকে নিজের কাছে ফিরতে হবে এবং নিজেদেরকে একে অপরের বন্ধনে জড়াতে হবে। মোহাম্মদ রফিকের নিজের কাছে ফেরার আকাঙ্ক্ষা ছিল মূলত সমষ্টি হয়ে ওঠার সাধনা। যে সমষ্টির মধ্যে কেবল ব্যক্তি নয়, কেবল মানুষ নয় প্রকৃতি ও পরিবেশের সকলের সংহত ও সুসম অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব।
এ কারণে কবির পরিভ্রমণে নানা জনের নানা মাত্রার উপস্থিতি থাকলেও সেসব মাত্রাকে তিনি সাঙ্গীকরণ কেবল করেননি আত্তীকরণ করেছেন নিজস্ব স্বর ও সুরে। এ কারণে মোহাম্মদ রফিকের নিজের কাছে ফেরা কেবল একার নয় সকলের হয়ে নিজের কাছে ফেরা। যার মধ্যে দিয়ে তিনি বাঙালির স্বাধীনতাকে, বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে পূর্ণতা দেয়ার শিল্পিত মনস্কামনা জারি রেখে গেছেন।
Comments