স্মরণ

সোনার হরফে লেখা নাম ইবরাহীম খাঁ

গণ অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ এখন নতুন স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছে। সকলের মতো আমরাও আশাবাদী হতে চাই এইভেবে যে, এবার নিশ্চয় আশা পূরণ হবে।

কৈশোরক বয়স থেকেই ইবরাহীম খাঁর সঙ্গে পরিচয়। সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণীতে আমাদের পাঠ্যবইয়ে একটা গল্প ছিল 'সোনার হরফে লেখা নাম'। ওই গল্পের প্রতি ভাললাগার রেশ যায়নি একবিন্দুও। ইবরাহীম খাঁ'র প্রসঙ্গ উঠলেই বড়মিঞার কথা মনের মধ্যে ভেসে উঠত। বিশেষ করে ওই অংশটার বর্ণনা, যেখানে বন্যার শিকার হয়ে মানুষ ও পোষা প্রাণীর সঙ্গে বন্যপ্রাণীরাও ঠাঁই নিয়েছে এক জায়গায়। 

আজও মনে পড়ে, ওই বয়সেই ভেবেছিলাম বিপদের দিনে সবাই যদি একসঙ্গে থাকতে পারে, অন্য সময় কেন নয়? ওই অংশের বর্ণনা গল্পকার এমন সুন্দরভাবে দিয়েছেন যে, বারবার মুগ্ধ হয়ে পড়তে হয়। লিখেছেন : 'অনেকগুলি বাড়ী গেলাম। ঘরের ভিতরে মাচা পেতে তারই উপর অভাগারা কোন রকমে বসে আছে। রাতে ওরই ওপর জড়াজড়ি করে শোয়। মায়ের কোল হতে ঘুমের মধ্যে বাচ্চা হয়তো গড়িয়ে নীচে পড়ে যায়, সকালে উঠে আর তাকে পাওয়া যায় না। অন্ধকারে দড়ির মত গায় বাজে-কি জানি কি! বিষম ঠাণ্ডা ! 

বোঝে, ও ওদেরই মত বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছে...আঘাত না করলে এখন কিচ্ছু বলবে না। সকালে মাচা হতে নেমে গিয়ে কাছের কোন ধুমচা গাছের ডালে কোন রকমে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে, কেউ ওদের কিছু কয় না। গরুরা দিনের পর দিন গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, কারো কারো বাড়িতে সাঁতার। গিরস্থ গরুর দড়ি খুলে দিয়ে বলছে : যারে যা, যদি পারিস, তবে গিয়ে কোথাও ওঠ। আমি তোদের বাঁচাতে পারলাম না। ওরা অকুল দরিয়া পাড়ি দিতে ভাটি পথে চলে : যতক্ষণ দেখা যায় গিরস্থ এক দৃষ্টে চেয়ে দেখে, তারপর ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়, গিরস্থ বুক চেপে ধরে মাচায় এসে ওঠে। একটা আক গাছ দেখলাম- সাপ ব্যাঙ শিয়াল মুরগী : এ ঘোর বিপদে ওরা হিংসা ভুলে একত্রে বসে আছে।'

একটা গল্প একই সঙ্গে কতদিকে যে আলো ছড়াতে পারে। কত প্রসঙ্গ হাজির করার সক্ষমতা রাখে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই গল্প। ডাংগুলি খেলার বয়সে গল্পের ভেতর-বাহির সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝতাম না। আমাদের শিক্ষকেরাও কি বুঝতেন? বোঝার কথাও ছিল না নিশ্চয়। স্মৃতি হাতড়ে তো বিশেষ কিছুই উদ্ধার করতে পারি না, যা শুনেছি ওই গল্প প্রসঙ্গে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষকের বয়ানে।

পরিস্কার করে বলে নেওয়া ভাল এই গল্পের এখন যে ভাষ্য পাঠ করছি, তার সবটা বোধ করি আমাদের পাঠ্যবইয়ে ছিল না। সংক্ষিপ্তকরণ, সম্পাদন, সংশোধন ও সহজীকরণের নামে উনারা গল্পের যে অংশ আমাদের কাছে হাজির করেছিলেন তাতে গল্পের মূল যে শক্তি, গল্পকারের যে অভীপ্সা তার খামতি রয়ে গিয়েছিল বলে মনে করি। পাঠ্যবইয়ে যে যুক্তি ও কারণ দেখিয়ে গল্প, কবিতা কিংবা প্রবন্ধ মূলরূপে হাজির করা থেকে বিরত থাকা হয়, তার সঙ্গে একমত হওয়া দুরুহ, অসম্ভবও বটে। হয়তো পরিসর বিবেচনায় সংক্ষিপ্তকরণ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি মূলভাবকে খর্ব বা উপেক্ষা করা হয়, সেটা নিশ্চয় কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অথচ এই কাজটিই হামেশা করে থাকে এদেশের 'এনসিটিবি' নামক প্রতিষ্ঠানটি।

একটা গল্প একই সঙ্গে কতদিকে যে আলো ছড়াতে পারে। কত প্রসঙ্গ হাজির করার সক্ষমতা রাখে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই গল্প। ডাংগুলি খেলার বয়সে গল্পের ভেতর-বাহির সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝতাম না। আমাদের শিক্ষকেরাও কি বুঝতেন? বোঝার কথাও ছিল না নিশ্চয়। স্মৃতি হাতড়ে তো বিশেষ কিছুই উদ্ধার করতে পারি না, যা শুনেছি ওই গল্প প্রসঙ্গে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষকের বয়ানে।

আলোচ্য গল্পটির আলাপে আসি। এর লেখক প্রদত্ত নাম 'ভাঙ্গা কুলা'। আমরা পড়েছিলাম 'সোনার হরফে লেখা নাম'। দুটো নামই যুক্তিযুক্ত, তবে 'ভাঙ্গা কুলা'য় মনে হয় যথার্থ। যা উৎকলন করা হয়েছে গল্পের শরীর থেকে। পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থী ও লেখকের মধ্যে কীভাবে দূরত্ব তৈরি করে, তা ভাবলে অন্তহীন বিস্ময় জেগে ওঠে। আমরা যখন গল্পটা পাঠ করেছিলাম, তখন নিম্নে উল্লেখিত অংশটুকু ছিল না-

'ওনি তো বড়মিঞা, চিনেন না? না, অনেক বছর বিদেশে থেকে লেখাপড়া করছে কিনা। মনে পড়ল, ঢাকা-কলকাতা থেকেও দেশের লোকের মুখে বড়মিঞার নাম বহুবার শুনেছি। লোকটি বলে চল্ল : বনেদী ঘরে জন্ম- বড় ছেলে বাবা হাউস করে নাম রেখেছিলেন বড়মিয়া। তবে বেশী লেখাপড়া করে নাই। সে বয়সটা কেবল হৈ-হৈ, রৈ-রৈ-এর মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে তো। স্বদেশী করেছে, খিলাফতে মেতেছে, পুলিস মেরেছে, পুলিসের মার খেয়েছে, জেলে গিয়েছে, কয়েক মাস আগেও পাকিস্তান আন্দোলন উপলক্ষে শহরে কি গোলমাল করেছিল- দশদিন হাজত খেটে এসেছে।

কি করে চলে?
বড় কষ্টে আছে সাব।
বছর দুই আগে কারে কারে যেন ধরে বাড়ীতে পাঁচটা তাঁত বসিয়েছিল, তাই দিয়ে চলত। পাকিস্তান হওয়ার পর কর্তারা তা উঠিয়ে আমজাদ খোনকারের বাড়িতে নিয়েছে। এখন দুটি দুধের গাই পালে, বাড়ীর পাগাড়ে মাছ আছে, ক্ষেত থেকে কিছু ধান পায়, ছেলে-পিলে নাই, দুটি প্রাণী; তবু বড় কষ্টে দিন পাত করে। '

পরবর্তীতে আমরা যখন  ইব্রাহীম খাঁর রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হই তখন শ্রেণীকক্ষ ও বর্তমানের পাঠের ফারাকটা ধরা পড়ে। উনাকে নিয়ে লেখার আমন্ত্রণ পেয়ে যখন 'ভাঙ্গা কুলা' গল্পটা বেশ কয়েকবার পড়লাম তখন একটা বিষয় পরিস্কার হল যে, এই গল্পের মূল বারতা নিহিত আছে 'এনসিটিবি'র কাঁচিতে কেটে ফেলা অংশের মধ্যেই। অথচ এই অংশ পাঠ থেকেই বঞ্চিত করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। 'এনসিটিবি' কি চায় না ছাত্ররা বড়মিঞার মতো দেশপ্রেমিক হয়ে উঠুক; ওরা স্বদেশী আন্দোলন জানুক, ফেলাফত বুঝুক, পুলিশি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা শিখুক? 'এনসিটিবি' কি শিক্ষার্থীদের পুতুল ও কাকাতুয়া পাখি বিশেষ মনে করে? কাঁচি চালানোর নজির হিসেবে হয়তো আরও কিছু উদাহরণ হাজির করা যেতে পারে। এই লেখার ভরকেন্দ্র যেহেতু ইহজাগতিকতা প্রসঙ্গ। এ কারণে আমরা সেটা সামনে রেখেই বক্তব্য হাজির করতে চাই।

বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী হওয়ায় এবং এর চর্চার সঙ্গে যুক্ত বলে, আমরা না হয় গল্পের মূলপাঠটা পরে হলেও পাঠ করার সুযোগ পেলাম। এর বাইরে যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়ে গেল, তারা তো কোনদিনই জানার সুযোগ পেল না গল্পের প্রকৃত বার্তাটা কী। এই গল্পের ফোকাস কি ইহজাগতিকতার ওপর নিবদ্ধ ছিল, নাকি পারলৌকিকতাকেই গুরুত্ববহ বলে মনে করা হয়েছে? গল্পকার ইব্রাহীম খাঁ এই গল্পের মধ্য দিয়ে আদতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তাও তো রয়ে গেল অজানা এবং অধরা। ফলে, গল্পের খণ্ডিত পাঠ যেমন হয়েছে, ইব্রাহীম খাঁকেও তেমনি খ-িতরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাস্তবতা হল 'এনসিটিবি' এই কাজটা করে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে। আমরা মনে করি, সবক্ষেত্রে এই প্রবণতা ও চর্চা কেবল অযৌক্তিক নয়, ক্ষেত্র বিশেষে দোষের এবং অপরাধের পর্যায়েও পড়ে।

মনে আছে আমাদের, এই গল্প থেকে প্রতিবছরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে নিশ্চিতভাবে হাজির থাকত প্রশ্ন কিংবা ব্যাখ্যা। এ কারণে শ্রেণীকক্ষে এই গল্পের আলাদা গুরুত্ব ছিল। আমাদের সময়ের প্রশ্নটা ছিল এরকম, ''সোনার হরফে লেখা নাম' গল্পের নামকরণের স্বার্থকতা লেখ।'' আমরা লিখতাম, বন্যাপীড়িত মানুষকে বড়মিঞা কীভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কীভাবে বন্যায় বিপৎসংকুল পরিবারকে বাঁচিয়েছেন নিজের জীবন বিপন্ন করে, সেসবের বিশদ বিবরণ। এজন্য পরীক্ষায় নাম্বার পেতে হয়তো বেগ পেতে হতো না। কিন্তু এই গল্পের কাহিনীর যে একটা পরম্পরা রয়েছে। বড়মিঞার 'সোনার হরফে লেখা নাম' এর যোগ্য হয়ে ওঠার যে একটা ধারাবাহিকতা আছে, তা জানা হয়ে ওঠেনি আর কখনওই।

পৃথিবীতে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যে দেশটি মাত্র সাড়ে তিন দশকের মধ্যে দুইবার গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে। আবার আরও একটু এগিয়ে এভাবেও বলা যায়, এই ভূখ- মাত্র ছয় দশকের মধ্যে তিনবার গণ অভ্যুত্থান দেখেছে। শুধু কি গণ অভ্যুত্থান? মাত্র আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ নামক ভূখ- দুইবার স্বাধীন হয়েছে।

এই লেখা যখন লিখছি (১৯ আগস্ট ২০২৪) তখন বাংলাদেশে ঘটে গেছে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। যে ঘটনার সঙ্গে রয়েছে এই গল্পের উদ্দিষ্ট বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। মনে করি, 'ভাঙ্গা কুলা' গল্পের মূল ফোকাস ওটাই, শিক্ষার্থীদের যা পড়ানো হয়েছে তা বুদবুদ বিশেষ। বড়মিঞার জীবনরেখার দিকে লক্ষ্য করলেই বিষয়টা স্পষ্টত হয়। চলতি বছরের ৫ আগস্ট সংঘটিত হয় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। পতন হয় স্বৈরশাসকের। এই অভ্যুত্থানের ভরকেন্দ্রে ছিল ছাত্ররা। ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাধারণ শ্রেণী-পেশার মানুষেরা। এবং এক পর্যায়ে, বিশেষ করে আন্দোলনের শেষাশেষিতে পতিত স্বৈরাচারের কতিপয় দোসর ছাড়া আপামর জনতার সকলেই একাত্ম হয়ে পড়ে বৈষম্যবিরোধী এই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে।

গণ অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ এখন নতুন স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছে। সকলের মতো আমরাও আশাবাদী হতে চাই এইভেবে যে, এবার নিশ্চয় আশা পূরণ হবে। এবার কেন? কারণ, এরকম স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটা বাংলাদেশের ললাটে একেবারে নতুন কিছু নয়। এই ভূখ-ের মানুষেরা স্বপ্ন পূরণের পথে বারবার হেঁটেছে। কিন্তু সেই পথ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই হোঁচট খেয়েছে। আশাহত হয়েছে এদেশের আপামর মানুষ।

পৃথিবীতে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যে দেশটি মাত্র সাড়ে তিন দশকের মধ্যে দুইবার গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে। আবার আরও একটু এগিয়ে এভাবেও বলা যায়, এই ভূখ- মাত্র ছয় দশকের মধ্যে তিনবার গণ অভ্যুত্থান দেখেছে। শুধু কি গণ অভ্যুত্থান? মাত্র আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ নামক ভূখ- দুইবার স্বাধীন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোন দেশ নেই যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জন করেছে নিজেদের স্বাধীনতা। গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় সবই সম্ভব হয়েছে বড়মিঞাদের মতো 'ভাঙ্গা কুলা'র কারণে। অথচ এই বড়মিঞারা পাননি কোন প্রকার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা। অপূর্ণ রয়ে গেছে বারবার জীবন বাজি রেখে লড়াই ও আত্মাহুতি দেয়ার আকাক্সক্ষাসমূহ।

ইব্রাহীম খাঁ বড়মিঞার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, 'স্বদেশী করেছে, খিলাফতে মেতেছে, পুলিস মেরেছে, পুলিসের মার খেয়েছে, জেলে গিয়েছে, কয়েক মাস আগেও পাকিস্তান আন্দোলন উপলক্ষে শহরে কি গোলমাল করেছিল- দশদিন হাজত খেটে এসেছে।' আমরা প্রথম পরিচয়টা খোলাসা করি আগে। বড়মিঞা স্বদেশী করেছে। প্রশ্ন হল আমাদের পাঠ্য বইয়ে কি এই স্বদেশীদের সম্পর্কে কোনকিছু লেখা আছে? কারা স্বাদেশী, কী তাদের কাজ ছিল? কেন তাদের স্বদেশী বলা হয়? কোন প্রেক্ষাপটে, কোন অনিবার্য পরিস্থিতিতে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল? আমাদের সাধারণ শিক্ষার কোথাও কি এ সম্পর্কিত কোন পাঠ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে? সুযোগ তো নেই-ই উপরন্তু কোথাও যদি এ প্রসঙ্গ হাজির হয়, তাহলে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে। যেভাবে আমাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছিল আলোচ্য গল্পের ওই অংশটুকু বাদ দেয়ার মধ্যে দিয়ে।

অহেতুক তর্ক করার প্রবল মানসিকতা যেহেতু রয়ে গেছে এই ভূখ-ের মানুষের অস্থি মজ্জায়। এ কারণে তর্কপ্রিয়দের যে কেউ বলতে পারেন, ওই বয়সের শিক্ষার্থীরা স্বদেশী আন্দোলন ও স্বদেশীদের সম্পর্কে ধারণা নিতে উপযুক্ত নয়। স্বদেশী আন্দোলেনের রয়েছে একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ঘটনা হিসেবে এটি অনেক বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ। এসব নিয়ে শিক্ষকদেরই পরিস্কার ধারণা না থাকা স্বাভাবিক ও যুক্তি সঙ্গত। এরূপ বাস্তবতায় শিক্ষকমন্ডলী, শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাবেন কীভাবে?

আমরা মনে করি, এই প্রসঙ্গগুলো উপরের তলের খোঁড়া যুক্তি বিশেষ। স্বদেশী আন্দোলন ও স্বদেশীদের সম্পর্কে কেন এখানকার বিদ্বৎসমাজে কোন প্রকার চর্চা নেই? কেন এ ব্যাপারের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পরিস্কার ধারণা সঞ্চার করা সম্ভব হল না? আমাদের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ বলে স্বদেশী আন্দোলন ও স্বদেশীদের নিয়ে এখানে তিন রকমের ধারণা বিদ্যমান-
এক. প্রবল নেতিবাচক ধারণা রয়েছে একটা পক্ষের মাঝে।

দুই. মিশ্র ধারণা পোষণ করেন দ্বিতীয় পক্ষের একটা বড়ো অংশ। যারা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটোকেই গ্রহণ করেছেন, অবশ্য ইতিবাচকটা গৌণ। নিজস্ব কোন অনুসন্ধান বা পাঠ নেই এঁদের। 
তিন. অবশিষ্টাংশ বা তৃতীয় পক্ষ মনে করেন স্বদেশী আন্দোলনের যে শিক্ষা, তাৎপর্য ও মহত্ব তা এই ভূখ-ের জন্য, আরও স্পষ্ট কর বললে বলতে হয়, বাঙালি মুসলমানের জন্য প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক নয়। তারা মনে করেন ওই সময়ের জন্য ওটা ঠিক বেঠিক যাই-ই হোক এখনকার নিরিখে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা বা আলাপ বাতুলতা মাত্র।

উপরে উল্লিখিত প্রতিটি ধারণাই অযৌক্তিক, অস্বস্তির এবং দেশপ্রেমের জন্য ভীষণ রকমের ক্ষতিকর বলে আমরা মনে করি। স্বদেশীদের আন্দোলনের পদ্ধতি ও প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তা নিয়ে আরও বেশি অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু তাদের দেশপ্রেম ও ইতিবাচক উদ্দেশ্যসমূহকে খাটো করে দেখার যৌক্তিকতা কোথায়? তর্কের নামে এমনটা যদি করা হয় তাহলে আমাদের বর্তমান সংকটাপন্ন হবে। দেশ ও জাতিকে বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার যে আকাক্সক্ষা তা পদে পদে বাধার মধ্যে দিয়ে যাবে। 

স্বদেশী আন্দোলন যে প্রক্রিয়াতেই সংঘটিত হোক না কেন, তার লক্ষ্য যে ছিল স্বাধীনতার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এব্যাপারে প্রশ্নের অবকাশ নেই। আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, লড়াই-সংগ্রাম, দ্রোহ-প্রতিবাদের আড়ালে তাদের ভেতরের মূলমন্ত্র ছিল মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা পূরণ ও সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন করা। স্বদেশীদের অবদানকে আমরা যদি অস্বীকার করি তা হলে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ধারাবাহিক লড়াই সংগ্রাম তার গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়কে অস্বীকার করা হবে। স্বাধীনতার লড়াই ও মুক্তির সংগ্রাম যে একটা জাতির জীবনে হঠাৎ উদিত হয় না। তার দীর্ঘ ধারাবাহিকতা থাকে। এসব নিয়ে আমরা যতবেশি ঢাক ঢাক গুড় গুড় করব, আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সংগ্রাম ততবেশি ব্যাহত হবে।

তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নিই স্বদেশীদের সম্পর্কে আমাদের শিক্ষকদের স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। তা হলে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, এর কারণ লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায়। শিক্ষকরাও যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন সেখানেও এসম্পর্কিত কোন পাঠদান ছিল না। এমনকি শিক্ষকদের যে পেশাগত শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি রয়েছে সেখানেও এসবের অনুপস্থিতি প্রবলভাবে জারি ছিল। এসব থেকে আমরা যদি মুক্ত হতে না পরি। তা হলে, গণঅভ্যুত্থান আসবে, গণ অভ্যুত্থান যাবে। বড়মিঞাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। আর উনাদের অবস্থা তথৈবচ থাকার অর্থ হল, দেশ ও জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়া। ইব্রাহীম খাঁর যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আকাঙ্খা, তা থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা।

সঙ্গীণ এই অবস্থা যদি চলতেই থাকে তা হলে বলতেই হয় আমাদেরকেও জীবনের গল্পের উপসংহার টানতে হবে ইবরাহীম খাঁ'র মতো করেই। তিনি যেমন বলেছেন, 'ডাক্তার হাত দেখল, বুক দেখল, তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বল্ল- সব শেষ! হার্ট ফেল করেছে।
আমি বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ বসে রইলাম।

তারপর তার বিদেহী আত্মার প্রতি মনে মনে ছালাম জানিয়ে বল্লাম : বন্ধু, দুনিয়ার দফতরে যারা মানুষের নাম লিখে রাখে, তাদের নজরে তুমি পড়বে না জানি। কিন্তু আলিমুল গায়েব বলে যদি কেউ থেকে থাকে, তবে তার দফতরে তোমার কীর্তি নিশ্চয় সোনার হরফে লেখা হয়ে থাকবে।'

'ভাঙ্গা কুলা' গল্পের শুরুই হয়েছিল ইহজাগতিকতা দিয়ে। সর্বাংশে জুড়েই রয়েছে ইহজাগতিকতার বিস্তার ও প্রবল পক্ষপাত। গল্পকারের  ঝোঁকটাও যে ইহজাগতিকতার দিকে তা পরিস্কার ভাবে বোঝা যায়। গল্পের শুরুর দিকে লক্ষ্য করা যাক, 'ভাইস্তা মাখন মিঞা বল্ল : সবরেজেস্ট্রী অফিসে চাচা মিঞাকে একবার যেতেই হবে, নইলে অত বড় জরুরী দলিলটা একদম প- হয়ে যায়।
বল্লাম যাব। কিন্তু রাস্তাঘাটের খবর কি?

বল্ল- রাস্তা ভাল। পথে আছে একটা নদী, দুটো খাল, আর তিনটা সড়ক ভাঙ্গা, তা পার হতে কষ্ট হবে না।' সবরেজেস্ট্রি অফিসে যেতে কী রকমের বেগ পেতে হয়েছিল আর কত প্রকারের অভিজ্ঞতা হয় তা যারা, এই গল্পটা পড়েছেন বিষয়টা তাদের কাছে পরিস্কার। ভাইস্তা মাখন মিঞা যখন চাচারূপী লেখককে সবরেজেস্ট্রি অফিসে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে বললেন, না গেলে দলিলটা প- হয়ে যাবে। তখন কিন্তু চাচা পারলৌকিকতার কোন দোহায় দেননি। নিয়তিকে টেনে আনেননি। এ কথা শুনে ইহজাগতিক বোধ সম্পন্ন মানুষের যা করার কথা চাচা সেটাই করেছেন। এবং যাওয়ার পথে যত বাধা এসেছে, যত বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন সবকিছুর মোকাবেলা করেছেন; ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বাধার দেয়াল টপকে গেছেন বা উপেক্ষা করেছেন। সাহায্য চেয়েছেন পাননি। 

পরিচিতজনেরা সুযোগ বুঝে সটকে পড়েছেন। কিন্তু বড়মিঞা নিজে থেকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। কারণ উনার ধর্মই অন্যের কল্যাণ করা। বৃহত্তর মঙ্গলাকাঙ্খা এক জীবনের ব্রত। পরহিতে ব্রত এই বড়মিঞার দেখা তিনি আবারও পান। যখন টাঙ্গাইলসহ পুরো পূর্ববঙ্গ বন্যায় ডুবে যায়। বন্যার্তদের বাঁচাতে গিয়ে-বাঁচিয়ে তিনি দেন জীবন বিসর্জন।

ইবরাহীম খাঁ লিখেছেন, 'শুনতে পাচ্ছেন না, ঐ যে পানির গর্জন? ঐখানে একটু আগে একটা নৌকাডুবি হয়েছিল। সবাই পারে দাঁড়িয়ে হায় হায় করতে লাগল, এমন সময় ঐ লোকটি কোথা থেকে এসে পানিতে লাফিয়ে পড়ল। দুটি মানুষ ডুবেছিল, ডুব দিয়ে খুঁজে দুজনকেই তুলেছে; কিন্তু নিজে হয়রান হয়ে পড়েছে।
ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে বসলাম। তার মুখের উপর গভীর তৃপ্তির একটা  স্নিগ্ধ জ্যোতি ছড়িয়ে আছে। চিনলাম, এ আমাদের বড়মিঞা!
ক্যাম্পের ডাক্তার সাথে ছিল, দেখতে বল্লাম। ডাক্তার হাত দেখল, বুক দেখল, তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস  ছেড়ে বল্ল- সব শেষ! হার্ট ফেল করেছে।

আমি বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর তার বিদেহী আত্মার প্রতি মনে মনে ছালাম জানিয়ে বল্লাম : বন্ধু, দুনিয়ার দফতরে যারা মানুষের নাম লিখে রাখে, তাদের নজরে তুমি পড়বে না জানি। কিন্তু আলিমুল গায়েব বলে যদি কেউ থেকে থাকে, তবে তার দফতরে তোমার কীর্তি নিশ্চয় সোনার হরফে লেখা হয়ে থাকবে।' গল্পের এই অংশটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ভেতরে কেবল গল্পকার ইবরাহীম খাঁর মনোভঙ্গি বা চিন্তার লক্ষণরেখা প্রকাশিত হয়নি, হাজির হয়েছে একটা জাতির মনোভাব ও চিন্তার লক্ষণরেখাও। এই পাঠটা যদি আমরা বুঝতে ভুল করি তা হলে অনেককিছুই অস্পষ্ট থেকে যাবে আমাদের কাছে।

যে গল্পের শুরু হল ইহজাগতিকতা দিয়ে। তার সমাপ্তি টানা হল পারলৌকিকতার ওপর ভর করে। আমাদের সাহিত্য কি সচেতনভাবেই জীবনের লড়াইকে এভাবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে? ওই বিখ্যাত গানটার কথাও আমরা নিশ্চয় স্মরণ করতে পারি, যেখানে বলা হচ্ছে, 'হয়ত বা ইতিহাসে/তোমাদের নাম লেখা রবে না,/ বড় বড় লোকেদের ভীড়ে/ জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/ তোমাদের কথা কেউ কবে না'। আমরা কি আমাদের গানে-গল্পে-কবিতায় এসব বলেই দায়মুক্তি দেব? তা হলে আমাদের আধুনিক বোধ কোথায়? আধুনিকতার প্রথম ও প্রধান শর্ত হল, জীবনবাদী হয়ে ওঠা। তা হলে আধুনিক সময়ে বসবাস করে-আধুনিকতার সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে, আমরা কেন পারলৌকিকতার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার। একই গল্পে ইহজাগতিকতার প্রশ্নে ইব্রাহীম খাঁর দ্বিধান্বিত অবস্থান আমাদেরকে কেবল বিস্মিত করে না, এসবের গভীরে তালাশ করার প্রতিও আগ্রহী করে তোলে।

এই গল্পের রচয়িতা ইবরাহীম খাঁ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি অবিভক্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল।  তিনি আচারনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন। ধর্মের সকল নিয়ম কানুনের ওপর ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। আবার প্রগতিশীলতার প্রশ্নেও ছিলেন আপসহীন। ইহজাগতিকতা ও পারলৌকিকতার যে ধারণা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বিদ্যমান, তাতে দুদিকেই আমরা উনার পক্ষপাত দেখি। উনার গল্পে একইসঙ্গে যেমন ইহজাগতিকতা ও পারলৌকিকতা প্রাধান্য পেয়েছে এবং শেষাশেষি পারলৌকিকতার প্রতি ঝোঁকটা স্পষ্টত হয়েছে। প্রবন্ধেও ঠিক তার বিপরীতটা অর্থাৎ ইহজাগতিকতার প্রতি পক্ষপাত প্রবলভাবে জারি রয়েছে।

ইবরাহীম খাঁ খ্রিস্টাব্দ ১৯৪৯ এর ১জানুয়ারি 'আমাদের শিক্ষা সমস্যার ক-খ-গ' প্রবন্ধে বলেছেন, ''জীবজগতের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান দাবী : 'আমি বেঁচে থাকতে চাই।' এই বেঁচে থাকার অধিকারকে রক্ষণ ও পোষণ করার জন্য সভ্যতার প্রথম প্রভাত হতে মানুষ সাধনা করে এসেছে : তারি ফলে গড়ে উঠেছে সমাজ, তারি ফলে আবির্ভূত হয়েছে ধর্ম, তারি ফলে সৃষ্ট হয়েছে রাষ্ট্র। সুতরাং সমস্ত সমাজ, সমস্ত ধর্ম, সমস্ত রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান কর্তব্য হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার পথকে সুগম করে দেওয়া।''

একই প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন, 'আমি বলি, স্বাভাবিক পথে এ টাকা জোটান সহজ ত নয়ই, হয়ত সম্ভবও নয়। আমাদের গ্রহণ করতে হবে যুদ্ধের পথ। মহানবী (দ.) বলেছেন, 'অজ্ঞতার বিরুদ্ধে সংগ্রামই শ্রেষ্ঠ জেহাদ। মুজাহিদরা যেমন সর্বস্ব পণ করে লড়ে, আমরা যদি তেমন করে লড়ি, তবেই এ অর্থাভাব আমাদের পথে দাঁড়িয়ে টিকতে পারবে না। যুদ্ধের সময় দেশ রক্ষার জন্য শাসনকর্তারা সর্বপ্রকার ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকেন; কোন লোককে চু-চেঁরা করতে দেন না, দিলে কখনো যুদ্ধ জয় সম্ভব হত না। যে কোন শর্তে তাঁরা কোটি কোটি টাকা ধার নেন,- নব নব ট্যাক্স আদায় করেন, অকাতরে ব্যয় করেন; দেশ রক্ষা হয়, তারপর ঋণ ধীরে ধীরে শোধ হয়। 

যারা অতিরিক্ত হিসাবী, তাদের কাড়াক্রান্তির যোগ মিলাতে দেশ অন্যের হাতে চলে যায়। আমাদের সরকারেরা তেমনি সস্তা লোকপ্রিয়তার প্রলোভন হতে সম্পূর্ণ দূরে থেকে দুরন্ত সাহসে কোমর বেঁধে সর্বপ্রকারে টাকা সংগ্রহ করত: এ জেহাদে লেগে যাওয়া আবশ্যক। বুঝি, কিছু দিন কিছু লোকে কিছু চীৎকার করবে, কিন্তু কাজ পেলে বা পাওয়ার সঙ্গত ও আশু সম্ভাবনা দেখলে বেশীর ভাগ লোক সরকারকে সমর্থন করবে। গুদারা ঘাটে দাঁড়িয়ে এক পয়সা এড়ানোর জন্য যারা সাত পোস্তানের পরিচয় দেয়, তেমন লোক সব দেশেই এবং সব কালেই কিছু কিছু থাকে, কিন্তু দেশ তাদের নয় : দেশের জন্য কোন সংগ্রামের সম্ভাবনা দেখলে তারা আগেই পেটের ব্যথায় অস্থির হয়ে পড়ে।''

ইবরাহীম খাঁ এই লেখায় ইহজাগতিকতার প্রতি উনার পক্ষপাত যেমন প্রদর্শন করেছেন, তেমনি নিজের ধর্মের নিয়ম কানুনের মধ্যেই এসবের নির্যাস খুঁজে নিয়েছেন। ফলে, অন্যদের ইহজাগতিকতার সঙ্গে উনার অবস্থান ও পার্থক্যটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ওই প্রবন্ধের এই অংশটুকুও এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। 'বড়দের নিরক্ষরতা নিবারণ অংশে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'এ এক বিরাট সমস্যা : আমাদের কর্ণধারেরা এর নামে ভয় পান-  আমাদের নিজেদের চিন্তাধারাও থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, পরজন্মে যারা নিশ্বাস করে তারা পর্যন্ত, এজন্মেই কিছু লেখাপড়ার মুখ দেখে যেতে চায়, মুছলমানদের ত একটিই মাত্র জন্ম, তারা কি করে বলতে পারে যে আচ্ছা লেখাপড়াটা এবারকার মত মুলতবীই থাক, ইতিমধ্যে সরকারের হাতে পয়সা জমুক, তখন ফের জন্ম গ্রহণ করে এসে পাঠশালায় ভর্তি হয়ে পড়া যাবে।'

প্রশ্ন হল, প্রবন্ধে ইবরাহীম খাঁ যতটা শক্তভাবে ও যুক্তি দিয়ে ইহজাগতিকতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করলেন, গল্পে তেমনটা মিললো না কেন?  গল্পকার কি গল্পকে আপন বেগে যেতে দেয়ার লক্ষ্যে এমনটা করেছেন? এটা একটা যুক্তি হতে পারে। ফিকশন ও ননফিকশনের পার্থক্য হাজির করেও নিজের কোর্টে বল টানার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু আমরা এই যুক্তির সঙ্গে একমত নন। ইবরাহীম  খাঁর ইহজাগতিকতার প্রতি পক্ষপাত, পারলৌকিকতাকে উপেক্ষা করে নয়। বাঙালি মুসলমান সমাজ যেমন এই প্রশ্নে দ্বিধান্বিত ও সংশয়িত। ইবরাহীম খাঁও তার ব্যতিক্রম নন। এ কারণে গল্পে ও প্রবন্ধে আমরা গল্পকার-প্রাবন্ধিকের দুই ধরণের সত্তার উপস্থিতি হাজির হতে দেখি।

ইবরাহীম খাঁ বড়মিঞাকে নির্মাণ করতে গিয়ে বলেছেন স্বদেশী আন্দোলন করেছেন, খেলাফতে গিয়েছেন, পুলিশ মেরেছেন, পুলিশের মার খেয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। এ গুলোর সবই উল্লেখযোগ্য পরিচয়, এবং তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতোই। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, এই পুলিশ ব্রিটিশের পুলিশ। যাকে মার দেওয়া এবং যার হাতে মার খাওয় মোটেই অশোভন কিছু নয়। কিন্তু দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখনও কেনো পুলিশের সেই ভূমিকার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। ব্রিটিশের পুলিশকেই দেখা যায়, স¦াধীন দেশের পুলিশের মাঝে। যার উল্লেখ পাওয়া যায় গল্পকারের লেখাতেও। তিনি বলেছেন, কয়েক মাস আগেও পাকিস্তান আন্দোলন উপলক্ষে শহরে কি গোলমাল করেছিল- দশদিন হাজত খেটে এসেছে। এরকম একটা শক্তিশালী ন্যারেটিভ যে গল্পের শরীর জুড়ে বিদ্যমান সেই গল্পের শেষটা কেন ওরকম হল, এবং অসহায় আত্মসমর্পণে শেষ করা হল তা কেবল প্রহেলিকা নয়, বড়ো রকমের প্রশ্নও বটে। সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে যা কিছু সৃষ্টি হয় তার সবটাই নির্মিত হয়। 

এসব কোন প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। এমনকি রূপকথা কিংবা লোকসাহিত্যের যে রূপ, গঠণ বা কাঠামোটা আমরা পাই তার কোনটাই কিন্তু স্বয়ম্ভু নয়। সবই নির্মিত হয়। এসব নির্মাণে সবসময়ই কারিগরের অভিপ্রায় বা অভীপ্সা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে বলে আমরা মনে করি। 'ভাঙ্গা কুলা'ও সেসব থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। গ্রাম ও শহরের পার্থক্যটা পাঠ করলেই আমরা বুঝব গল্পকারের সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের শানে নযুল। তিনি লিখেছেন, 'হতেও পারে। তবে বেশীর ভাগের বেলাতেই ঐ ঘটে কিনা : তারা ছোটবেলায় গাঁ চিনে, তারপর বড় হয়, শহরে বাসা বাঁধে। গাঁ পেছনে পড়ে যায়, তখন গাঁ হয় তাদের অনুগ্রহ করে সাময়িক উল্লেখের পদার্থ, দরদের সঙ্গে হামেশা স্মরণের জিনিস নয়।'

গল্পের শেষাশেষি যে দরদে তিনি বড়মিঞার কষ্টকে এঁকেছেন, তা পাঠকমাত্র সকলকেই আদ্র করে। গল্পকারের ভাষায় : 'কি করে চলে? বড় কষ্টে আছে সাব। বছর দুই আগে কারে কারে যেন ধরে বাড়ীতে পাঁচটা তাঁত বসিয়েছিল, তাই দিয়ে চলত। পাকিস্তান হওয়ার পর কর্তারা তা উঠিয়ে আমজাদ খোনকারের বাড়িতে নিয়েছে।' লক্ষ্য করুন, দেশ স্বাধীনের ক্ষেত্রে যে বড় মিঞার এতো এতো অবদান। সেই বড়মিঞাকে স্বাধীন দেশ কী পরিণতি দিয়েছে। তার তাঁতটা পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আইনের শাসন থাকলে সেটা নিশ্চয় সম্ভব হত না? পুলিশ যদি সত্যি সত্যি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়মমাফিকভাবে পালন করতো বড়মিঞার তাঁত নিশ্চয় খোনকারের বাড়ি যেত না?

বাস্তবতা হল, পূর্ববঙ্গের মানুষেরা যে আকাঙক্ষা নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন করেছিল সেই আকাক্সক্ষার কোনোটাই পুরণ হয়নি। আবার স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের যে প্রচেষ্টা তার কোনটাই বাস্তবায়িত হয়নি। অধরা থেকে গেছে আমাদের গণতান্ত্রিক পরিবেশ, ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা, বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের মুক্তি, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ, সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা, রাষ্ট্রের সকল স্তরে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মতো মৌলিক দাবিসমূহের ক্ষেত্রে। বরং এগুলোকে নস্যাৎ করে সমাজ-রাষ্ট্রে উৎপাদন করা হয়েছে বিভক্তির চিহ্নরেখা। বৈষম্যকে প্রযত্নে দিয়ে বর্ধিত করা হয়েছে সীমাহীন, তার ডালপালা ছড়ানো হয়েছে আকাশের মাপে মাপে। মানুষের জীবনে ন্যূনতম শান্তি ও স্বস্তির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। একারণে, একটি স্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন দশকের মধ্যে দুইবার গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এই ভূখ- গণ অভ্যুত্থানে সাফল্য দেখাতে সক্ষম হলেও, গণ অভ্যুত্থানের বিজয় অর্জন কেন অধরা থেকে যায় সেই প্রশ্নের কোন সুরাহা নেই, নেই কোন সদুত্তর।

তা হলে আমাদের বাস্তবতা কি কেবলই আত্মত্যাগ ও আত্মবিসর্জনের? কিছু দিন পর পর এখানে গণ অভ্যুত্থান হবে, আর স্বৈরাচারের আসা-যাওয়ার খেলা কি চলতেই থাকেবে? সালাম-বরকত-রফিক; আসাদ-মতিউর-শামসুজ্জোহা; রুমি- মতিউর-জাহাঙ্গীর; নূর হোসেন-ডা. মিলন; সাঈদ-মুগ্ধদের মতো তরুণেরা কি কিছুদিন পরপর কেবইলই প্রাণ দেবে? এই কি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের রুঢ় ও নির্মম বাস্তবতা। এদেশের শাসক ও প্রশাসক বর্গ কবে একান্তই আমাদের হয়ে উঠবে। আমাদের পুলিশ কবে আপামর জনগণের সদর্থক অর্থেই বন্ধু হয়ে উঠবে?

জাতি হিসেবে আমরা কেন বারংবার প্রত্যাশা পূরণের পথে হোঁচট খায়, কী হতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর? আমরা মনে করি এসবের যথার্থ কারণ নিহিত রয়েছে আমাদের সংস্কৃতির গভীরে। সংস্কৃতিগত দিকে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে আমরা বহুধাবিভক্ত। আমাদের ধর্মবোধকে এখনও শেকড়সংলগ্ন করে তোলা সম্ভব হয়নি। যা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে আমাদের আচরিত ধর্মাচারে। যে কোন দেশ বা রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে তার সামাজিক শক্তির ওপরে। বেদনার হল, আমরা সমাজকে ক্রমাগত দুর্বল করে চলেছি। ফলে, আমাদের রাষ্ট্র হয়ে উঠছে দুর্বৃত্তসম। দুর্বল সমাজ বহুধাবিভক্ত হবে এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। এ কারণে, আমরা ইহজাগতিকতা ও পারলৌকিকতাকে কোথায় মেলাব, কতটুকু মেলাব আর কতটুকু দূরত্ব রাখব সেই প্রশ্নের কোন ফায়সালা করতে পারেনি। এমনকি এসব নিয়ে খোলামেলা আলোচনার পরিসর তৈরি করাও সম্ভব হয়নি।

এসব বিবেচনায় 'ভাঙ্গা কুলা'য় ইহজাগতিকতা ও পারলৌকিকতার যে দ্বৈরথ আমরা দেখতে পাই তা মূলত বাঙালি মুসলমানের বাস্তবতা। যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেককিছুর যোজন-বিয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। বাঙালি তার লোকধর্মকে ভুলতে বসেছে। লোকধর্মের আত্মীকরণ ও সাঙ্গীকরণের যে মহোত্তম প্রবণতা ও গুণপণা তাকে বিসর্জন দিয়েছে। অথচ যে কোন জাতির শেকড় নিহিত থাকে তার লোকসংস্কৃতিতে, যার শক্তিশালী অংশবিশেষ হল লোকধর্ম।

আমরা মনে করি, বাঙালি মুসলমানের ইহজাগতিকতা ও পারলৌকিকতার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত যে অবস্থান তা দূর না হলে, এই ২০২৪-এ ছাত্র জনতার যে ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত হল তার স্বপ্ন ও আকাঙ্খা পূরণ দুরুহ হয়ে উঠবে। 'ভাঙ্গা কুলা' গল্প এক্ষেত্রে প্রতীকিবিশেষ। ইবরাহীম খাঁর রচনা এই বিবেচনায় হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট, যার আলোকে আমরা পেতে পারি অনেককিছুর সুলুক সন্ধান। আমরা যদি জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে এক হতে না পারি, অন্তত সকলের একত্রিত হওয়ার একটা পরিসর বের করার মতো ঔদার্য দেখাতে না পারি। তা হলে আমরা এক হব কীভাবে? দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কোন মন্ত্রবলে, কোন সে প্রার্থনায়? ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মাচারের প্রশ্নে সম্মিলিতভাবে ধারণ করার মতো বৃহৎ একটা আকাক্সক্ষার জায়গা তৈরি করা সম্ভব না হলে, কীভাবে একটা দেশ নির্মিত হবে? কোন অনুপ্রেরণা বলে একটা জাতি ঝাঁপিয়ে পড়বে আকাঙ্খায় বর্তমান ও সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার প্রত্যয়ে?

এসব প্রশ্নের যদি উত্তর না হয়,তা হলে আমাদের দুঃখের শেষ থাকবে না। যে দুঃখ ও বেদনার ভার আমরা বহন করে চলেছি আবহমান কাল ধরে। বড়মিঞারা কি চিরদিন 'ভাঙ্গা কুলা' হিসেবেই থেকে যাবে, নাকি এই অচলায়তন ভাঙ্গতে হবে? বড়মিঞার নাম সোনার হরফে লেখা হবে পারলৌকিক কোন কালপর্বে নয়। লেখা হবে মর্ত্যরে মানুষ হিসেবে আমাদের হৃদয়ে, ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিজুড়ে। কারণ এই মানুষ ও মাটির জন্য বড়মিঞা স্বদেশী হয়েছেন, খেলাফতে গেছেন, পুলিশ মেরেছেন-পুলিশের মার খেয়েছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন এবং সবশেষে বন্যা পীড়িত মানুষের জীবন বাঁচিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।

Comments