একজন কবি কেন বিষণ্ণতায় মারা যান?

একজন সৃজনশীল মানুষ কর্ম দিয়ে দেশ, জাতি ও পৃথিবীর জন্য যা কিছু করে যান, তা কোনোভাবেই মূল্য দিয়ে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এ কারণে কেবল তাদেরকে পুরস্কৃত করলেই হবে না, রাষ্ট্রকে পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি উনাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
কবি অসীম সাহা। জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯, মৃত্যু ১৮ জুন ২০২৪। ছবি: সংগৃহীত

অসীম সাহা মারা গেলেন ১৮ জুন। যদিও আমরা জানি, একজন কবির মৃত্যু হয় না। তিনি বেঁচে থাকেন কাব্যলোকে। অসীম সাহা কবি ছিলেন। আপাদমস্তক একজন কবি। কবির জীবনযাপন করে গেছেন তিনি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কতো বড়ো কবি ছিলেন? কতোটা উঁচুমাপের কবি ছিলেন? এসব নিয়ে। একজন কবিকে পরিমাপ করা মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। আলটপকা একটা মন্তব্য করে দেওয়া যেতেই পারে—যেটা আমরা হরহামেশা করে থাকি।

প্রকৃতপক্ষে কবিতার বিচার করা দুরূহ। কবিকে খারিজ করে দেওয়া, ‍তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া মোটেই সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। অসীম সাহার মতো কবিকে তো নয়ই। কারণ, উনার কবিতার সংখ্যা ও কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ঈর্ষণীয়, ৩৫টির মতো। যা বিচারে অনুসন্ধান প্রয়োজন, গবেষণা জরুরি।

দুঃখজনক হলো, অসীম সাহা মারা যাওয়ার পর আমরা এসবের কোনো প্রকার কোশেশ ছাড়াই জিঘাংসাপরায়ণ-জুগুপ্সামূলক এক মনোবৃত্তি হাজির করেছি। যা বেদনার ও গাঢ় এক অন্ধকারের মতো লজ্জার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ কত সহজেই না লিখে দিলেন, 'অসীম সাহার কবিতা হয় না।' অথচ কবিতার বিচার সময় নিরপেক্ষ, কাল আশ্রয়ী।

আমরা একেবারে ভুলে গেলাম যে অসীম সাহা কবি কি-না, সেই প্রশ্নে ফায়সালার আগে এটা মনে রাখা জরুরি ছিল যে, তিনি একজীবন কবিতার জন্য বাজি রেখেছিলেন। কবিতার জন্য তিনি ছিলেন মস্ত বড় একজন বাজিকর।

মনে রাখতে হবে, কবিতা বেঁচে থাকে, পরমায়ু পায় এরকম অগণন বাজিকরদের কবিতা-যাপনে। কবিতা নির্মিত হয় এরকম হাজারো বাজিবাজদের ধ্যানে, জ্ঞানে, প্রজ্ঞা ও প্রযত্নে।

অসীম সাহারা কবিতাকে এককাল থেকে অন্যকালের দিকে এগিয়ে নেয়। কোনো একজন কবির হাতে কবিতা অমরত্ব পায় না। কবিতা অমর হয়ে ওঠে, পৃথিবীর সমান বয়সী হয়ে ওঠার প্রেরণা ও মন্ত্র পায়, অসীমের পানে যাত্রা করার সাহস ও শক্তি নেয়; অসীম সাহাদের কল্যাণে, কবিতাযাপনের বদৌলতে।

অসীম সাহার মৃত্যু পরবর্তীতে আমাদের মধ্যেকার কতিপয় জনরা যে মানসিকতা প্রদর্শন করেছেন, তাতে কবির কিছুই যায় আসেনি, উল্টো উন্মোচিত হয়েছে নিজেদের ঊন-মন বৃত্তি। কবিতা নিয়ে, ব্যক্তির স্বভাবজ বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি নিয়ে যেসব প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছে; তা অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিকর। এর মধ্যে দিয়ে উনারা ভীষণ-রকমভাবে কলুষিত করেছেন নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে। একটা গোষ্ঠীর চয়ন রুচি ও উৎকলন অভ্যাসের পোস্টমর্টেম হয়েছে এই অবকাশে। এই নিরিখে বলা যায়, অসীম সাহার মৃত্যু আমাদের সামনে জানালা খুলে দিয়েছে কবিতার, কবিতাপ্রেমীর ও স্বঘোষিত কবিতা বিশেষজ্ঞদের।

অসীম সাহার কবিতা যাপনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের একটি ছিল তরুণদের প্রতি প্রবল পক্ষপাত। এদের বেষ্টন করেই উনার কাব্যময় জীবনের পুরোটা কিংবা বেশীরভাগ সময়টা ব্যয়িত হয়েছে। নীলক্ষেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শাহবাগ, আজিজ মার্কেট, কাঁটাবন—রাজধানীর এই চৌহদ্দিতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন কবির নিজস্ব রাজ্য ও রাজ।

আমরা যারা সময় ও সুযোগ পেলেই ঢুঁ দিতাম কাঁটাবনের বইয়ের দোকানে, তারা তো খুব ভালো করেই দেখেছি অসীমদার কবিতা প্রেম, তারুণ্যপ্রীতি। কবিতা সংলগ্নদের উনার উষ্ণতায় ওম নিতে ক্লান্তি ছিল না কখনোই। এসব ওম নেওয়ার কালে স্পষ্ট হতো উনার পক্ষপাত ও দুর্বলতার দিক। খোলতাই হতো উনার সবলতার দিকগুলোও। খুব সহজেই চোখে পড়তো উনার কিছু দুর্লভ গুণ। যার যে বিষয়ে আগ্রহ, উনি সেই বিষয় নিয়েই কথা বলতেন স্বচ্ছন্দভাবে।

অসীম সাহা সর্বজনে একনামে কবি হিসেবে পরিচিত হলেও, উনার ভেতরে ছিল একজন প্রাবন্ধিকের বসবাস। 'আধুনিক ব্যবহারিক সহজ বাংলা অভিধান', 'প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা', 'সংস্কৃতি রূপে-অরূপে', 'বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রী কৃষ্ণকীর্তন বিনির্মাণ' প্রভৃতি গ্রন্থ এই সত্তার অনুপম সাক্ষী।

কিন্তু সেই প্রাবন্ধিককে যে পরিমাণ দাওয়ায় ও দোয়ায় রাখার প্রয়োজন ছিল, সেটা দেননি বলে সেই পরিচয় বিকশিত হয়নি। তবে, সহজাত গুণে যতটা সম্ভব সেই সত্তা উন্মীলিত হয়েছিল। প্রাবন্ধিকতার কারণে উনার ভেতরে একজন গবেষকেরও হদিস মেলে, আনাগোনা দেখা যায়। যা উপ্ত হওয়ার বাসনা জারি ছিল উনার সাংবাদিক চেতনায়।

সাংবাদিকতাকে ঘিরে উনি অন্য রকমের একটা স্বপ্ন দেখতেন। যদিও আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি, কী সেই স্বপ্ন। প্রশ্ন করেও মেলে ধরেননি তার উত্তর। রাখঢাক ছাড়াই বলতেন, বলতে চাই না। সব নোট করে রেখেছি, যদি কখনও সুযোগ হয় সেগুলো বাস্তবায়ন করে দেখাতে চাই।

সাংবাদিকতাকে ঘিরে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি একটা সাংবাদিকবান্ধব প্রতিষ্ঠানের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতেন। হন্যি হয়ে ঘুরেছেন উচ্চবিত্তের দ্বারে দ্বারে। হাপিত্যেশ করেছেন রাত-দিন। কিন্তু হঠাৎ বড়লোক হওয়া এ দেশের বিত্তশালীরা গণমাধ্যমকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখতে গররাজি। যারা দেখেন, তাদের স্বপ্ন ও লক্ষ্য প্রতিষ্ঠান নয়, মিডিয়ার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অন্য উদ্দেশ্য হাসিল করা। যা অসীম সাহার স্বপ্নকে ধারণ করে না। কোনো প্রকার সুযোগ দিতেও রাজি নয়।

অসীম সাহা কবিতায় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক পেয়েছেন। এ সব পদক আমাদের দেশের সর্বাধিক গুরুত্ববহ পদক ও সম্মাননার অন্যতম। মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। এই ভালো, এই মন্দ—এই টানাপড়েনের মধ্যেই কেটেছে শেষ দিনগুলো।

উনার অসুখের যে কয়েকটির কথা ডাক্তারের তরফে জানা গেছে, তার মধ্যে একটা হলো বিষণ্ণতা। বাকিগুলোর মধ্যে রয়েছে পারকিনসন্স ও আরও কয়েকটি; যার সবকটিই বিষণ্ণতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

এ বছরেরই একেবারে শুরুতে যখন তিনি অসুস্থ হলেন, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করানো হয়। তখন পত্রিকা সূত্রে আমরা জেনেছি, সেই সময় উনাকে যেতে হয়েছে নানা রকমের অসুবিধা ও অস্বস্তির মধ্য দিয়ে, কেবিন পাননি। অর্থনৈতিক সংকটে বাধাগ্রস্ত হয়েছে টেস্ট ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরিবারকে এই অবস্থায় রীতিমতো দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। পরবর্তীতে সেসবের সমাধান মিলেছে প্রধানমন্ত্রীর প্রদেয় সাহায্যে।

মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে একজন কবিকে এরকম বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা কী শোভন কোনো ব্যাপার? অসীম সাহা একজন কবি এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত। এই লেখায় আগেই উল্লেখিত হয়েছে, তিনি একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এসব পুরস্কারের অর্থ কি কেবলই একটা সার্টিফিকেট, একটা মেডেল ও কিছু অর্থ প্রদান করা, নাকি তারও অধিক কিছু? এই প্রশ্নে যে কেউ বলতে পারেন, অধিক কিছু তো বটেই। এটা তো তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি সারা জীবনের জন্য সম্মানিত হন।

আমরা মনে করি, এই যে সারা জীবনের জন্য সম্মানিত হওয়া, এটা কেবল কথার কথায় না রেখে দৃশ্যমানভাবে কিছু করা প্রয়োজন। এই লেখার মূল উদ্দেশ্য সেটাই। এ ক্ষেত্রে যেগুলো করা দরকার—

১. রাষ্ট্রের এসব সম্মাননা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুবধি সকল প্রকার চিকিৎসা রাষ্ট্রীয় সুবিধায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দিতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্তির অধিকারী হবেন তিনি।

২. রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যানবাহনে তাদের যাতায়াত খরচ সম্পূর্ণ মওকুফ করতে হবে। মৃত্যুবধি ভাড়ামুক্ত চলাচলের সুযোগ পাবেন এবং এসব পরিবহনে কোনো প্রকার ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই সর্বোচ্চ সুযোগ প্রাপ্তির দাবিদার হবেন।

৩. মৃত্যুবধি পেনশন সুবিধা পাবেন—পুরস্কারের মানভেদে পেনশন সুবিধার হেরফের হতে পারে।

৪. পুরস্কার প্রাপ্তদের ‍মৃত্যুর পর যার যার ধর্ম বা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী শেষকৃত্যের ব্যবস্থা রাষ্ট্রের তরফে সম্পন্ন করা হবে।

৫. পুরস্কার প্রাপ্তদের জন্য বরাদ্দকৃত পেনশন উনাদের মৃত্যুর পর স্ত্রী জীবিত থাকলে তিনি অথবা নাবালক সন্তান অথবা প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে সেই সন্তানের অনুকূলে বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।

মনে রাখতে হবে একজন সৃজনশীল মানুষ কর্ম দিয়ে দেশ, জাতি ও পৃথিবীর জন্য যা কিছু করে যান, তা কোনোভাবেই মূল্য দিয়ে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এ কারণে কেবল তাদেরকে পুরস্কৃত করলেই হবে না, রাষ্ট্রকে পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি উনাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই ‍নতুন প্রজন্মের জন্য উনাদের অবদান আগুনের পরশমনি হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কারণেই বলেছিলেন, 'রাজা প্রজারে দেন মান, সেই মান আপনি ফিরে পান।'

রাষ্ট্র যদি অসীম সাহাদের প্রতি প্রকৃত অর্থেই সদয় হতেন, তা হলে উনাদের আর যাই-ই হোক বিষণ্ণতায় ভুগে মরতে হতো না। তাই কেবল পুরস্কার, পদক বা সম্মাননা নয়, রাষ্ট্রকে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিক-সম্পাদকসহ সব শ্রেণীর সৃজন ও মননশীল মানুষদের জন্য উল্লেখিত পাঁচ দফা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

Comments

The Daily Star  | English
Gross FDI Flow to Bangladesh

Uncertainty shrouds business recovery

The uphill battle to restore confidence among the business community is progressing slowly as the Prof Muhammad Yunus-led interim government marks its second month in office.

14h ago