ভেতরে যে প্রশ্ন জাগে, সেটা নিয়েই লিখি: সনৎকুমার সাহা

আমি বিশেষ কিছু লিখছি, কিন্তু এটা কাউকে প্রভাবিত করার জন্য না। আমার ভেতরে যে প্রশ্ন জাগে, সেটা নিয়েই লিখি আমি। লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি।
সনৎকুমার সাহা। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ সনৎকুমার সাহার জন্ম ১৯৪১ সালে। আগ্রহের বিষয় সমাজ-রাষ্ট্র-সাহিত্য-সংস্কৃতি। অর্থনীতি, রবীন্দ্রনাথ, সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ে প্রবন্ধের বই আছে দশটি। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে। ২০০৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনার পর্ব আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য হিসেবেও।

২০১৩ সালে সনৎকুমার সাহা প্রবন্ধসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে পান একুশে পদক। সম্প্রতি সমাজ-সংস্কৃতি ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত দশক স্মৃতি সত্তা বর্তমান' বইটি নিয়ে কিছু শুনতে চাই।

সনৎকুমার সাহা: প্রবন্ধগুলো ঠিক বই করার উদ্দেশ্য মাথায় রেখে লেখা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে লেখা এগুলো। ইতিহাসের ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনাপ্রবাহ, সেটাকে এই লেখাগুলো হয়তো বিকশিত করেছে। যদি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরেই মনোযোগ দিতাম, তাহলে হয়তো বইয়ের ধরনটা খানিকটা অন্যরকম হতো। যারা বই ছেপেছেন, তারা আগ্রহ নিয়েই করেছেন।

ডেইলি স্টার: আপনার বয়সের অনেকে স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী লেখেন। এমন কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

সনৎকুমার সাহা: স্মৃতিকথা লিখতে হলে আমাকে আরও বাঁচতে হবে এবং এটা লেখার জন্য সততা দরকার, সেই সাহস আমি করতে পারব না। আমি বিশেষ কিছু লিখছি, কিন্তু এটা কাউকে প্রভাবিত করার জন্য না। আমার ভেতরে যে প্রশ্ন জাগে, সেটা নিয়েই লিখি আমি। লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি।

ডেইলি স্টার: অধ্যাপনা থেকে অবসরের পর লেখালেখি কি বেড়েছে?

সনৎকুমার সাহা: অবসর নেওয়ার আগেও যেমন লিখেছি, এখনো তেমনই লিখছি। কোনো একটা বিষয় মাথায় আসলে সেটা নিয়ে ভেবেছি। সঙ্গতিহীন কিছু আছে কি না দেখেছি। আমার কাছের মানুষরা বলেন যে, বই না ছাপালে নিজের জায়গাটা আড়ালে চলে যাবে। তাই তাদের কথা মেনে চলেছি। খুব ভালো লিখেছি তা বলব না। আমার লেখালেখির শুরুর দিকে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। তিনি লেখা চাইতেন, লেখা দিয়েছি। সেসব লেখা থেকে কোনো প্রশ্ন উঠলে সেটা নিয়েও লিখেছি। সেটা পাকিস্তান আমল থেকেই। 'পূর্বমেঘ' পত্রিকা প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং প্রফেসর মুস্তফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় বের হতো। আমি এখনো মনে করি, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা বা সাহিতপত্রগুলোর মধ্যে 'পূর্বমেঘ' একেবারে অগ্রজসারির। কলকাতার 'পূর্বমেঘ' পত্রিকা আর ঢাকায় 'সমকাল' বের হচ্ছিল। আমার মনে হয় এ দুটো যে সময়কে ধারণ করেছে এবং সেখানে যে লেখাগুলো আছে সে লেখাগুলোর গুরুত্ব বা বিচার বিশ্লেষণ করার কাজটি বোধহয় অসঙ্গত হবে না।

ডেইলি স্টার: লিখতে এসে কাদের উৎসাহ পেয়েছেন?

সনৎকুমার সাহা : জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যার আর মুস্তফা নূরউল ইসলাম স্যার—উভয়ের উৎসাহে লিখতে শুরু করেছিলাম। তার আগেও লিখেছি এবং সেই সূত্রে ঢাকার কোনো কোনো কাগজেও লিখেছি। খুব যে সাহিত্যিক হওয়ার চেষ্টা ছিল, তা না। কিন্তু ১৯৯৬ সালের একটি ঘটনা আমাকে বই ছাপার ব্যাপারে অনেকটা বাধ্য করে। বাংলা একাডেমিতে সাদাত আলী আখন্দ নামে একটা পুরস্কার আছে। সে বছর কেন দিয়েছে জানি না। আমি বই কিছু লিখিনি কিন্তু লেখা ছাপানো আছে বিভিন্ন পত্রিকায়। সে বছর যখন ওরা আমাকে এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করল, তারপর থেকে চারদিক থেকে একটা চাপ তৈরি হলো—এই লেখকের বই হচ্ছে না কেন? মূলত এরপর থেকেই আমি লেখা শুরু করি।

ডেইলি স্টার: সম্পাদক আবুল হাসনাতকে কাছের মানুষ বলে জানান আপনি। তিনি কেন এত কাছের?

সনৎকুমার সাহা: আবুল হাসনাত সংবাদ থেকে কালি ও কলমে যোগ দিয়েছেন। তখন সংবাদেরও ভাঙাচোরা অবস্থা চলছিল। বেতন দিতে পারছিল না। আবুল হাসনাত অনেকটা বাধ্য হয়ে কালি ও কলমে যোগ দেন সম্পাদক হিসেবে এবং তার আগ্রহে যে আমি কখনো কখনো সাড়া দিতে পেরেছি, সেটা আমাকে তৃপ্তি দেয়। হাসনাত নিজে যে সততা ও সম্ভাবনা নিয়ে পত্রিকা চালিয়েছেন, আমার মনে হতো সময়ের সেরা লেখাগুলো সংবাদ এবং কালি ও কলমে ছাপা হচ্ছে। আর শব্দঘর পত্রিকাটাও ছিল বেশ ভালো। এখন বেশিরভাগ খবরের কাগজ পড়া হয় না। খবর দেখার জন্য একটা পড়ি। আর সাহিত্য পাতার প্রতি তেমন আগ্রহ পাই না। তাই আবুল হাসনাতকে আমি বিশেষভাবে স্মরণ করি।

ডেইলি স্টার: অবসরে গান না কবিতা—কোনটি আপনাকে কীভাবে সঙ্গ দেয়?

সনৎকুমার সাহা: গান ভালো লাগে। লেখালেখিতে আমাকে বলা যেতে পারে বাইরের মানুষ। এক্ষেত্রে আমি ভেতরের মানুষ নই। আমি নিজে গান জানি না। কিন্তু গান শুনতে ভালোবাসি। সেগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে লিখি।

ডেইলি স্টার: দেশভাগ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।

সনৎকুমার সাহা: ১৯০৫ সালে বেশিরভাগ মানুষের কাছে বাংলা ভাগ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছিল। তারা এটাকে স্বাগত জানান। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। সবাই দেখল তাদের যে ন্যায্য পাওনা, পাকিস্তান তা দিচ্ছে না। দেখা গেল পাকিস্তানি শাসন ব্রিটিশদের চেয়েও অরুচিকর ও সংকীর্ণ। তখন থেকেই গড়ে উঠতে থাকে জাগরণ। তবে আমি এটাও মনে করি যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র কারণ না। এখানে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, পাকিস্তানের নীতি নির্ধারণে যাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটা কলোনি হিসেবে ব্যবহার করেছে।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাজউদ্দীন আহমদ বা এএইচএম কামারুজ্জামানদের ভূমিকা তো অসামান্য। কিন্তু তাদের এত কম স্মরণ করা হয় কেন?

সনৎকুমার সাহা: এটা আমার কাছে খুব আক্ষেপের বিষয় মনে হয়। তাদের আমরা অবহেলা করছি। তাদের গুরুত্ব না দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে তাদের পুরো ছবিটাকে আমরা ম্লান করছি।

ডেইলি স্টার: সমাজবিজ্ঞানী ড. নাজমুল করিমের শতবর্ষ চলছে। তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে কি?

সনৎকুমার সাহা: তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে বাংলাদেশ হওয়ারও আগে। তার কাজ ও লেখা অসামান্য।

ডেইলি স্টার: আপনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বঙ্গবন্ধু চেয়ার' অধ্যাপক ছিলেন। অনিয়ম, দুর্নীতিসহ স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ আছে অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে। তাদের নিয়ে কী বলবেন?

সনৎকুমার সাহা: বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভাইস চ্যান্সেলর খারাপ এটা বলব না। তারা তাদের কাজে গাফিলতি করেন এটাও আমি বলি না। তারা ব্যক্তিগতভাবে কেউ ভালো কিংবা খারাপ হতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মূল ধারণা সেই মুক্তচিন্তার বিকাশে তাদের কাজ করতে দেখিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলরের আগের দুই ভাইস চ্যান্সেলর একজনের বিরুদ্ধে কোনো অপবাদ শুনিনি। আরেকজন যেভাবে ধিক্কার নিয়ে বিদায় নিয়েছেন সেটা আমাদেরও লজ্জার কারণ বলে মনে হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

1d ago