অ্যালিস মুনরো

বিদায় 'অন্টারিওর রানি'

ছোটগল্পের মাস্টারখ্যাত অ্যালিস মুনরোর গল্পগুলোতে একটু চোখ বুলালেই তা মুহূর্তেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায়।

২০১৩ সালের নোবেল লরিয়েট অ্যালিস মুনরোর জন্ম কানাডার অন্টারিও প্রদেশের উইংহ্যাম এলাকায় ১০ জুলাই ১৯৩১। বাবা রবার্ট এরিক লেইড্লো ছিলেন কৃষক এবং মা অ্যানি ক্লার্ক লেইড্লো ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পূর্বে তিনি "কানাডিয়ান গভর্নর জেনারেলস অ্যাওয়ার্ড" লাভ করেন মোট তিনবার। সাহিত্যে অবদানের জন্য "ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল" পুরস্কার পান ২০০৯ সালে।

গল্প বা উপন্যাস লেখার জন্য স্থানিক পরিভ্রমণ কি বাধ্যতামূলক কিনা সেটি অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ; হয়তো কিছুটা বাদানুবাদের বিষয়ও বটে, তবে ছোটগল্পের মাস্টারখ্যাত অ্যালিস মুনরোর গল্পগুলোতে একটু চোখ বুলালেই তা মুহূর্তেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায়।

তার গল্পগুলোকে বৈশ্বিক হওয়ার জন্য, গল্পের চরিত্রগুলোকে কোনো বৈশ্বিক পরিভ্রমণে যেতে হয়নি, বরঞ্চ ঘটেছে ঠিক তার উল্টো, তাদের হতে হয়েছে খুব বেশি আঞ্চলিক- বলা ভালো যে, তার জন্মস্থান দক্ষিণপশ্চিম অন্টারিওর হিউরন কাউন্টির আশেপাশেই গড়ে উঠেছে অধিকাংশ গল্পের ভিত্তিভূমি। তিনি পুরো বহির্বিশ্বকে তাঁর গল্পের কলকব্জার মোচড়ে টেনে এনেছেন অন্টারিওর অকুস্থলে। অতি আঞ্চলিক হয়ে তারা অবধারিতভাবে হয়ে উঠেছে পুরোপুরি বৈশ্বিক। দুয়েকটি গল্পের নিরিখে অবলোকন করলে তা পুরোপুরি বোঝা যেতে পারে।

মুনরোর খুব পরিচিত একটি গল্প "অ্যামান্ডসেন"। স্কুল শিক্ষিকা মিস ভিভিয়েন হাইড ও মেরি'র মধ্যকার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে খুব সাদামাটা ও হালকাভাবে মূল গল্পের শুরু। গল্পের মূল চরিত্র স্কুল শিক্ষিকা মিস ভিভিয়ান হাইড ও ম্যারি'র মধ্যকার সাধারণ কথোপকথনের মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি মুনরো খুব সযত্নে ও দক্ষভাবে অ্যামান্ডসেন ও হান্টসভিলের প্রকৃতির চিত্রায়ণ করেছেন। গল্পে অবধারিতভাবে উঠে এসেছে অন্টারিওর সাধারণ আধা-গ্রামীন পরিবেশের ঝিল, বরফঢাকা পথ, সাদা কাঠের দালান, হিমেল বাতাস, পাঁশুটে বার্চ গাছ, জুনিপার গাছ, চিকন কালো স্প্রুস গাছ প্রভৃতি। তবে বিভিন্ন আবহ অতিক্রমণের পাশাপাশি পাঠকের জন্য অসাধারণ গল্পের মোচড় উপঢৌকন হিসেবে তিনি রেখেছেন গল্পের একদম শেষের দিকে। 

অ্যালিস মুনরো'র গল্পে চিরায়ত-আবেগ ও গভীর সমবেদনা উঠে এসেছে একদম সুস্পষ্ট ও বাস্তবিকভাবে। গল্প বয়ানের ক্ষেত্রে তিনি আশ্রয় নেননি কোনোরকম আতিশয্যের, বরাবরই তিনি অবস্থান করেছেন তার মূলকেন্দ্রিক সহজ সরল ভাষার ব্যবহারের দিকে ও ঘটনা যা ঠিক তাই বর্ণনা করার দিকে। তার কথ্যশৈলীর মূল শক্তিটাই ছিল আঞ্চলিকতার দিকে তীব্র দৃষ্টিপাত। আলোচকগণ প্রায়ই অ্যালিস মুনরোর গল্পে ব্যবহৃত ছোট শহরের বর্ণনার সেটিংকে আমেরিকার দক্ষিণের গ্রাম্য জীবনের সাথে তুলনা করে থাকেন। 

উল্লেখ্য যে, আমেরিকান লেখক "উইলিয়াম ফকনার" ও "ফ্ল্যানারি ও'কনর"-এর লেখায় চরিত্রগুলোকে যেভাবে আঞ্চলিক প্রথা ও রীতিনীতির মোকাবেলা করতে হয় ঠিক তেমনিভাবে অ্যালিস মুনরো'র গল্পে বর্ণিত চরিত্রদেরও আঞ্চলিক রীতিনীতির ব্যাপারে সদাসতর্ক থাকতে দেখা যায়, তবে এক্ষেত্রে মুনরো'র চরিত্রদের উপর এ প্রথার তীব্রতা তাঁর দক্ষিণী প্রতিরূপদের তুলনায় কিছুটা কম ও সহজতর হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে।

তার বিখ্যাত গল্প "ফিকশন" এর দিকে খানিকটা চোখ ফেরানো যাক। গল্পের শুরুতেই পাঠক পায় অন্টারিওর এক শহরের বর্ণনা। রাফ রিভার স্কুলে দিনভর সঙ্গীত শেখানোর পর গাড়ি চালিয়ে মূল চরিত্রের বাড়ি ফেরার চমৎকার বর্ণনা। পাঠক মূল গল্পে ঢোকার পূর্বেই খুঁজে পায় ডগলাস ফার আর সেডার বৃক্ষের অরণ্যের বয়ান, খুঁজে পায় অরণ্যের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঘরবাড়ির সুন্দর আবহ। রয়েছে গল্পের মূল চরিত্র জন ও জয়েসের চমৎকার সম্পর্কের রসায়ন-জটিলতা, আরেক চরিত্র এডির কুমারী-মাতা হিসেবে গল্পে আচমকা আত্মপ্রকাশ, পরবর্তীতে জন ও এডির সম্পর্কের নতুন মোড় ও ঘনিষ্ঠতা।

দ্বিতীয় ধাপে পাঠক জয়েসকে আবিষ্কার করে তার নতুন প্রেমিক ম্যাটের সাথে- তার পঁয়ষট্টিতম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে। ফিকশন গল্পের শেষে লন্সডেল এভিনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও পাহাড়ে উঠতে থাকা জয়েসের মনে যেভাবে প্রশান্তি ফিরে আসে ঠিক তেমনিভাবে গল্পটি পাঠপূর্বক পাঠকের মনেও খুব সহজেই প্রশান্তি ভর করে। পাঠকের মনে চরমভাবে অনুরণন তুলে ত্রিমুখী কমপ্লেক্স টাইপের গল্পটি।

অ্যালিস মুনরো তার কিছু গল্পে তীব্রভাবে ছুঁইয়েছেন উপন্যাসের আবেশ। উপন্যাসে যে আবেগের ব্যবহার ও সাহিত্যিক গভীরতা পাওয়া ঠিক তেমনিভাবে অ্যালিস মুনরোর কিছু গল্পেও রয়েছে তার সরস উপস্থিতি। মুনরো'র লেখার ধরন: ছোট গল্প নাকি উপন্যাস- একদা এ প্রশ্নের উত্তরে লেখক "অ্যালেক্স কিগ্যান" "একলেকটিক্যা"-তে বলেছেন: "হু কেয়ারজ? ইন মোস্ট মুনরোজ স্টোরিজ দেয়্যার ইজ এ্যজ মাচ এ্যজ ইন ম্যানি নভেলস"। তার গল্প ফিকশনের দিকে চোখ ফেরালে এ বক্তব্যের সারবত্তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

যতদিন লিখেছেন ঠিক ততদিন অন্টারিওর ছোট শহর, শহরতলি ও আধা-গ্রাম্যজীবন-এর চৌহদ্দির ভেতর নিরেট গল্প বুনন করেছেন। এ-শহরতলি ও তার পরিবেশকে করেছেন সারাবিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এ-সকল কিছুকে কেন্দ্র করে মুনরো তার গল্পকে কাঠামোবদ্ধ করার জন্য কখনো কখনো চরিত্রদের অতীতে ফিরিয়েছেন এবং অতীতে ঘটে যাওয়া মূল ঘটনার কিয়দংশকে আবৃত করেছেন। তার গল্পের চরিত্রগুলোকে প্রায়শই করেছেন উপাখ্যান নির্ভর ও স্মৃতিবিভ্রমে আক্রান্ত।

স্মৃতিবিভ্রম বিষয়কে কেন্দ্র করে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্পটি হচ্ছে: "দ্য বিয়ার কেইম ওভার দ্য মাউন্টেন"। এতে মূল চরিত্র হিসেবে রয়েছে গ্র্যান্ট ও ফিওনা। অকুস্থল যথারীতি কানাডার একটি ছোট শহর, যে শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে পড়াশুনা করে গ্র্যান্ট ও ফিওনা। সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করে গ্র্যান্ট ধীরেধীরে ফিওনার স্মৃতিবিভ্রমের বিষয়টি অনুধাবন করে। ফিওনার স্মৃতিবিভ্রমের এ সন্ধিক্ষণে আবির্ভাব হয় তার জীবনে এক নতুন পুরুষের- অব্রে। 

বিষয়টিতে মুনরো একটি জটিল হিসেব কষে পাঠকের মুখোমুখি করে তুলেন ফিওনাকে, নেন কিছু পরীক্ষাও। পাঠক একদিকে ক্রমাগত গ্রান্টের একাকীত্ব ও অসহায়ত্বের সাথে নিজেদের সমন্বিত করে, অপরদিকে ফিওনার অসহায়ত্বকেও পাঠক খুব সচেতনভাবে গ্রহণ করে, বলা ভালো, ফিওনার অসহায়ত্বকে পাঠক গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। অব্রেকে প্রাথমিকভাবে নেগেটিভ মনে হলেও মুনরো খুব দক্ষতার সাথে পাঠকদের মাধ্যমে অব্রের বিষয়টি সমাধান করেছেন। অব্রেকে শেষপর্যন্ত তার স্ত্রী টার্টানের নিকট ফেরত যেতে হয় আর ফিওনা তার স্মৃতি উসকে ভালোবাসা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরে আসে গ্র্যান্টের কাছে।

অন্টারিওর ছোট শহর, শহরতলি ও আধা-গ্রাম্যজীবনের সাদামাটা পটভূমিকায় গল্পের গৌরচন্দ্রিকা করলেও অ্যালিস মুনরোর প্রায় প্রতিটি গল্প শেষ হয়েছে কিছুটা আনমনা ও সিদ্ধান্তহীনভাবে। সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়টি ছাড়াও রয়েছে মূল চরিত্রের ভবিষ্যতের দিকে খ--খ-, অনুমানমূলক ও দূরকল্পনার বিষয়টিও। মুক্তকণিকা গল্পের দিকে মনোযোগ প্রদান করা যাক। মূল চরিত্র নিতা ও রিচ; যেখানে রিচ গল্পের শুরুতেই মৃত্যুবরণ করে। নিতা রিচের দ্বিতীয় স্ত্রী; তবে স্বামীর মৃত্যুর পর নিতার একাকী জীবনযাপন গল্পের কিয়ৎ বয়ান হলেও এক গরমের সকালে নিতার বাসস্থানে ফিউজ ঠিক করার ছলে অকস্মাৎ ঢুকে পড়া যুবকের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে মূল গল্পের এগিয়ে যাওয়া। 

পুরো গল্পে নাটকীয়ভাব বজায় থাকলেও গল্পের আবহে যুবকের খুন হওয়া ও পরবর্তী ঘটনাসমূহ নিতার ভবিষ্যত জীবনের সিদ্ধান্তের উপর কোনো প্রকার আলোকপাত করে না। শুরুটা আকর্ষণীয়ভাবে ও মনোযোগের উপর রেখাপাত করলেও গল্পের শেষটি পাঠকের মনের উপর গভীরভাবে রেখাপাত করে না।

যদিও চিরায়ত-আবেগ, অর্ন্তদৃষ্টি ও সমবেদনাপূর্ণ ভাবের জন্য অ্যালিস মুনরোকে রাশিয়ান লেখক "আন্তন চেখভ" এর সাথে তুলনা করা হয় তবে অ্যালিস মুনরোর গল্পগুলোর বড় অংশই জুড়ে আছে মানুষের জীবনে স্বাভাবিকভাবে আসা প্রেম-বিরহ, বিষন্নতা, আনন্দ-বেদনা, সারল্য ও কুটিলতা এবং বিবাহপূর্ব ও বিবাহ-পরবর্তী যৌনতা। বিদায়-লগ্নে তাই যথাযথ সম্মান ছোট গল্পের এ বৈশ্বিক বেহালাবাদককে।

Comments

The Daily Star  | English
quota reform movement,

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of 726 people who died during the student-led mass protests in July and August.

44m ago